উইকেটের সহায়তায় নয়, জিততে হবে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে
আবুধাবিতে নিজেদের তৈরি করার দুই ম্যাচে কী পেলো? কী বুঝলো? কী শিখলো বাংলাদেশ? খালি চোখে এ দুটি নিছক প্রস্তুতি ম্যাচ, যা জিতলে ভালো দেখাতো। মনে হতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে জোড়া জয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী টাইগাররা। এখন হেরে যে আত্মবিশ্বাস আর সামর্থ্যে আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তাও না।
হ্যাঁ! দুটি পরাজয় শুনতে কানে লাগে, দেখতেও খারাপ দেখাচ্ছে। এটাই বাস্তবতা। তবে আবুধাবির এই দুই প্রস্তুতি ম্যাচ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জয় আত্মবিশ্বাস-আস্থা বাড়ানোর অতি কার্যকর দাওয়াই বা রসদ ছিল না।
কঠিন সত্য হলো, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য এখনও সেভাবে তৈরি নয় বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার আয়ারল্যান্ডের কাছে খাবি খাওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী চিন্তার কবর রচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে টাইগাররা বুঝে গেছে, আরব আমিরাতের উইকেট বিশেষ করে আবুধাবির উইকেট শেরে বাংলার সেই ঠেলাগাড়ির গতি ও হাঁটু-কোমর উচ্চতার মরা নির্জিব পিচ নয় যে ১২০ রান করে জেতা যাবে।
এখানে চমৎকার গতি ও বাউন্সে বল ব্যাটে আসে সে সত্যও জানা হয়ে গেছে। জিততে হলে ভালো বোলিং আর ব্যাটিং করতেই হবে। আগে ব্যাটিংয়ে নামলে ১৬০-১৭০ রান করতে হবে। আর রান তাড়া করলেও ধরে নিতে হবে ১২০-১৩০ নয়; করতে হবে ১৬০+ রান তাড়া।
অর্থাৎ একটা বড় বাস্তব ও কঠিন সত্যের দেখা পেলো টাইগাররা। তা হলো, উইকেটের সহায়তায় প্রতিপক্ষ বধের কোনো সুযোগই নেই বিশ্বকাপে, যা করার করতে হবে নিজের শক্তিতে। নিজেদের কাজটি ঠিক মতো করতে হবে। যা অনেকদিনই হচ্ছে না। যে দুটি সমস্যা দীর্ঘদিন ভোগাচ্ছে, এ প্রস্তুতি ম্যাচেও ঠিক ওই দুই জায়গাই ভুগিয়েছে। এক ডেথ ওভারের বোলিং, দুই টপঅর্ডার ব্যাটিং।
প্রথম ম্যাচে ডেথ ওভারের বোলিং ভালো না হওয়ায় সম্ভাব্য জয় হয়েছে হাতছাড়া। আগে ব্যাট করে ১৪৬ রান করেও প্রায় ১৬ ওভার পর্যন্ত এগিয়ে থেকে শেষ ৩-৪ ওভারে গিয়ে ম্যাচ হারতে হয়েছে। যে ম্যাচের ৮০ ভাগ সময় লঙ্কানরা গড়পড়তা ওভারপিছু ৭ রানের বেশি তুলতে পারেনি, সেই ম্যাচে শেষ তিন-চার ওভারে ১১ রানের বেশি করে তুলে পৌঁছে গেছে জয়ের বন্দরে।
অথচ টাইট বোলিং হলে তা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। ওই ১৪৬ রানকেও জয়সূচক পুঁজিতে রূপান্তরিত করা যেতো। আজ ১৭৮ রানের বড় স্কোর তাড়া করার চাপে শুরুতেই তিন উইকেটের পতন। যেখান থেকে আর সামনে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বোলিং আর ব্যাটিং দুই বিভাগের সত্যিকার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। আইরিশ ব্যাটসম্যান গ্যারেথ ডিলানির ঝড় সামলাতে পারেননি কেউ। এমনকি মোস্তাফিজও না, বেদম মার খেয়ে দিয়েছেন ৪০ রান। শরিফুলও তথৈবচ। আগের ম্যাচে তাসকিনের এক ওভারে ২১ দেয়া আর আজ মোস্তাফিজ-শরিফুলের আলগা বোলিং।
বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে রানের লাগাম টেনে ধরার কাজে পেসারদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা হতে পারে চরম ভরাডুবির কারণ। ওমান কিংবা আরব আমিরাতের পিচ ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। খানিকটা স্পোর্টিং। ফাস্ট-বাউন্সি ট্র্যাক নয়। এখানে পেস নির্ভরতা কমিয়ে স্পিন নির্ভরতা বাড়াতে হবে।
মাথায় রাখতে হবে, আফগানরা যদি রশিদ, মুজিব আর নবী- তিন স্পিনার দিয়ে ম্যাচ জিততে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? বাংলাদেশের মূল শক্তি স্পিন। জিততে হলে স্পিনারদের কার্যকরিতা বেশি দরকার। সম্ভব হলে ১০-১২ ওভার স্পিন দিয়ে চালানোর পরিকল্পনা আটতে হবে। একদম রুটিন করে তিনজন পেসার খেলাতেই হবে- এমন ছক কষে কোনো লাভ নেই। সেটা ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড করতে পারে; বাংলাদেশ নয়।
প্রস্তুতি ম্যাচে যে পেসাররা শ্রীলঙ্কা আর আয়ারল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখতে পারেননি, তাদের ওপর আগামীতে বেশি নির্ভর করার অর্থ নির্ঘাত মৃত্যু। কাজেই ১০-১২ ওভার স্পিনাররা বল করবেন এমন পরিকল্পনা অতি জরুরি। বাকি আট ওভারের চারটি করবেন মোস্তাফিজ। সঙ্গে তাসকিন-শরিফুল দুজনকে না খেলিয়ে সাইফউদ্দিনকে নেয়া যেতে পারে। কাটার মাস্টারের সঙ্গে শরিফুল-তাসকিনের মতো দুই এক্সপ্রেস বোলারকে খেলানোর অর্থ ‘বুমেরাং’ হওয়া। সে সত্য উপলব্ধির এখনই সময়।
এর বাইরে ব্যাটিং দুর্বলতা থেকেই গেছে। স্লো, লো আর টার্নিং উইকেটে খেলতে খেলতে নির্ভেজাল ব্যাটিং ট্র্যাকেও হাত খুলে খেলার প্রবণতা, ইচ্ছে, মানসিকতা আর অভ্যাস গেছে কমে। এখনও ঘুরে ফিরে ১৪০ এর ঘরই যেনো আদর্শ স্কোর হয়ে গেছে। ১৭৫-২০০ স্ট্রাইকরেটের ঝড়ো ইনিংস বহু দূরে, কারও ব্যাট থেকে লম্বা ইনিংস আসছে না। লঙ্কানদের বিপক্ষে ১৪৬ আর আইরিশদের বিপক্ষে ১৪৩ রানের দলীয় সংগ্রহ সে সত্যই জানান দিচ্ছে।
টপঅর্ডারে নাইম শেখ, লিটন দাস আর মুশফিকুর রহিমের অফ ফর্ম ভোগাচ্ছে। সৌম্য সরকার প্রস্তুতি ম্যাচে মোটামুটি রান করেছেন। নাইমকে বাদ দিয়ে সৌম্যকে ওপেনার হিসেবে খেলালে একজন অন্তত অফ ফর্ম ব্যাটার কমতো। লিটন-মুশফিক নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন। তাদের জায়গামতো জ্বলে ওঠা খুব খুব জরুরি।
এখন সাকিবই ভরসা। চ্যাম্পিয়ন অলরাউন্ডারের তিনে নেমে জ্বলে ওঠার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। সাকিব কোনো কারণে ব্যাট হাতে ভাল করতে না পারলে কিন্তু আর রক্ষা থাকবে না। তখন অধিনায়ক রিয়াদ আর তিন তরুণ আফিফ, সোহান আর শামীম পাটোয়ারীর ওপর অনেক চাপ পড়বে। তারা কি সে চাপ সামলাতে পারবেন?
এআরবি/এসএএস/জেআইএম