‘হাল ছাড়ছি না, বিশ্বাস আছে ক্যামব্যাক করবো’

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৫:২৬ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২১

শফিউল নিজেকে খানিক দূর্ভাগা ভাবতেই পারেন। মাশরাফির মত হয়তো ৭-৮ বার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়নি; কিন্তু বারবার তার ক্যারিয়ারে ইনজুরি এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছর কেটেছে একদম নির্বিঘ্নে।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে ওয়ানডে অভিষেকের পর ২০১৩ সালের মে মাসে জিম্বাবুয়ে সফর পর্যন্ত ইনজুরি ছাড়া শফিউল চার বছরে ৪৯টি ওয়ানডে খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে; কিন্তু ২১০৪ সাল থেকেই ইনজুরির ভয়াল থাবা এসে গ্রাস করে। এরপর থেকে ইনজুরির কারণে দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন দেশের অন্যতম সুইং বোলার শফিউল ইসলাম।

গত বছর জুলাইয়ের পর থেকে কোমরের ডিস্কে ব্যাথাটা আবার মাথাচাড়া দেয়ায় আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা হয়নি। মাঝে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে তিন ম্যাচ খেলে আবার ব্যাথা পেয়ে এখন মাঠে ফেরার লড়াই-সংগ্রামে ব্যস্ত শফিউল।

এসব নিয়েই আজ জাগো নিউজের মুখোমুখি হলেন জাতীয় দলের পেসার শফিউল ইসলাম...

জাগো নিউজ : হ্যালো শফিউল, কেমন আছেন? কোথায় আছেন, বগুড়া না ঢাকায়? কী করছেন এই সময়ে?

শফিউল : আছি আল্লাহর রহমতে। এই করোনার মধ্যেও আল্লাহ সুস্থ রেখেছেন। সৃষ্টিকর্তার অনেক কৃতজ্ঞতা। নাহ! বগুড়ায় না, ঢাকার মিরপুরের বাসাতেই আছি।

তবে ইনজুরি পিছু ছাড়ছে না ভাই। আমার সেই পুরনো ব্যাকপেইনটা আবার কয়েক মাস ধরে মাথা চাড়া দিয়েছে। তাই ওই ইনকজুরি নিয়ে বেকায়দায় আছি।

জাগো নিউজ : সেটা কবে থেকে? একটু খুলে বলবেন কী?

শফিউল : আসলে জানেন বোধ হয়, আমার একটা পুরনো ব্যাক ইনজুরি আছে। সেটাই নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরেই ভুগছি। চেষ্টা করছি। চিকিৎসার জন্য ভারতেও গিয়েছি। লকডাউন না হলে হয়ত আবার ভারতে গিয়ে দেখিয়ে আসতাম।

জাগো নিউজ : কবে থেকে কোমরের ব্যথা শুরু হলো? একটু খুলে বলবেন?

শফিউল : আসলে এবারের কোমর ব্যাথাটা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগেই। গত বছর যখন করোনার কারণে সব বন্ধ, তখন তো প্রথম দিকে সবাই কম বেশি বাসায় হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করেছে। আমিও তাই করেছি। তারপর এক সময় শেরে বাংলায় আমাদের সহযোগি ক্রিকেটারদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুশীলন শুরু করেছিল। আমিও তাতে যোগ দিয়েছি। কিছুদিন হালকা ফিজিক্যাল ট্রেনিং করেছি। তারপর আর সবার সাথে শেরে বাংলায় প্রথমে একা একা, পরে গ্রুপ করে ফিজিক্যাল ট্রেনিং, জিমওয়ার্ক আর নেটে বোলিং প্র্যাকটিস করেছি।

ঠিক তখনই সমস্যাটা প্রবল হয়েছে। এর পর ছিল শ্রীলঙ্কা সফর। সবাই তেড়েফুঁড়ে চেষ্টা করেছে নিজেকে ঘসে-মেজে তৈরি করতে। আমিও ওই সময় নিজেকে নিংড়ে দিয়েছি। আসলে তখনতো আর কোন ফিজিও, ট্রেনার সাথে ছিলেন না। আমি আমার মতই যা পেরেছি করেছি।

এক সময় চার-পাঁচ জনের গ্রুপ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা ক্রমাগত ব্যাটসম্যানদের নেটে বোলিং করেছি। হয়ত ওই ওয়ার্কলোডটাই বেশি পড়ে গিয়েছিল। আমি আর পেসার আল আমিন, রিয়াদ ভাই ও আর কয়েকজন ব্যাটসম্যানকে বল করেছি।

সত্যি বলতে কী, আমি জানতাম হয়ত আমাকে টেস্ট দলে (তখন শ্রীলঙ্কা সফরকে সামনে রেখেই ট্রেনিং করতো সবাই) নিবে না। তবু প্রাণপন চেষ্টা করেছি। দেখি না যদি ভাল করি, চান্স পেতেও পারি। এ ভেবেই ওই সময় হার্ড ট্রেনিং করেছি। তখনই আসলে কোমরের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে ব্যথা শুরু হয়। আমার আগেই কোমড়ের ডিস্কে ব্যথা শুরু হয়।

জাগো নিউজ : তারপর কী হলো?

শফিউল : তারপর এমআরআই করালাম। ডিস্কে প্রবলেম ধরা পড়লো। পরে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করালাম। এরপর ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ‘প্রেসিডেন্টস কাপ’ খেলতে পারিনি। তবে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের প্রথম দুটি ম্যাচ ভালমতই খেলতে পেরেছিলাম। আবার তৃতীয় ম্যাচে গিয়ে লেগে গেল। সেটাই চলছে এখনো। হ্যাঁ, ভারতে গিয়ে ইনজেকশন দিয়ে এসেছি। ইমপ্রুভ হয়েছে। তবে পুরোপুরি কমেনি। মাঠে নামার মত অবস্থা হয়নি এখনো।

জাগো নিউজ : ভারতে কবে গিয়েছিলেন ইনজেকশন নিতে?

শফিউল : এ বছর জানুয়ারিতে গিয়েছিলাম, কলকাতায়।

জাগো নিউজ : মাঠে ফিরতে আর কতদিন লাগতে পারে?

শফিউল : আসলে হয়ত লকডাউন না হলে ট্রিটমেন্টটা আরও ভালভাবে করাতে পারতাম। কারণ আমি আবারও ইন্ডিয়া যাব। ডাক্তার দেখাবো। তারপর বলা যাবে। তবে এখন মনে হচ্ছে অন্তত এক মাসের আগে না।

জাগো নিউজ : শ্রীলঙ্কায় টেস্ট দলে না হোক নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি দলে থাকার আশায় ছিলেন নিশ্চয়ই?

শফিউল : হ্যাঁ, সত্যি বলতে কি আমারও তেমন আশা ছিল। কারণ আল্লাহর রহমতে সাদা বলে ভালই করছিলাম। মোটামুটি একটা বিশ্বাস ও আস্থা ছিল হয়তো বা যাব; কিন্তু কী আর করা ইনজুরির কারণে আর যাওয়া হলো না।

জাগো নিউজ : আচ্ছা ইনজুরি আপনার ক্যারিয়ারে বারবার বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। ফর্মে থাকতেও অনেক ম্যাচ, সিরিজ খেলা হয়নি। আপনি কী নিজেকে খানিক দুর্ভাগা ভাবেন?

শফিউল : হ্যাঁ, ইনজুরি আমার পিছু ছাড়ে না। প্রথম কয়েক বছর না হলে ২০১৩ সালের পর থেকে ইনজুরি লেগেই আছে। ২০১০ সালে ক্যারিয়ার শুরুর পর প্রথম তিন বছর ভালই কেটেছে। তখন এতই ভাল ছিলাম যে, যা করতে চেয়েছি, পেরেছি। সব ইচ্ছেমত হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ থেকে শুরু হয়েছে ইনজুরির ভয়াল থাবা। তারপর থেকে একের পর এক ইনজুরি এসে ভর করেছে। আমার ক্যারিয়ারে ইনজুরির নেতিবাচক প্রভাব কতটা শুনবেন?

জাগো নিউজ : কতটা?

শফিউল : আসলে অনেকটাই ইনজুরি ভুগিয়েছে আমাকে। কি আর বলবো, গোড়ালিতেই আঘাত পেয়েছি চারবার। বিভিন্ন সময় দু’পায়ের অ্যাঙ্কেল ‘টুইস্ট’ হয়েছে ৪ বার। এছাড়া সাইড স্ট্রেইন হয়েছে একাধিকবার।

জাগো নিউজ : আপনার কী মনে হয় না, ক্যারিয়ার যতটা উজ্জ্বল ও সফল হবার কথা ছিল, শুধু মাত্র ইনজুরির কারণে তা হয়নি।

শফিউল : আমিও তা মনে করি। তার একটা প্রমাণ দেই। তাহলো আমার ক্যারিয়ারের বয়স ১১-তে এসে ঠেকেছে। আর আমি মোট ওয়ানডে খেলেছি ৬০টি। এর মধ্যে প্রথম তিন বছরেই আমার ম্যাচ ছিল ৪৪ থেকে ৪৫টি (আসলে ৪৯টি)। অথচ দেখেন সেই ২০১৪ সালে ইনজুরির শিকার হবার পর থেকে পরের সাত-আট বছরে আমি সাকুল্যে ১৫-১৬টি ম্যাচ খেলেছি (প্রকৃত তথ্য হচ্ছে ১১টি মাত্র)। এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে। এমন নয় পরের সাত বছর আমার ফর্ম ভাল ছিল না, আমি খারাপ খেলেছি, তাই আমাকে নেয়া হয়নি বা নিলেও খেলানো হয়নি।

আমার জানামতে আমি ২০১০ সালে অভিষেকের পর থেকে কখনো পারফরমেন্সের কারণে বাদ পড়িনি। গত সাত আট বছরে যতবার বাদ পড়েছি, সেটা ইনজুরির কারণে। আমি ইনজুরিতে পড়ে আবার দলে ফিরেছি। আবার ইনজুরির শিকার হয়ে বাইরে ছিটকে পড়েছি। আবার ব্যাক করেছি। আবার নিজেকে প্রুভ করেই আসতে হয়েছে দলে।

জাগো নিউজ : আপনার ক্যারিয়ারের কোন ইনজুরিটা বেশি ভুগিয়েছে?

শফিউল : আসলে অ্যাঙ্কেল টুইস্টই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। ইনজুরিটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কিইবা করার আছে বলুন! কপালে আল্লাহ যেটা লিখে রেখেছেন সেটাই হয়েছে। আমি তাই খুব বেশি হতাশ হইনি। ধরে নিয়েছি এটাই আমার নিয়তি। আমার ভাগে এই ইনজুরির সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে ফেরাটাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আট বছর ইনজুরিতে পড়ে আবার নিজেকে প্রুভ করে ফিরেছি। আমি আশায় আছি। আত্মবিশ্বাস রাখি যে ব্যাক করার সামর্থ্য আছে।

জাগো নিউজ : ইনজুরি আপনার ক্যারিয়ারকে তত সমৃদ্ধ করতে দেয়নি। না হয় সাফল্যের ফলক স্পর্শ করতে পারতেন আপনি?

শফিউল : হ্যাঁ তাতো অবশ্যই। আমি বেশ কিছু ম্যাচ মিস করেছি। আমার দেখামতে টিম বাংলাদেশ যখন সবচেয়ে ভাল টাচে (২০১৫-২০১৭) ছিল, তখন আমি নিয়মিত দলে থাকতে পারিনি। তখন সবাই খুব ভাল খেলেছে। দলের পারফরমেন্স ভাল ও উজ্জ্বল হবার পাশাপাশি অনেকের লাকও ফেবার করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি তখন দলে অনিয়মিত। ওই সময়টা মিস করেছি। ভাল রেকর্ড করার সম্ভাবনা ছিল।

জাগো নিউজ : আচ্ছা তবে কি ইনজুরি আক্রান্ত শফিউল হাল ছেড়ে দিয়েছে, যে আর হবে না?

শফিউল : না, না। মোটেই তা নয়। আমি হাল ছাড়িনি। হাল ছাড়বো না। আমার বিশ্বাস আছে আমি আবার কামব্যাক করতে পারবো। আত্মবিশ্বাস আছে ভালভাবেই ফিরতে পারবো ইনশাল্লাহ।

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।