‘জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লে ফেরার পথটা মসৃণ নয়’

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:২৭ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২১

সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবাল। সেটা ক্যান্ডি টেস্টেও প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু জানেন কি তামিমের প্রিয় ওপেনিং পার্টনার কে? বিশেষ করে টেস্টে তামিমের সব সময়ের সেরা সঙ্গী কে?

ইমরুল কায়েস। একবার দুবার নয়। বহুবার তামিম বলেছেন সে কথা। ‘ওপেনিংয়ে আমার বেস্ট পার্টনার হলো ইমরুল কায়েস।’

জাগো নিউজের হ্যালো ক্রিকেটারে আজ সোমবার মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবনের অনেক না বলা কথা বলেছেন ইমরুল। ৩০ পার হয়ে জাতীয় দলে ফেরার ভাল কোন প্ল্যাটফর্ম নেই- এ আক্ষেপটা তাকে পোড়ায়। তবু জাতীয় দলে ফেরার আশা ছাড়েননি মেহেরপুরে ৩৩ বছরের এই ক্রিকেটার।

জাগো নিউজ : করোনার ভয়াবহতায় ঘেরা চারপাশ, এর ভেতরে কেমন আছেন আছেন ইমরুল? কোথায় আছেন?

ইমরুল : আল্লাহ রাখছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমতে সুস্থ আছি এখনো পর্যন্ত। পরিবারের সাথে মিরপুরের বাসাতেই অবস্থান করছি।

জাগো নিউজ : জাতীয় দল শ্রীলঙ্কায় টেস্ট খেলছে আর ইমরুল দলের সঙ্গে নেই। দেশে একা কাটছে জীবন। কেমন লাগে ব্যাপারটা? জাতীয় দলকে কতটা মিস করেন?

ইমরুল : ন্যাশনাল টিমকে আমি সব সময়ই খুব মিস করি। যখন দলের সাথে থাকি, তখন হয়ত বুঝি না। বা বোঝা যায় না। তবে যখনই দলের বাইরে থাকি, তখন খুব মনে হয়। আমার লাইফের একটা ডেইলি রুটিন থেকে কি যেন নেই। এমন মনে হয়। ন্যাশনাল টিম থেকে বাদ পড়লে মনে হয় জীবন থেকেই কিছু একটা মিসিং আছে। সত্যি বলতে কি, বলে বোঝাতে পারবো না! খুব খারাপ লাগে।

জাগো নিউজ : এই যে এখন বললেন জাতীয় দলে থাকতে না পারলে খুব খারাপ লাগে, তাহলে ফেরার জন্যও নিশ্চয়ই মনটা আকুল হয়ে থাকে?

ইমরুল : অবশ্যই। জাতীয় দলে খেলা অনেক ভাল লাগার, সর্বোচ্চ সম্মানের। কাজেই জাতীয় দলে খেলতে, থাকতে মন চায় সব সময়। কিন্তু কি করবো? আমাদের সিস্টেমটাই একটু অন্যরকম। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে আবার দলে ফেরার পথটা খুব মসৃণ না।

জাগো নিউজ : মসৃণ নয় বলতে কি বোঝালেন, জাতীয় দলে ফেরার পথটা সড়। একটু ভেঙ্গে বলবেন কী?

ইমরুল : আমার কাছে মনে হয় আমাদের ন্যাশনাল টিম থেকে যারা বাদ পড়ে বা বাদ যায়, তারা কী করলে আবার ফিরবে? বা তাদের ফেরানোর পথ কী হবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, তা তেমন ঠিক করা নেই। তাদের কোন প্লাটফর্ম নেই।

অথচ পৃথিবীর সব টেস্ট খেলুড়ে দেশে যারা একটু পরিণত বয়সের পারফরমাররা জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লে তাদের ‘এ’ টিমে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘এ’ টিমটা থাকে অনেক শক্তিশালী। সেখানেও পরিণত এবং উঠতি প্লেয়ারদের মধ্যে একটা মধুর প্রতিযোগিতা থাকে।

সেখানেই ট্রেনিং চলে। সমস্যা কী? কে কোন কারণে বাদ পড়েছে? কারো ফর্ম খারাপ, কেউবা ফিটনেস প্রবলেমে, আবার কারো হয় টেকনিকে সমস্যা, সেগুলো শুধরে দেয়ার একটা প্লাটফর্ম থাকে। ‘এ’ টিমের কোচিং স্টাফরা তাদের নিয়েই কাজ করেন। ‘এ’ টিমের নিয়মিত খেলা হয়। ট্যুর আয়োজন করা হয় এবং দেখা যায় ওই ‘এ’ টিম খেলার মধ্যেই থাকে।

দেশে-বিদেশে কারো না কারো সাথে খেলছেই। আর তাতেই এর মধ্য দিয়ে ওই বাদ পড়া ক্রিকেটাররা আবার জাতীয় দলে ফেরার পথ খুঁজে পান। কিন্তু আমাদের দেশে ওসব নেই। ন্যাশনাল টিমের মত ‘এ’ দলেরও একটা প্লাটফর্ম তৈরি করা উচিৎ।

আমাদের বাদ পড়াদের জাতীয় দলে ফেরার মানদন্ড এখনো ঘুরে ফিরে ঘরোয়া ক্রিকেট। সেটাওতো নিয়মিত হয় না। এ দল থাকলে আমরা যারা বাইরে আছি তাদের ফেরার এবং নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়। কারণ এটাতো সত্যি যে, আমাদের তো আর ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার কিছু নেই। আমরা তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরীক্ষিত পারফরমার।

আমার মত আরও কয়েকজন আছে যারা জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাল পারফর্ম করেছে। এখন আমাদের আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল করে জাতীয় দলে ফেরানোর চেয়ে যদি ‘এ’ দলের হয়ে খেলার সুযোগ করে দিলে নিজেকে ফিরে পেতে সহজ হয়।

কিন্তু সেই আমাকে যখন ডমিস্টিকে পারফরম করে আবার জাতীয় দলে ঢুকতে বলা হয়, তখন একটা অন্যরকম জটিলতা তৈরি হয়।

জাগো নিউজ : সেটা কী রকম, কেমন জটিলতা?

ইমরুল : ধরেন আমি জাতীয় দল থেকে এখন বাদ পড়ে বাইরে আছি। আমাকে বলা হলো, ডমিস্টিকে ভাল খেললে তবেই আবার জাতীয় দলে ডাক মিলবে। আমিও সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে জাতীয় লিগ, বিসিএল, প্রিমিয়ার লিগে ভাল খেললাম। প্রচুর রান-টান করলাম। কিন্তু তারপরও যে জাতীয় দলে ফিরতে পারবো, সে গ্যারান্টি নেই।

জাগো নিউজ : কেন গ্যরান্টি নেই?

ইমরুল : কারণ হলো আমার পজিশনে দেখা গেল এক তরুণ সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যানও রান করলো। তখন ভিনদেশি কোচরা ইনপুট দেন, আরে ও ইয়াং আছে। ওকে বিবেচনায় আনা হোক। আর এভাবেই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া পরিণত ক্রিকেটাররা ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যায়। এজন্যই বললাম যে ‘এ’ টিমটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘এ’ টিম থাকলে সেখানে ভাল খেলতে পারলে আবার মূল দলে ফেরাটা সহজ হয়।

জাগো নিউজ : কিন্তু আপনার মত যাদের বয়স ৩০ প্লাস, তাদের জাতীয় দলে ফেরা তো কঠিন। অতীতে দেখা গেছে তুষার ইমরান, শাহরিয়ার নাফীস, অলক কাপালি ও নাঈম ইসলামরাও ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর রান করেও পারেননি। তাহলে আপনার জাতীয় দলে ফেরা কী সত্যিও খুব সহজ হবে মনে করেন?

ইমরুল : আমি এ প্রশ্নের উত্তরটা একটু ভিন্নভাবে দিতে চাই। আমি একবার ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে গিয়ে বিশ্বের সব সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ভিভ রিচার্ডস-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্যার! একজন ক্রিকেটারের বিশেষ করে ব্যাটসম্যানের জন্য পারফর্ম করার বেস্ট টাইম কখন? তখন তিনি একটি দারুণ তাৎপর্য্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন।

বলেছিলেন, শোন! ৩০ বছর বয়স হলো একজন ব্যাটসম্যানের পরিপূর্ণ হবার বয়স। আফটার থার্টি হলো তোমার পারফর্ম করার বেস্ট টাইম। এরপর তুমি কত বছর খেলতে পারবা- ৫, ৬, ৭ নাকি ৮ বছর? সেটা তোমার ওপর। তবে তোমার পরিপূর্ণতা আসবে তিরিশে। তিরিশের পরে গিয়ে তুমি সব কিছু ঠিকমত বুঝবা, জানবা। দায়িত্ব, কর্তব্য সব কিছু পরিষ্কার হবে। তোমার ব্যাটিংয়েই পরিপক্কতা চলে আসবে। তার আগে অনেক কিছুই বুঝবা না।

কথাটা আমার মাথায় আছে। স্যার ভিভ রিচার্ডসের মত বড় মাপের একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব যখন এমন কথা বলেছেন, সেটা তো আর এমনি এমনি বলেননি। এখন আমিও বুঝি উনি যথার্থই বলেছেন। খেলাটা আসলে কিভাবে খেলতে হয়? এক সময় খেলে ফেলেছি। কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতাম না। এখন ৩০ পেরিয়ে বুঝি।

জাগো নিউজ : কিন্তু বাংলাদেশে তো জাতীয় দলের বাইরে ছিটকে পড়লে ৩০ অনেক বয়স ধরা হয়...।

ইমরুল : কী আর বলবো? এটা আমাদের কালচারে সমস্যা। যেহেতু আমাদের বাঁধা ধরা কোন প্লাটফর্ম নেই। সিস্টেমটাও খুব গোছালো না। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিনদেশি কোচরা এসে নানা ওপিনিয়ন দেন। আমাদের আরও একটু প্ল্যানিং করা উচিৎ।

এটা সত্য যে বোর্ডও কিন্তু আমাদের সবার জন্য অর্থ ইনভেস্ট করেছে। বোর্ডের এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ, আমরা যাদের পিছনে ট্রেনিং ও অন্য খাতে ইনভেস্ট করেছি, তাদের কাছ থেকে তার রিটার্ন নেয়া দরকার। তাই তিরিশের পর ক্রিকেটারদের বাদ না দিয়ে তাদের কিভাবে আবার দলে ফেরানো যায়, তাদের সার্ভিস কী করে পাওয়া যায়, সে চেষ্টাই করা দরকার। আমিও তো ১২ বছরের বেশি জাতীয় দলে খেলেছি। বোর্ডের বেতন, ভাতা থেকে শুরু করে অর্থ পেয়েছি। আমারও তো রিটার্ন দেয়ার আছে আরও কিছু।

জাগো নিউজ : তাহলে কী প্রায় মধ্য তিরিশে দাঁড়িয়েও আপনি আবার জাতীয় দলে ফেরার আশা করছেন?

ইমরুল : অবশ্যই। আমার স্বপ্ন, আমার আশা- আবার জাতীয় দলে ফিরবো ইনশাল্লাহ।

জাগো : আপনার জীবনের দুটি স্মরণীয় ম্যাচ ও সুখ স্মৃতিচারণ করুন!

ইমরুল : অবশ্যই ২০১৫ সালে খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। ওই টেস্টে প্রায় ৩০০ রানে (২৯৬) পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তামিম ইকবালের সাথে ওপেনিংয়ে নেমে ৩০৫ রানের জুটি গড়ার স্মৃতিটাই সবচেয়ে বড়।

জাগো নিউজ : এর বাইরে আর কোন ম্যাচ?

ইমরুল : হ্যাঁ, ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দুটি ম্যাচে ম্যন অফ দ্য ম্যাচ হবার ঘটনা দুটিও দারু স্মরণীয়। বিশ্বকাপের বড় পর্দায় এক আসরে দুই ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরষ্কার পাওয়াটা অনেক বড় কৃতিত্ব। অনেক বড় অর্জন। সেটা শুধু আমার মনের মনি কোঠায়ই থাকবে না। ইতিহাসের পাতায়ও লিখা আছে স্বর্ণাক্ষরে। থাকবে আজীবন। বাংলাদেশের ক্রিকেট যতদিন থাকবে আমার ওই সাফল্যগাঁথাও ততদিন জাগরুক থাকবে।

জাগো নিউজ : শ্রীলঙ্কায় জাতীয় দল খেলছে। আপনি নেই কেমন লাগছে?

ইমরুল : দেশে হোক আর বাইরে হোক জাতীয় দলের বাইরে থাকলে খারাপ লাগে।

জাগো : ক্যান্ডিতে প্রথম টেস্ট দেখেছেন, কেমন খেলেছে মুমিনুল বাহিনী?

ইমরুল : ভাল খেলেছে। বিশেষ করে ব্যাটিংটা বেশ ভাল হয়েছে। ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবাই ভাল খেলে রান করেছে। আর বোলিংটাও যে খুব খারাপ হয়েছে তা বলবো না। যে টেস্টে দুই দলের প্রথম ইনিংসে এক হাজারের বেশি রান ওঠে, সেখানে আসলে বোলারদের কিছু করারও থাকে না।

সাইফের কথা বলবো না। কারণ ও খুব অল্প সময়েই আউট হয়ে গেছে। যারা সেট হয়েছে তার সবাই প্রায় রান করেছে। এটা খুবই ভাল লেগেছে। তামিম, শান্ত, মুমিনুল, মুশফিক, লিটন সবাই খুব ভাল ব্যাটিং করেছে।

তবে আমি তামিমের কথা বিশেষভাবে বলবো। তামিম শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ঢংয়ে স্বচ্ছন্দে খেলে লঙ্কান বোলারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাতে করে অন্যদের সাবলীল খেলাটা সহজ হয়েছে। লঙ্কান বোলাররা আর চেপে বসতে পারেনি। তামিম যদি দুই ইনিংসেই নিজের মত করে অ্যাটাকিং রোল প্লে করতে না পারতো, তাহলে দৃশ্যপট ভিন্ন হতে পারতো।

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।