‘ওয়াসিম আকরামের প্রথম বলেই হুক করে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলাম’
‘যে ব্যাটসম্যান ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার বোলিংয়ের বিপক্ষে একদম স্বচ্ছন্দে চল্লিশের ঘরে পৌঁছে যেতে পারেন, তার ওয়ানডে ফিফটি পেতে কেন ২৫ ম্যাচ লাগবে? তারও বহু আগেই ওয়ানডে ফিফটি পাওয়া উচিৎ ছিল নান্নুর।’
নান্নুর তথা বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর মুখে এই আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছে বহুবার। সত্যিই তাই । ভাগ্য সহায় থাকলে হয়ত ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রথম ওয়ানডে ফিফটির দেখা পেয়ে যেতেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।
দিনটি ছিল ১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিল। শ্রীলঙ্কার মোরাতোয়ায় দুই লঙ্কান ফাস্ট বোলার অশান্ত ডি মেল আর রবি রত্নায়েকে এবং স্পিনার ডন অনুরাসরিরির ধারালো লঙ্কান বোলিং শক্তির বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে খেলে চল্লিশের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। হয়ত সেই ম্যাচেই পৌঁছে যেতে পারতেন পঞ্চাশের ঘরে। তাহলে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে ফিফটির মালিকও বনে যেতে পারতেন তিনি।
কিন্তু তা আর হয়নি। ৬৩ বলে ৪০ রান করে ফিরে এসেছিলেন সাজঘরে। এরপর ওয়ানডে ফিফটি পেতে লেগেছে অনেকদিন। অনেকদিন শুনে হয়ত ভাবছেন কয়েক মাস কিংবা এক দুই বছর। আসলে তা নয়, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব কষলে প্রথম হাফ সেঞ্চুরির জন্য নান্নুকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৩ বছরের বেশি, ১৫৭ মাস। খেলতে হয়েছে আরও ২৩টি ম্যাচ।
আসলে তখন অনেক দিন পরপর ওয়ানডে খেলার সুযোগ মিলতো বাংলাদেশের। এখন তো টাইগাররা বছরে ১০-১২টি (কখনো কখনো ১৫-২০টিও হয়) ওয়ানডে খেলে ফেলেন। কিন্তু তখন মানে ৮০ ও ৯০’ দশকে বছরে এক বা দুই কখনো বা একটিও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের। তাইতো ১৩ বছরে ক্যারিয়ারে নান্নুর ওয়ানডে ম্যাচ মোটে ২৭টি।
১৯৯৯ সালের ২৪ মে এডিনবরায় বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৮ রান করার পর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক পূর্ণ হয় নান্নুর। সেটা ছিল তার ক্যারিয়ারের ২৫ নম্বর ম্যাচ। সেই দ্বিতীয় ম্যাচে ফিফটি না পাবার আক্ষেপ এখনো নান্নুকে পোড়ায়।
এখনো মনে হলে একটা অন্যরকম অনুশোচনায় দগ্ধ হয় মন। জাগো নিউজের সাথে সেই ১৯৮৬ সালে প্রথম ওয়ানডে খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রথমেই দ্বিতীয় ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে আনেন নান্নু।
যার পরতে পরতে ছিল আক্ষেপ, ‘জানেন, আমি ট্রিমেন্ডাস ব্যাটিং করছিলাম। একটুও দ্বিধা, সংশয় ছিল না। একদম সাবলীল খেলছিলাম। যে বল যেখানে খেলতে চেয়েছি, তাই খেলতে পারছিলাম; কিন্তু চল্লিশে পৌঁছেই আউট হয়ে গেলাম।’
ডি মেল, রবি রত্নায়েকের নাকি স্পিন ডন অনুরাসিরির কোন ভাল ডেলিভারিতে? নান্নুর জবাব, ‘আরে না না। আনপ্লেয়েবেল ডেলিভারিতে কিংবা দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হলে একটুও আফসোস থাকতো না। আমিতো রান আউট হয়েছিলাম।’
ক্রিকইনফো স্কোর কার্ড সে সাক্ষীই দিচ্ছে। কিভাবে হয়েছিলেন রান আউট, মনে আছে? ‘হ্যাঁ, খুব মনে আছে। তা কি ভোলার? আমার ভিতরে তখন ফার্স্ট ওয়ানডে ফিফটির স্বপ্ন। আমি চল্লিশে পৌঁছেই মিড অফে ঠেলে সিঙ্গেলস নেয়ার জন্য দৌড়ে অন্যপ্রান্তে ছুটে আসি। ননস্ট্রাইকে ছিলেন রফিক ভাই (রফিকুল আলম); কিন্তু তিনি আর নড়েননি। একদম জায়গায় স্থির দাঁড়িয়েই ছিলেন। নিজের কল বলে বলছি না, ওটা অনায়াসে সিঙ্গেলস হয়ে যায়। রফিক ভাই দৌড়ালেই হয়ে যেত। আমিতো ডেঞ্জার জোনে ছিলাম। ব্যাটিং এন্ড থেকে দৌড়ে বোলিং এন্ডের প্রায় বেশিরভাগ চলে এসেছিলাম। এসে দেখি রফিক ভাই তখনো দাঁড়িয়ে! পরে আবার ফেরার চেষ্টা করেছিলাম। তা আর হয়নি। রান আউট হয়েই ফিরতে হলো ড্রেসিং রুমে।
সেতো গেল দ্বিতীয় ওয়ানডের দুঃখস্মৃতি। প্রথম ফিফটির সম্ভাবনা জাগিয়েও না পাওয়ার বেদনার স্মৃতি, প্রথম ওয়ানডের কথা মনে আছে? ‘হ্যাঁ, খুব আছে। আমার প্রথম ওয়ানডেরও এক দারুণ স্মৃতি আছে। রান করতে পারিনি তেমন; কিন্তু ইমরান খান, ওয়াসিম আকরামের মত বিশ্বমানের ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে বেশ সাহস আর আস্থার সাথেই শুরু করেছিলাম।’
‘এখনো মনে আছে আমি উইকেটে গিয়ে ওয়াসিম আকরামের প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলাম।’
সে বাউন্ডারি হাঁকানোর বর্ননা দিয়ে নান্নু বলেন, ‘আমার তথা আমাদের টিম বাংলাদেশের সেটা ছিল প্রথম ওয়ানডে। আমার উইকেটে গিয়ে প্রথম মোকাবিলা করতে হলো ওয়াসিম আকরামকে। খুব আর্লি দুই-তিন উইকেট হারিয়ে আমরা তখন বেশ চাপে। আমাকে দেখেই ওয়াসিম আকরাম বাউন্সার ছুঁড়লেন। উদ্দেশ্য আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে দেয়া। বিশ্বাস করুন, আমি এতটুকু ভয় না পেয়ে সাহস ও আস্থায় হুক করলাম। চোখের নিমিষে স্কোয়ার লেগ দিয়ে বল চলে গেল সীমানার ওপারে। তবে সেই বাউন্সারে হুক করাই যে আমার কাল হবে, তা বুঝিনি।’
কি ভাবে? ‘বাউন্সার দিয়ে বাউন্ডারি হজম করা ওয়াসিম আকরামের জেদ চেপে গিয়েছিল আরও। আবারও বাউন্সার ছুঁড়ে আমাকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করলেন। আমি আর পরের বার সে বাউন্সার মোকাবিলায় সফল হইনি। ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে বল চলে গিয়েছিল উইকেটের পিছনে। আমি শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে ফিরে এসেছিলাম।’
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এক নিঃশ্বাসে প্রথম ওয়ানডেতে আউট হওয়ার গল্প শোনালেন দেশের ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সেরা উইলোবাজ নান্নু।
প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলার অনুভুতিটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে নান্নু বলেন, ‘আমি ওয়ানডে খেলার আগেই জাতীয় দলের সাথে কেনিয়া ও পশ্চিম বঙ্গ সফর করেছিলাম। খেলেওছি প্রায় সব ম্যাচ। তারপরও প্রথম ওয়ানডে বলে কথা। বুঝতেই পারেন, প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ, তাও পাকিস্তানের মত দলের বিপক্ষে, যে দলে ইমরান খান, জাভেদ মিয়াদাদ আর ওয়াসিম আকরামের মত বিশ্ব তারকারা। পাকিস্তানের ওই দলটি ‘হল অফ ফেমে’ রাখার মত। তার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ, ভিতরে সর্বোচ্চ উত্তেজনা। শিহরণ। রোমাঞ্চ। পুলক। এক বিরাট ব্যাপার ছিল।’
নান্নু যোগ করেন, ‘ওই টুর্নামেন্ট খেলার আগে সে অর্থে জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্প হয়নি।’ ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে তখন নান্নু খেলেন আবাহনীতে। আমরা ঢাকা লিগ খেলে গিয়েছিলাম এশিয়া কাপ খেলতে।’
সেই দলে তার বড় ভাই নুরুল আবেদিন নোবেলও ছিলেন। দুই ভাই খেলেছেন দেশের অভিষেক ওয়ানডেতে। সে স্মৃতিচারণ করে নান্নু বলেন, ‘আমি তখন আবাহনীতে খেলি। তখনো মোহোমেডানে যোগ দেইনি। এর পরের বছর মোহামেডানে প্রথম খেলি। আর নোবেল মনে হয় সুর্যতরুণে।’
প্রথম এশিয়া কাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নামী ক্রিকেটারদের সান্নিধ্য পাওয়ার কথাও ভোলেননি নান্নু। তার ভাষায়, ‘আমরা যাদের খেলা টিভিতে দেখেছি, তাদের সাথে প্রথমবার একই হোটেলে থাকা, বিপক্ষ দলে খেলা, খেলার বাইরে একসঙ্গে সময় কাটানো- সবই অন্যরকম ভাললাগার। সব অভিজ্ঞতাই প্রথম ও নতুন।’
‘অনেক ক্রিকেটারের সাথেই কথা বার্তা হয়েছে। আমি যেচে জাভেদ মিয়াঁদাদের সাথে কথা বলেছি। জাভেদ মিয়াঁদাদের মত গ্রেট প্লেয়ারের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করতে পেরেছি, সেটাও ছিল খুব ভাল লাগার। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পরামর্শও চেয়েছি। এখনো খুব মনে আছে, জাভেদ মিয়াঁদাদ আমাকে দারুণ একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, শোন নান্নু নিজের টেকনিক-ফেকনিক নিয়ে খুব বেশি ভাববা না। তোমার টেকনিক তোমার কাছে। আসল কাজ হলো জায়গামত ২২ গজে গিয়ে পারফর্ম করা। তুমি যেটা করবা, তাহলো ডর-ভয় পাবা না। বুকে সাহস নিয়ে সব সময় সোজা ব্যাটে খেলার চেষ্টা করবা।’
‘বিশ্বাস করেন মিয়াঁদাদের সেই কথাটি আমি সব সময় মনে রেখেছি। যখন যার বিপক্ষেই খেলতে নেমেছি মিয়াদাদের কথা মনে হলেই ভিতরে ভাল খেলার একটা বাড়তি সাহস সঞ্চার হতো।’
এআরবি/আইএইচএস/এমকেএইচ