জোহানেসবার্গের দুঃখ ক্রিকেটের মক্কায় ভুললো পাকিস্তান
গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। সেই অনিশ্চয়তার খেলার সবচেয়ে অনিশ্চিত এক দল পাকিস্তান। ক্রিকেটের যেকোনো ফরম্যাটে ব্যাখ্যাতীত সব কাণ্ডের জন্ম দেওয়ার কারণে পাকিস্তান দলকে প্রায়ই আনপ্রেডিক্টেবল নামে ডাকা হয়। যার প্রমাণ মেলে প্রতিনিয়তই।
ব্যতিক্রম ছিলো না আইসিসি বিশ্ব টি-টোয়েন্টির প্রথম দুই আসরেও। ২০০৭ সালের আসরে গ্রুপপর্বে ভারতের কাছে তারা হেরে যায় বোলআউটের নিয়মে। ফের তাদের দেখা হয় ফাইনালে। জোহানেসবার্গের সেই ফাইনালে ঠাণ্ডা মাথার মিসবাহ উল হকের ভূতুরে এক স্কুপ শটে শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানের বিশ্বকাপ স্বপ্ন।
এতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়নি পাকিস্তান। বরং পরের আসরে আরও শক্তিশালী হয়ে বিশ্ব মঞ্চে উপনীত হয় ইউনিস খানের দল। জোহানেসবার্গে খোয়ানো শিরোপার দুঃখ ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডস স্টেডিয়ামে গিয়ে ভুলিয়ে দেয় পাকিস্তান, জিতে নেয় বিশ্ব টি-টোয়েন্টির দ্বিতীয় আসরের শিরোপা।
প্রথম আসরেই নানান রোমাঞ্চের জন্ম দেয়া বিশ্ব টি-টোয়েন্টির আসর দুই হাত ভরে দিয়েছে দ্বিতীয় আসরেও। দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া প্রথম আসরের মতো ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে হওয়া বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতেও ফাইনালে খেলে এশিয়ারই দুই দল। যা সাক্ষ্য দেয় উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের আধিপত্যের।
ইংল্যান্ডে হওয়া সেই আসরে গ্রুপ অব ডেথে ছিলো শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখনকার টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ে ক্যারিবীয়দের অবস্থান ছিলো ১১তম। তাই গ্রুপে তাদেরই ধরা হয়েছিলো দুর্বল দল হিসেবে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথম রাউন্ডেই ওয়ানডে বিশ্বকাপের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
গ্রুপপর্বে চমক ছিলো আরও। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচেই স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেয় প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসা নেদারল্যান্ডস। ইংলিশদের করা ১৬২ রানের সংগ্রহ ইনিংসের শেষ বলে টপকে যায় ডাচরা। তবে প্রথম রাউন্ডের বাধা পেরুতে পারেনি তারা।
যেমনটা পারেনি প্রথম আসরে বিশ্বকে বাঘের গর্জন শোনানো বাংলাদেশ দলও। এ গ্রুপে ভারত ও আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে সেই আসরের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় মোহাম্মদ আশরাফুলের দল। গ্রুপ পর্ব থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিদায়ের মতোই বড়সড় এক অঘটনই ছিলো এটি।
ঘটন-অঘটনের ভরপুর গ্রুপপর্বে নিউজিল্যান্ডকে চমকে দিয়েছিলো স্কটল্যান্ড। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ৭ ওভারে ৮৯ রানের সংগ্রহ দাঁড় করিয়ে ফেলে স্কটিশরা। তবে তাতে দমে যায়নি কিউইরা। তারা পাল্টা আক্রমণে মাত্র ৬ ওভারেই জিতে নেয় সেই ম্যাচ, নিশ্চিত করে ফেলে সুপার এইটের টিকিট।
আসরের চ্যাম্পিয়ন দল পাকিস্তান গ্রুপপর্বে দুই ম্যাচে হেরে যায় একটি। তবে নেট রানরেটের ভিত্তিতে পায় সুপার এইটের টিকিট। সেখানেও তারা চার দলের মধ্যে হয় দ্বিতীয়, হেরে যায় শ্রীলঙ্কার কাছে। পরে যেই শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় তারা।
তবে সুপার এইটের ম্যাচে অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়েন পাকিস্তানের পেসার উমর গুল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মাত্র ৬ রান খরচায় ৫ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েন এ ডানহাতি পেসার। বিশ্ব টি-টোয়েন্টি তো বটেই, কুড়ি ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেয়ার প্রথম ঘটনা ছিলো সেটি।
গুলের এমন পারফরম্যান্সের পরও সুপার এইটে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি পাকিস্তান। তাই সেমিফাইনালে তাদের সামনে পড়ে আসরে তখন পর্যন্ত অপরাজিত দল দক্ষিণ আফ্রিকা। নকআউট পর্ব থেকেই শুরু হয় শহিদ আফ্রিদির ম্যাজিক। পরের দুই ম্যাচেই তিনি হন দলের নায়ক।
প্রথম আসরে তিনিই ছিলেন টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড়, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি পাকিস্তান। সেই ক্ষত ভুলিয়ে দিতেই হয়তো দ্বিতীয় আসরের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে একক নৈপুণ্যই দেখান আফ্রিদি। প্রথমে তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সেমিতে পরাস্ত হয় প্রোটিয়ারা।
ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে আফ্রিদির বল হাতে চার ওভারে ১৬ রানে ২ উইকেট ও ব্যাটিংয়ে ৩৪ বলে ৫১ রানের সুবাদে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে পাকিস্তান। অন্য সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ১০১ রানে থামিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় শ্রীলঙ্কা।
২১ জুন তারিখে ঐতিহাসিক লর্ডসে শিরোপার লড়াইয়ে নামে এশিয়ার দুই দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। প্রথম আসরের মতো এবারও ছিলো লো স্কোরিং ম্যাচ। যেখানে আগে ব্যাট করে ১৩৮ রানে থামে লঙ্কানরা। জবাবে আফ্রিদি ৪০ বলে ৫৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে ৮ উইকেটের সহজ জয় পায় পাকিস্তান, জিতে নেয় শিরোপা।
একনজরে ২০০৯ বিশ্ব টি-টোয়েন্টি
চ্যাম্পিয়ন: পাকিস্তান
রানার্সআপ: শ্রীলঙ্কা
সর্বোচ্চ রান: তিলকারাত্নে দিলশান (৩১৭)
সর্বোচ্চ উইকেট: উমর গুল (১৩)
সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ: দক্ষিণ আফ্রিকা (২১১/৫)
সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ: নেদারল্যান্ডস (৯৩)
সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ: তিলকারাত্নে দিলশান (৯৬*)
ম্যাচে সেরা বোলিং: উমর গুল (৬ রানে ৫ উইকেট)
ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়: শহিদ আফ্রিদি (৫৪* রান ও ১ উইকেট)
টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়: তিলকারাত্নে দিলশান (৩১৭)
এসএএস/আইএইচএস/