কী হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভ্যন্তরে?
নেপিয়ারের ম্যকলিন পার্কে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ নিয়ে আমরা খুব লাফালাফি করেছি। ভাবটা ছিল এমন যে- ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো ডার্কওয়ার্থ অ্যান্ড লুইস পদ্ধতির ভুলভাল হিসাব-নিকাশ করেছিলেন। তিন-তিনবার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। এমন করলে কী আর মনযোগ দিয়ে খেলা যায়? না হলে তো আমরা জিতেই যেতাম!
সেদিন ভুল হিসেবে প্রথমে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ ওভারে ১৪৮ রান। ধরে নিলাম, সেটাই ঠিক ছিল। তাতেও কী জিততে পারতাম? বাংলাদেশ তো থেমে গেছে তারও আগে, ১৪২ রানের মাথায়। সে হিসেবে তো ৫ রানে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে! যদিও পরিবর্তিত লক্ষ্য নিধারণের পর বাংলাদেশের হারের ব্যবধান ছিল ২৮ রানে।
অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে আজ (বৃহস্পতিবার) মাঠে নামার আগের দিন সৌম্য সরকার মিডিয়ার সামনে এসে অনেক বড় বুলি আউড়ে গেলেন। নেপিয়ারে ২৭ বলে ৫১ রান করার কারণে আত্মবিশ্বাসে যেন টগবগ করে ফুটছিলেন তিনি। বলে দিলেন, নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতেই হারানো সম্ভব। তবে...।
তবে কী? দলের সবাইকে একসঙ্গে জ্বলে উঠতে হবে। এ কথাটা তো নির্বোধও জানে। দলের সবাই একসঙ্গে কখনো জ্বলে উঠে না। উঠলে তখন কোনো পরাশক্তিই সামনে দাঁড়াতে পারতো না। দলের সবাই না হোক অর্ধেকও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে সেটা প্রতিপক্ষের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
নিউজিল্যান্ড সফরে এমনিতেই সফরকারী প্রতিটি দল খাবি খায়। সেখানে বাংলাদেশ কিউইদের মাটি থেকে সাফল্যের সোনালি রেনু ছড়িয়ে দেবে- এমন ভাবাটা উচ্চ বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওয়ানডে সিরিজের আগে অধিনায়ক তামিম, কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো বলেছেন, ‘এবারই সুযোগ নিউজিল্যান্ডকে হারানোর।’ টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ কিংবা শেষ ম্যাচের আগে সৌম্য সরকার বলেছেন প্রায় একই কথা।
কিন্তু গালভরা বুলি আর মাঠের খেলা এক কথা নয়। কোন কন্ডিশনে কিভাবে দল চালাতে হবে, ফিল্ডিং সাজাতে হবে, বোলার ব্যবহার করতে হবে এবং সর্বোপরি ব্যাটিং করতে হয়, তা জানতে হবে আগে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কে এ সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে? নিউজিল্যান্ডে বাউন্সি কন্ডিশন, বল হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, বুক সমান গতিতে ছুটে আসে- বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা এগুলো কিভাবে সামলাবে, এসব জানে তারা? তাদেরকে কে শেখাবে?
\
অকল্যান্ডে আজকের ম্যাচে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো, যতই বাগাড়ম্বর করা হোক না কেন, বাংলাদেশ দলটি আসলে অন্তঃসারশূন্য। এই দলের কোনো বোলিং শক্তি নেই, কোনো ব্যাটিং শক্তি নেই, ফিল্ডিংয়ে কোনো ক্ষিপ্রতা নেই, সব মিলিয়ে দলটিতে কোনো শৃঙ্খলা পর্যন্ত নেই।
শৃঙ্খলার প্রসঙ্গ যখন আসলো, তখন বিষয়টা বলতেই হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলটিতে এসব কী হচ্ছে? ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই যদি হিসেব করা হয়, তাহলে ক্রিকেটবোদ্ধাদের গভীর চিন্তা করতে হবে। এই দলটি চলছে লক্ষ্যহীন এক গন্তব্যে। দলের মধ্যে যেন কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
দল নির্বাচন, নেতৃত্বের দুর্বলতা- সব মিলিয়ে দলটির মধ্যে অন্তঃসার শূন্যতা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হারের পরই ধরা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। তখনই প্রশ্ন উঠেছে দল নির্বাচন নিয়ে। নেতৃত্বের দুর্বলতার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে তখন।
এরপরই আসলো সাকিব আল হাসান প্রসঙ্গ। ইনজুরি আর পারিবারিক ঝামেলার কারণে তিনি নিউজিল্যান্ড সফর থেকে ছুটি নিয়ে নিলেন। এরপর আইপিএলের নিলাম হলো। সাকিব আবার নাম লিখলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সে। এবার তিনি বিসিবির কাছে চিঠি দিলেন, জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলবেন না, খেলবেন আইপিএলে।
তোলপাড় শুরু হলো তখন থেকেই। মোস্তাফিজ খেলবেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠলো। দলের মধ্যে আসলে কার নিয়ন্ত্রণ, সে বিষয়টা অস্পষ্ট হয়ে উঠলো ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকদের কাছে।
এরই মধ্যে নিউজিল্যান্ডে খেলতে গিয়ে কোয়ারেন্টাইন পর্ব শেষ করার পরই তামিম ঘোষণা দিলেন তিনি টি-টোয়েন্টি খেলবেন না। বিষয়টা নাকি তিনি দেশে থাকতেই নির্বাচকদের জানিয়েছিলেন। তাহলে দেশে থাকতেই কেন তিনি মিডিয়ায় ঘোষণা দেননি? নিউজিল্যান্ডে গিয়ে কেন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে কুইন্সটাউনে গিয়ে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে এই ঘোষণা দিলেন? অনুসন্ধিৎসু মনে এই প্রশ্নও জাগে, তামিম ইকবালের সঙ্গে কী এমন হয়েছে যে, সফরে গিয়ে সিরিজ শুরুর আগেই একটি ফরম্যাট থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি!
ওয়ানডে সিরিজ খেলা হলো। শেষ ম্যাচে কাঁধে হালকা চোট পেলেন আরেক সিনিয়র খেলোয়াড় মুশফিকুর রহীম। প্রথমে শোনা গিয়েছিল তেমন গুরুতর নয়। পরে জানা গেলো, সতর্কতা স্বরূপ তিনি প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলবেন না। শেষ পর্যন্ত একটি নয়, কোনো ম্যাচই খেললেন না মুশফিক।
তৃতীয় টি-টোয়েন্টির আগে টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বলা হলো অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ফিটনেস সমস্যা। কোনো ইনজুরি-টিনজুরি কিছুই নয়, স্রেফ ফিটনেস সমস্যা। যে কারণে অধিনায়ক রিয়াদ নেই দলে এবং এই প্রথম গত দেড় দশকে পঞ্চ পাণ্ডবের (মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক এবং মাহমুদউল্লাহ) কাউকে ছাড়াই বাংলাদেশ দল নামলো খেলতে।
রিয়াদের ফিটনেস সমস্যা, খেলতে পারবেন না। স্বাভাবিকভাবেই অধিনায়ক নির্বাচনের প্রসঙ্গটি চলে আসে। দলের মধ্যে টুকটাক অধিনায়কত্ব করা আরও ক্রিকেটার ছিলেন। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই- হুট করে লিটন দাসকে অধিনায়ক বানিয়ে দেয়া হলো। ঘরোয়া ক্রিকেটেও যার নেতৃত্ব দেয়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
এ পর্যায়ে একটি কৌতুক মনে পড়লো। আজই বাংলাদেশ দলের ৬৫ রানে হেরে যাওয়ার পর ফেসবুকে এক ভক্ত বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে ঠাট্টা করে লিখেছে-
কোচ : তোমাদের মধ্যে কে একটু-আধটু ইংরেজি পারে?
লিটন : হাত তুলে বলে- ইয়েস স্যার, আমি।
কোচ : তাহলে তুমিই আজ অধিনায়ক।’
কৌতক হলেও, আজকের ম্যাচে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নির্বাচন হয়েছে অনেকটাই এভাবে। অথচ, সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে চট্টগ্রাম দলকে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহানীর মত দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চ্যাম্পিয়ন করেছেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। গুঞ্জন ছিল, নাজমুল হোসেন শান্তকে দলে এনে নেতৃত্ব দেয়া হবে। তা না করা হলেও, ঘরোয়া ক্রিকেটে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে সামনে আনা যেতো।
লিটন কুমার দাসকে নেতৃত্ব দেয়ার পর কী হলো? কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভারী হয়ে থাকা স্টেডিয়ামে যখন মাত্র ১০ ওভারের ম্যাচ নির্ধারণ হলো, তখন প্রথমে বোলিং করতে নেমে দলে তিনজন জেনুইন পেসার, একজন মিনি পেস অলরাউন্ডার থাকার পরও অধিনায়ক প্রথম ওভার করানোর জন্য বল তুলে দিলেন একজন স্পিনারের হাতে।
যেখানে উইকেটে জমে থাকা ময়েশ্চারের সুবিধা নেয়ার চিন্তা থাকবে পেসারদের দিয়ে, সেখানে ডেকে আনা হলো স্পিনারকে। এ কেমন অধিনায়কত্ব? এমন অবস্থা দেখে সবাই বিস্মিত। ফল যা হওয়ার তাই হলো, কিউই ব্যাটসম্যানরা বেদম প্রহার করলো বাংলাদেশের বোলারদের। ১০ ওভারে তারা তুলো ১৪১ রান। ২০ ওভারে তাহলে কত হতো? ১৪১ রানের দ্বিগুণ?
ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ছন্নছাড়া অবস্থা দেখার পর প্রশ্ন উঠে গেছে, কেন কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশী কোচিং স্টাফগুলোকে পালা হচ্ছে? কেন ব্যাটিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, বোলিং কোচের বাহারী আয়োজন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে ঘিরে? পর্বতের মুষিক প্রসবের মত হলে সামান্য সাফল্য আসলেও তো কথা ছিল। এই কোচিং স্টাফরা না পারছেন শিখাতে যে, কিভাবে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে ব্যাটসম্যানরা ব্যাট করবে, না পারছেন কিভাবে ভালোমানের ফিল্ডিং করতে হয়, তা শেখাতে?
বিষয়টা হয়ে গেছে যেন, ‘চলছে গাড়ী যাত্রাবাড়ী, চলতেই থাকুক’- এমন। বাংলাদেশ দলের যখন করুণ পরাজয় ঘটছে, এমন সময় ড্রেসিংরুমে কোচের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখতে কার ভালো লাগবে? শরীর জ্বলে উঠবে না?
সিনিয়রদের একে একে নানা অজুহাতে দল থেকে সরে পড়া, কোচিং স্টাফদের গা-ছাড়া ভাব, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যহীন যাত্রা- বলি এই বাংলাদেশ দলের অভ্যন্তরে আসলে হচ্ছেটা কী? জবাব দেবেন কেউ?
আইএইচএস/জিকেএস