তবুও সাকিবই আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু
ভক্তরা তাকে ডাকেন বাংলাদেশের প্রাণ বলে। শুধু সমর্থক ও ভক্তদের ডাকা নামে নয়। সত্যিই ‘বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান’। অন্তত পরিসংখ্যান সেটাই জানান দিচ্ছে। পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড ধরলেই দেখা যাবে, টিম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি আর কার্যকর অস্ত্রের নাম সাকিব আল হাসান।
হোক তা টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি, তিন ফরম্যাটেই টিম বাংলাদেশের শক্তির বড় উৎস সাকিব। এ অসামান্য প্রতিভাবান অলরাউন্ডার কতটা ভাল খেলতে পারেন, বড় মঞ্চে তার সাফল্য কতটা আকাশছোঁয়া হতে পারে, সেটাও সবার জানা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, এইতো গত ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের বিশ্বকাপেই সাকিব ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে উঠে নিজের জাত, মান মেধা আর সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন।
যে দল সেরা চারেই যেতে পারে না, সেই দলের পারফরমার হয়েও বিশ্বের সব দেশের বাঘা বাঘা বোলারকে শাসন করে ইচ্ছেমত পিটিয়ে ৮ ম্যাচে ৬০৬ রান করেছিলেন সাকিব। একমাত্র অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি ৭টি দেশের বিপক্ষেই পঞ্চাশ বা তার বেশি রান আসে সাকিবের ব্যাট থেকে। সাথে ১১টি উইকেটও দখল করেছিলেন।
ওই আসরে বাংলাদেশ হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আফগানিস্তানকে। তিন ম্যাচেই টাইগারদের জয়ের অন্যতম রূপকার ছিলেন সাকিব। সেই তিন ম্যাচের সেরার পুরস্কারও উঠেছিল তার হাতেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১ উইকেট ও ৮৪ বলে ৭৫, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৪ রানে ২ উইকেট এবং ৯৯ বলে ১২৪ রানের হার না মানা ইনিংস ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের অনুপম সাক্ষর (৬৯ বলে ৫১ এবং ২৯ রানে ৫ উইকেট) রেখে ম্যাচ জিতিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন সাকিব।
যদিও ফর্মে নেই, তারপরও এবার আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঘুরেফিরে সাকিবই আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। ফর্মে নেই, এই অজুহাতে আইপিএলের আরব আমিরাত পর্বে কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর) তাকে মাঠেই নামায়নি প্রথম ৫ ম্যাচ। এর মধ্যে যখন হারতে শুরু করলো তারা, তখনই সাকিবের দ্বারস্থ হতে হয়। সাকিব মাঠে নামতেই বদলে যায় কেকেআরের পরিবেশ। দলটির ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান এবং কিউই কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালাম পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, মাঠে সাকিবের উপস্থিতি দলের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সাকিবের ছোঁয়ায় টানা দুই ম্যাচ জিতে প্লে-অফ নিশ্চিত হয় কেকেআরের।
পরিসংখ্যান জানিয়ে দিচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিব বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। এক নম্বর অলররাউন্ডার। এমনিতে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে রান তোলায় সাকিব তামিমের পেছনে। উইকেট শিকারে সবার ওপরে। একইভাবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও রান তোলায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের (১০২ ম্যাচে ৯৪ ইনিংসে ১৭৭১) পর দ্বিতীয় স্থানে সাকিব (৮৮ ম্যাচ, ৮৭ ইনিংস, ১০ বার অপরাজিত থেকে মোট রান ১৭৬৩)।
একই সঙ্গে ১০৬ উইকেট শিকার করে উইকেট প্রাপ্তিতেও সাকিব বাংলাদেশের সব বোলারের ওপরে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসেও দ্বিতীয সেরা বোলার সাকিব। ১০৭ উইকেট নিয়ে সাকিবের ঠিক ওপরেই অবস্থান করছেন লাসিথ মালিঙ্গা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই হয়তো সেরার স্থানটি নিজের করে নেবেন তিনি।
কিন্তু পরিসংখ্যান জানাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেই সাকিব আরও বেশি উজ্জ্বল। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটের বিশ্বকাপে সাকিবের ব্যাট ও বল আরও শানিত। অনেক বেশি সফল।
আসুন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স এক পলকে দেখে নেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিব খেলেছেন ২৫ ম্যাচ। ২৫ ইনিংসেই ব্যাট করেছেন। ৫ বার অপরাজিত থেকে রান করেছেন ৫৬৭। সর্বোচ্চ ৮৪। সেঞ্চুরি না থাকলেও হাফ সেঞ্চুরি ৩টি। গড় ২৮.৩৫। স্ট্রাইকরেট ১২৮.৮৬ করে।
বলে রাখা ভাল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তামিম (২৩ ম্যাচে করেছেন ৫১৪ রান), মুশফিক (২৫ ম্যাচে ২০ ইনিংস মোট রান ২৫৮) এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (২২ ম্যাচে ১৮ বার ব্যাট করে ১৯৪ রান)- সবাই রান তোলায় সাকিবের পিছনে। বোলিংয়েও টাইগার বোলারদের মধ্যে সাকিব অনেক সফল। ২৫ ম্যাচে নামের পাশে লিখেছেন ৩০টি উইকেট। সেরা বোলিং ১৫ রানে ৪ উইকেট। ওভার পিছু রান দিয়েছেন ৬.৬৪ করে।
পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, একমাত্র তামিমই রান তোলায় সাকিবের কাছাকাছি। এছাড়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মুশফিক এবং রিয়াদরা সাকিবের ধারে কাছেও নেই। ওই দুজনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটি ফিফটিও নেই। মুশফিকুর রহিমের সর্বোচ্চ স্কোর ৪৯, আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান হলো ৪৭।
সেখানে সাকিবের আছে তিন-তিনটি ফিফটি এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো তার একটিও বাছাই পর্বে নয়। সবকটাই মূল পর্বে। প্রথমটি ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার পাল্লেকেল্লেতে পাকিস্তানের বিপক্ষে (৮৪)। দ্বিতীয়টি ২০১৪ সালে ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে (৬৬) এবং সর্বশেষ হাফ সেঞ্চুরিটিও (৫০*) পাকিস্তানের বিপক্ষেই ২০১৬ সালে কলকাতায়। যেহেতু তামিম খেলছেন না, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সাকিবই টাইগার ব্যাটিংয়ের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।
আর তার বোলিংতো বরাবরই সব ফরম্যাটে টিম বাংলাদেশের প্রধান শক্তি। সবচেয়ে বড় অস্ত্র। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে তার দুবার করে ৪ উইকেট আছে। প্রথমটি সেই ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে হওয়া ম্যাচটি। যেটা ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সাকিবের অভিষেক। এক কথায় অবিস্মরণীয় অভিষেক হয়েছিল ‘চ্যাম্পিয়ন অলরাউন্ডারে’র।
ওই ম্যাচে টাইগারদের দুর্দান্ত টিম পারফরমেন্সে ক্রিস গেইল, ডেভন স্মিথ, মারলন স্যামুয়েলস, শিবনারায়ন চন্দরপল, ডোয়াইন ব্রাভো, রামনরেশ সারওয়ান, রবি রামপাল, ফিডেল এডওয়ার্ড আর ড্যারেন পাওয়েলে সাজানো প্রচন্ড শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ হার মেনেছিল ৬ উইকেটে। মোহাম্মদ আশরাফুল (২৭ বলে ৬১) আর আফতাব আহমেদের (৪৯ বলে ৬২) জোড়া ফিফটিতে বাংলাদেশ ১২ বল আগে জয়ের বন্দরে পৌঁছালেও সাকিবও কম যাননি। ৪ ওভারে ৩৪ রানে ৪ উইকেট শিকার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজেকে ১৬৪ রানে বেঁধে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে ওই একটি জয়ই সম্বল বাংলাদেশের। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের পর আর কোন ম্যাচ জেতা সম্ভব হয়নি। তাই সাকিবের আর ম্যাচ সেরাও হওয়া হয়নি।
তারপরও ২০১৬ সালে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি আসরেও ব্যাঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৭ রানে ৩ উইকেট শিকারী ছিলেন সাকিব। ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ব্যাঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে শেষ তিন বলে ৩ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১ রানের আক্ষেপে হারা ম্যাচেও সাকিব বল ( ৪ ওভারে ১/২৩) ও ব্যাট হাতে (১৫ বলে ২২) দলের সেরা পারফরমার ছিলেন।
হয়ত ফর্মে নেই। তারপরও ভুলে গেলে চলবে না, সব সময়ই বড় মঞ্চে সাকিবের ভাল খেলার রেকর্ড অনেক ভাল। যেহেতু বড় মঞ্চে সাফল্য বেশি এবং ব্যাট ও বল হাতে ভাল খেলার ট্র্যাক রেকর্ডও ভাল। তাই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সাকিবের ব্যাট আর বল অন্যরকম নির্ভরতা। দেখা যাক সাকিব জায়গামত আবারো দলের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিতে পারেন কি না?
এআরবি/আইএইচএস