‘কাদিরকে বাউন্ডারি মারার পর মিয়াঁদাদ বললেন, ইয়ে কোন হ্যায়?’
সবার জানা ১৯৮৬ সালে শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় পাকিস্তানের সাথে মাত্র ৯৪ রানে অলআউট হয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতে সর্বাধিক ৩৭ রান করেছিলেন শহিদুর রহমান শহিদ। চট্টগ্রামের ওই মিডল অর্ডারের ইনিংসটি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বাধিক ১৪ রান করেছিলেন দু’জন; রফিকুল আলম আর গোলাম ফারুক সুরু।
এর মধ্যে রফিকুল আলম এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। এমনিতে হাসি-খুশি স্বভাবের রফিকুল আলম যুক্তরাষ্ট্র প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন নীরবে নিভৃতে। দেশে বন্ধু বান্ধব কারো সাথেই যোগাযোগ নেই তেমন।
রফিকের সাথে ১৪ রান করা গোলাম ফারুক সুরু প্রথম ওয়ানডে খেলেছিলেন অলরাউন্ডারের কোটায়। ১৯৮৬ সালে মোরাতোয়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে টাইগার একাদশে ছিলেন ৪ পেসার- জিএম নওশের প্রিন্স, সামিউর রহমান সামি, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ আর গোলাম ফারুক সুরু।
অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে কেমন ছিল টাইগারদের ব্যাটিং ও বোলিং পারফরমেন্স? জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে সে সব কথাই জানিয়েছেন গোলাম ফারুক সুরু।
সেই সাক্ষাতকারে সুরু অনেক কথাই জানিয়েছেন। যার অনেক কিছুই অনেকের অজানা। সেই ৩৫ বছর আগের কথা হলেও সুরুর কথা-বার্তায় পরিষ্কার প্রথম ওয়ানডের প্রায় সব স্মৃতি তার মনের আয়নায় জ্বল জ্বল করছে।
সুরু শুরু করেন এভাবে, ‘প্রথমে লিপু ভাই গেলেন ইমরান খানের সাথে টস করতে। উইকেটে একটু ময়েশ্চার ছিল। আমরা নিজেরাই নিজেদের মত করে ওয়ার্মআপ করতাম। তখন কোন ট্রেনার-ফিজিও কিছুই ছিল না। একজন ক্রিকেট ম্যানেজার আর একজন সহকারি ম্যানেজার ছিলেন দলের সাথে। আর টিম ক্যাপ্টেন। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি টস জিতলে আমরা ফিল্ডিং করবো।’
‘আমরা টস হারলাম। পাকিস্তান তখন ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, মহসিন খান, মুদাসসার নজর, ওয়াসিম আকরাম, আব্দুল কাদির আর মঞ্জুর এলাহির মত বিশ্বমানের তারকায় ঠাসা টিম।’
‘ইমরান টস জিতে লিপু ভাইকে বলেছিলেন উইকেটে ময়েশ্চার আছে, তাই আমরা আগে ব্যাট করবো না। তোমরা ব্যাট করবে আগে। এই বলে আমাদের ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে ইমরান চলে গেলেন ড্রেসিং রুমে। শুরু থেকেই আমরা বিপাকে। ৩০ হবার আগেই (২৭) চারজন আউট। শুরুর বিপর্যয়ের মাঝেও শহীদ খানিক্ষণ লড়াই করে ৩৭ রানে আউট হলো। তারপর আমি উইকেটে গেলাম। আমি নামলাম সাত নম্বরে।’
প্রথম ওয়ানডে ডেলিভারি মোকাবিলার গল্প করতে গিয়ে সুরু অকপটে স্বীকার করলেন ওয়াসিম আকরামের সেই এক্সপ্রেস ডেলিভারি তাকে কিছু না বোঝার সুযোগ দিয়েই চলে গিয়েছিল উইকেটের পিছনে।
‘আমার মনে আছে আমি প্রথম ফেস করেছিলাম ওয়াসিম আকরামকে। তখনকার উদ্যমী যুবা ওয়াসিম আকরাম। ফুল রানআপে বল করতে ছুটে আসলেন। আমি গার্ড নিয়ে দাঁড়ালাম। প্রথম বল অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে আমি ডিফেন্স করার জন্য ব্যাট পাতলাম। হঠাৎ দেখি ধপ করে শব্দ হলো। বল আমার ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল কিপার অনিল দালপাত (আসলে জুলকারনাইনের গ্লাভসে)। সত্যি বলতে কি, আমি ওয়াসিম আকরামের গতির কাছে পরাস্ত হয়েছিলাম। আমার ব্যাট আসার আগেই বল ফাঁকি দিয়ে চলে গেল পিছনে। আমি বা আমরা হয়ত রান করতে পারিনি, ১০০’র নিচে অলআউট হয়েছি। তারপরও আমার আর রফিক ভাইয়ের (রফিকুল আলম) পার্টনারশিপ হলো একটা ছোট্ট।’
‘এরপর ওয়াসিম আকরামকে খেললাম আরও কয়েকবার। তার প্রচন্ড গতি আর সুইংয়ের মুখে আবারও পরাস্ত হলাম। এরপর শেষ বলে মনে হয় ব্যাটের বাইরের কোনায় লেগে থার্ডম্যানে গেল বল। ওভার শেষ হবার সময় দেখলাম ইমরান খান উর্দুতে বললেন, ‘হুয়া’?
‘আমি ভাবলাম কী আবার হলো? পরে জানলাম অধিনায়ক ইমরান চাচ্ছিলেন, ওয়াসিম অকরাম ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য বল অফ স্ট্যাস্পের বাইরে থেকে ভেতরে আনেন। তাই অধিনায়ক ইমরান জিজ্ঞেস করেছিলেন সেটা কি হয়েছে?’
এরপর অধিনায়ক ইমরান বোলিংয়ে আনলেন আব্দুল কাদিরকে। লেগস্পিন গুগলি বোলার আব্দুল কাদিরের প্রথম বল ফেস করে একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুরুর। তার ভাষায়, ‘সেই প্রথম জানা হলো যে, স্পিনারদের বল বাতাসে থাকার সময় লাটিমের মত শব্দ হয়। কাদিরের বল বাতাসে থাকতেই একটা শব্দ হলো। এরপর ৮৯ সালে আমি যখন বিমানে খেলি তখন সেই স্পিনারের বল বাতাসে থাকা অবস্থায় আওয়াজ শুনি। বোলার ছিলেন আমাদের দেশের বাঁ-হাতি চায়নাম্যান বোলার লিন্টু ভাই (নজরুল কাদের লিন্টু)।’
‘কাদির প্রথম বল ছুঁড়লেন অফ মিডলে। লেগ ব্রেক ডেলিভারি। টার্ন করে আমার ব্যাট ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ওপারে। পরের বলেও আমি বিট হলাম। ব্যাটে বলে করতে পারলাম না। যা হোক এরপর কাদির আমাকে একটু বাড়তি ফ্লাইট দিলেন, বলতে পারেন আমন্ত্রণ জানালেন ড্রাইভ খেলতে। প্রায় ওভার পিচ ধরনের ডেলিভারি আমি পিছনের পায়ের ওপর ভর করে কভার দিয়ে চালালাম। বল কভার বাউন্ডারির ওপারে চলে গেল। স্লিপ থেকে মিয়াঁদাদ বললেন, ‘ইয়ে কোন হ্যায়?’
‘পরে কাদিরেরই ঝুলিয়ে দেয়া বলেই অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হলাম। বল ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে জমা পড়লো কিপারের গ্লাভসে। এরপর আমরা ৯৪’তে অলআউট হয়ে গেলাম।’
এত কম রান নিয়ে পাকিস্তানের সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। তবু জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ দুই উইকেটের পতন ঘটালে ওই সামান্য কটা রানের ছোট্ট পুঁজি নিয়েও পাকিস্তানের ৩ উইকেটের পতন ঘটাতে সমর্থ হয় লিপুর বাংলাদেশ।
বোলিং-ফিল্ডিংয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে সুরু জানান, বাঁ-হাতি প্রিন্সের বলে শুরুতেই ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন তখনকার সময়ে পাকিস্তানের এক নম্বর ওপেনার মহসিন খান। সেই ক্যাচ ড্রপ করেছিলেন সুরু নিজেই। সে কথা জানিয়ে সুরু বলেন, ‘আমি প্রিন্সের বলে ক্যাচ মিস করলাম। খুব সম্ভবত প্রথম বা দ্বিতীয় ওভারেই। মহসিন খানের ক্যাচ ছিল সেটা। আমি পয়েন্টে দাড়িয়ে তা ধরেও ফেলে দেই।’
টাফ ক্যাচ ছিল কী? ‘আমি কী করে ক্যাচটি ধরতে পারলাম না, কে জানে? সহজ ক্যাচ ছিল। আমার বাঁদিকে মাথা ও কাঁধ সমান উচ্চতায় ছিল বল। বল একটু কেটে আসছিল এই যা। হয়তোবা প্রথম ওয়ানডে নার্ভাসনেস-এর কারণে ক্যাচটি পড়ে যায়।’
ওই ম্যাচের বর্ণনা দিতে গিয়ে দুটি ঘটনা বললেন সুরু। জানালেন, সামি ভাইয়ের আউট সুইং সব সময়ই দারুণ। তার আউটসুইংয়ে পরপর দুই বলে অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে বিট হলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। থার্ডম্যান থেকে বাদশাহ চেঁচিয়ে অধিনায়কের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘লিপু, সামিকে বলো যেন মোচে তা না দেয়। সামি ভাইয়ের অভ্যাস ছিল, একটু ভাল কিছু করলেই গোফে হাত দেয়ার। বাদশাহ ভাই নোটিশ করার পরও সামি ভাই মিয়াঁদাদের সামনে গিয়ে গোফে তা দিলেন। আর ঠিক তার পরের বলেই মিয়াদাদ ঠিক পয়েন্ট দিয়ে কাট করে বাউন্ডারি হাঁকালেন। কব্জির পাঞ্চ কি দেখলাম! বাদশাহ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন আমি আগেই বলছিলাম গোফে তা দিস না। ব্যাটসম্যানটি আর কেউ না জাভেদ মিয়াঁদাদ।’
সকালের আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। ইমরান খান আর ওয়াসিম আকরামের প্রচন্ড গতির বলে রকিবুল ভাইয়ের (রকিবুল হাসান) প্যাডে গিয়ে আঘাত হানলো। তা দেখে স্লিপ থেকে মুদাসসার নজর না কে যেন রকিবুল ভাইকে রসিকতা করে বললেন, ‘আপনি কী ব্যাট দিয়ে খেলেন? না পা দিয়ে খেলতে নেমেছেন? তখন মুহূর্তের মধ্যে জাভেদ মিয়াঁদাদ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, কাকে কি বলো? ভদ্রলোক তোমার বাবার বয়সী। শ্রদ্ধা দেখাও। তোমার বাবার সাথে খেলেছেন।’
ওই মন্তব্যই বলে দিল সিনিয়রদের প্রতি মিয়াঁদাদের একটা অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তিনি রকিবুল ভাই আর বাদশাহ ভাইকে আগে থেকে চিনতেন। একটা অন্যরকম শ্রদ্ধাও ছিল তার মধ্যে।
এআরবি/আইএইচএস/জিকেএস