‘রান করতে না পারলেও জাভেদ মিয়াঁদাদের উইকেট নিয়েছিলাম’
শ্রীলঙ্কায় ১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে। দেশের বরেণ্য এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের নাম তাই ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক শামীম কবির হতে পারেন; কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম অধিনায়ক- এই গৌরবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গাজী আশরাফ লিপুর নাম।
ইতিহাস-পরিসংখ্যান জানাচ্ছে দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডেতে ওয়ান ডাউনে ব্যাট করেছিলেন অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। তার নিজের ব্যাটিং ভাল কিছু হয়নি। ‘কিং অব সুইং’ ওয়াসিম আকরামের বলে শূন্য রানে ফিরে এসেছিলেন ।
সেই অভিজ্ঞতা জাগো নিউজের কাছে খুলে বললেন গাজী আশরাফ লিপু, ‘মনে আছে উইকেটে গিয়ে আমি ওয়াসিম আকরামের দু’তিনটা (৩ বলে ০) বল ফেস করেছিলাম। রান করার আগেই বোল্ড হয়ে যাই। যে বলে আউট হই, বলটা পিচ করেছিল আমার নাগালের মধ্যেই। সত্যি কথা বলতে সেটা ছিল হাফভলি। দেখলাম একদম আমার নাগালের মধ্যে একটা বল ভিতরে এত সুন্দরভাবে আসতেছে। ভাবলাম ড্রাইভ খেলার জন্য আদর্শ ডেলিভারি। আমি ড্রাইভ করতে গেলাম। মিড অফ আর মিড অনে খেলার ইচ্ছে ছিল; কিন্তু মাথায় ছিল না যে, ওয়াসিম আকরামের বল দেরিতে ম্যুভ করে, ‘লেট সুইং’ হয়। সেটা হলো আমার ক্ষেত্রেও। বলটা ভিতরে ঢুকলো। ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানলো উইকেটে। একটা শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি আমি বোল্ড। নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে এখনো লজ্জা লাগে। মাথায়ই আসেনি বল এত দেরিতে সুইং করে আরও ভিতরে ঢুকে উইকেট ভাঙ্গতে পারে। আমরা ঘরের ক্রিকেটে যে গতি ও সুইংয়ে খেলি, ওই ডেলিভারি তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে ভিতরে আসলো। আর ম্যুভমেন্ট বা সুইংও হলো বেশি। আমি গতি আর সুইংয়ের কাছে পরাস্ত হয়ে বোল্ড হয়ে ফিরলাম সাজঘরে।’
প্রথমে ওপেনার নুরুল আবেদিন নোবেল, এরপর তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামা অধিনায়ক লিপুর শূন্য রানে ফিরে যাওয়া, শুরুতেই ব্যাকফুটে দল। সে ধাক্কা সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। মাত্র ৯৪ রানেই (৩৫.৩ ওভারে) অলআউট হয়েছিল গাজী আশরাফ লিপুর দল।
ওই সামান্য কটা রান নিয়ে তখনকার ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম স্টাইলিস্ট ওপেনার মহসিন খান, পরিপাটি ব্যাটিং টেকনিকের মুদাসসার নজর আর তুখোড় উইলোবাজ জাভেদ মিয়াঁদাদের মত বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানে গড়া দলের সাথে কিছুই করার ছিল না।
তারপরও ইতিহাস জানাচ্ছে ৯৫ করতে ৩ উইকেট খোয়া গিয়েছিল পাকিস্তানের। ওপেনার মুদাসসার নজর (৪৭*) একপ্রান্তে নট আউট থেকে ম্যাচ শেষ করলেও অপর ওপেনার মহসিন খান (২৮), আজকের নামী ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা (০) ও সে সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদ (১৫) আউট হয়েছিলেন।
মহসিন খান আর রমিজ রাজার উইকেট দুটি জমা পড়েছিল পেসার জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহর ঝুলিতে। আর স্পিন মাস্টার জাভেদ মিয়াদাঁদকে আউট করেছিলেন অধিনায়ক লিপু নিজে।
যার ব্যাটের সামনে বিশ্বের বাঘা-বাঘা স্পিনারদের বুক কাপে, যিনি বলে-কয়ে স্পিনারদের নাগালের বাইরে ফাঁকা জায়গায় বল পাঠিয়ে সিঙ্গেলস, ডাবলস তুলে নেয়ার পাশাপাশি বাউন্ডারি হাঁকাতে খুব পারদর্শি, সেই জাভেদ মিয়াদাঁদের উইকেট নেয়ার স্মৃতিটা এখনো জাগরুক লিপুর মনে।
তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিপু বলে ওঠেন, ‘আসলে জাভেদ মিয়াদাঁদের মত স্পিনে বিশেষ দক্ষ মাস্টার উইলোবাজকে আউট করার মত ডেলিভারি ছিল না সেটা। আমি জেন্টল অফস্পিন করতাম ক্লাব ক্রিকেটে। সেটাই করলাম। অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে একটু শর্ট অব লেন্থ ডেলিভারি। জাভেদ কাট করতে গেলেন। যেটা তার অন্যতম পছন্দের শট। পারফেকশনও ছিল খুব। শতশত বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন ওই কাটে; কিন্তু ওই ডেলিভারির ক্ষেত্রে যেটা হলো বলটি তার প্রত্যাশার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক একটু বেশি উচ্চতা পেল। যে কারণে কাট করতে গিয়ে ঠিক মাঝব্যাটে হলো না। বল ব্যাটের বাইরের ও একটু ওপরের দিকে লিগে চলে গেল উইকেটের পিছনে। কিপার হাফিজুর রহমান সানি বেশ ভাল ক্যাচ নিল। আমি পেয়ে গেলাম মিয়াঁদাদের উইকেট।’
অধিনায়ক হিসেবে ওই ম্যাচে নিজ দলের পারফরমারদের মূল্যায়ন করে লিপু বললেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমরা প্রথম ওয়ানডেতে যত কম রানে অলআউট হয়েছিলাম, তত কম রান করার মত দল ছিলাম না। আমাদের দলে রফিক ভাই (রফিকুল আলম), রকিবুল ভাই আর নান্নু (মিনহাজুল আবেদিন) - অন্তত তিনজন খুব ভাল ব্যাটসম্যান ছিল; কিন্তু প্রথম ম্যাচে তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেননি। আমি এখনো বিশ্বাস করি তাদের ব্যাটিং সামর্থ্য ও ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি।’
প্রথম ম্যাচে নিজ দলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিপু বলেন, ‘প্রথম ওয়ানডে অনুযায়ী শহিদ (শহিদুর রহমান, ওই ম্যাচের টপ স্কোরার - ৩৭) একবুক সাহস নিয়ে ব্যাটিং করে কিছু রান করেছিল। সন্দেহ নেই বাদশাহ ভাই (জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ) দারুণ বল করেই ২ উইকেটের পতন ঘটিয়েছিলেন। উইকেট না পেলেও দারুণ বোলিং করেছিল পেসার প্রিন্স (গোলাম নওশের)। তার প্রচন্ড গতি ও সুইং সমীহ আদায় করে নিয়েছিল প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের।’
লিপুর অনুভব ও মূল্যায়ন, আসলে মেধা-প্রজ্ঞা ও সামর্থ্যের ঘাটতির চেয়েও আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো আর প্রস্তুতির সাথে ৮৬’র প্রথম এশিয়া কাপ খেলতে যাওয়া এবং পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হবার প্রস্ততি ছিল নেহায়েত অপ্রতুল।
তখন এমন বিশ্বমানের ধারালো বোলিং শক্তির বিপক্ষে খেলার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার ছিল, তার কিছুই আমাদের ছিল না। আমরা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে স্লো এবং লো উইকেটে ৬-৭ মিনিট নেটে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করেই খেলতে গেছি। কোন বোলিং মেশিন ছিল না। ইমরান, ওয়াসিম আকরাম আর জাকির খানের গড়ে ১৪০ কিলোমিটার গতির বোলিং আমরা আগে কখনো খেলিনি। আব্দুল কাদিরের লেগস্পিন গুগলি সামলানো মোটেই সহজ ছিল না। মোট কথা, খালি হাতে হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার মত অবস্থা ছিল আমাদের।
তিন-তিনজন পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলারের বোলিং মোকাবিলার স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে লিপুর মুখে আরও দুটি গল্প, আমরা ঘরের ক্রিকেটে কোনদিন ‘চেস্ট গার্ড’ পরে খেলিনি। কারণ বাউন্সার ছাড়া অত উঁচুতে ফাস্ট বোলারদের বল লাফিয়ে উঠতো না; কিন্তু কলম্বোয় প্রথম এশিয়া কাপ খেলতে গিয়ে জানলাম- ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, জাকির খান, অশান্তা ডি মেল আর রবি রত্নায়কের বল খেলতে হলে অবশ্যই চেস্ট গার্ড পড়ে খেলা নিরাপদ।
এছাড়া থাই প্যাডটাও হতে হবে আরও সুরক্ষিত। আমরা যে সব থাই প্যাড ব্যবহার করি, তা চলবে না। আরও ভালমানে দামি ও সুরক্ষিত থাই প্যাড দরকার। আমার এখনো মনে আছে আমরা কলম্বো গিয়ে ভাল ও পুরো থাই প্যাড কিনলাম। চেস্ট গার্ড পরলাম। যেহেতু আগে চেস্ট গার্ড পড়ার অভ্যাস ছিল না।
তাই রীতিমত অস্বস্তিই লাগলো তা পরে ব্যাট করতে এবং বলতে দ্বীধা নেই- ওই ‘চেস্ট গার্ড’ পরে প্রথম ব্যাটিংয়ে নামাটাও ছিল একটা অস্বস্তির কারণ। এছাড়া ৮০ দশকের মাঝামঝি ঘরের ক্রিকেটেও আমাদের সবার নিয়মিত হেলমেট ব্যবহারের অভ্যাস ছিল না। এখনো মনে পড়ে বাদশাহ ভাই আর উইকেটকিপার সানি (হাফিজুর রহমান) হেলমেট ছাড়া ব্যাটিংয়ে নেমেছিল।
পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ আর মুদাসসার নজরের মত সিনিয়র ক্রিকেটাররা তাদের হেলমেট পরতে বললেন। পরে ড্রেসিংরুম থেকে হেলমেট আনতে বলেছিলেন। মোটকথা, আমার বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই যে, আমরা যখন এশিয়া কাপ খেলতে যাই তখনকার বিশ্ব ও এশিয়ান ক্রিকেট ছিল অনেক সমৃদ্ধ। অনেক অগ্রসর। আমরা ছিলাম যোজন যোজন পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলতে কিছুই ছিল না।
মানছি মেধা, ট্যালেন্ট, টেকনিক আর ট্যাকটিসও ছিল অনেক সীমিত। তারচয়ে বড় ছিল আনুসাঙ্গিক উপকরণ, অবকাঠামো ও আধুনিক সুযোগ সুবিধার অভাব। আসলে তখন আমাদের কিছুই ছিল না। আমি শ্রীলঙ্কা গিয়ে ওদের বয়সভিত্তিক দলগুলোর ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ আর আনুসাঙ্গিক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দেখে অবাক হয়েছি। প্রতিপক্ষের দ্রুত গতির বোলিং, আব্দুল কাদিরেরর লেগস্পিন-গুগলি সামলাতে করণীয় কী? কিছুই জানা ছিল না আমাদের।
বিশ্ব ক্রিকেট কোথায় দাঁড়িয়ে তখন? কোচিং মেথড কেমন হবে? আমরা কিছুই জানতাম না। আমাদের যারা কোচিং করাতেন, তারা ভারতের পাতিয়ালা থেকে ড্রিগ্রি নেয়া। অথচ ক্রিকেট কোচিং তখনই অনেক এগিয়ে। আমরা ওসব কিছুই পাইনি। ওসব সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমরা প্রথম ওয়ানডে খেলতে গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায়।
প্র্যাকটিসের ধরণ, প্রস্তুতি কার্যক্রম এবং কার্যকর কোচিং মেথড যে সামর্থ্যের ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে- তাও জানা ছিল না টিম বাংলাদেশের।
লিপু একটি উদাহরণ টেনে তার প্রমাণ দিয়েছেন। ৮৬’র প্রথম এশিয়া কাপে ভারত ছিল না। রাউন্ড রবিন লিগে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান। লঙ্কানরা পাত্তাই পায়নি। ইমরান খানের দল জিতেছিল ৮১ রানে। ওপেনার ব্রেন্ডন কুরুপ্পু (৩৪), অরবিন্দ ডি সিলভা (১২) ও পেসার রবি রত্নায়েকে (২২) ছাড়া কেউ দুই অংকেই পৌছাতে পারেননি; কিন্তু ফাইনালে সেই পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে প্রথম এশিয়া কাপ ঘরে তুলেছিল শ্রীলঙ্কা।
ফাইনালের আগে শ্রীলঙ্কার প্রস্তুতিটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, সে বর্ণনা দিয়ে লিপু বলেন, ‘লঙ্কানদের প্র্যাকটিস দেখেছি নিজ চোখে। মনে আছে ওপেনার রৌশন মহানামাকে মাত্র ৮-১০ গজ দুর থেকে জোরে জোরে বল ছুঁড়ে দীর্ঘক্ষণ ব্যাটিং অনুশীলন করানো হলো। আর জনা তিনেক স্পিনারদের নিয়ে অন্তত ঘণ্টা খানেক ব্যাটিংটাকে ঝালিয়ে নিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। ফাইনালে ঠিক অরবিন্দ ডি সিলভার ব্যাট (অপরাজিত ৫২) ঝলসে উঠলো। সাথে অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার ফিফটি (৫৭) যোগ হলে শেষ হাসি হাসলো শ্রীলঙ্কা। আমরা অনেক কিছুই প্রথম দেখলাম। অজানা কিছু জানা হলো। প্রচুর নতুন স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম।
বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক লিপুর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরুটা দারুণ। ১৯৮২ সালে প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলতে গিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমেই ৭২ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দিয়ে সেরা হয়েছিলেন তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া লিপু।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই আসরে লিপু আরও একটি সাফল্য দেখান। যদিও সেটা আইসিসি ট্রফির মূল আসর ছিল না। সেবার আইসিসি ট্রফির তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে ইউসুফ বাবু (ইউসুফ রহমান বাবু) সেঞ্চুরি করে বসেন; কিন্তু আসর শুরুর আগে এক প্রস্তুতি ম্যাচে ইংলিশ ক্লাব দলের বিপক্ষে প্রথম শতকটি এসেছিল লিপুর ব্যাট থেকে। সেটা ছিল প্রথম কোন ভিনদেশি দলের বিপক্ষে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোন উইলোবাজের প্রথম সেঞ্চুরি।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক লিপুর আছে ঈর্ষণীয় কৃতিত্ব। সেই ১৯৮৩-১৯৮৪ থেকে দীর্ঘ প্রায় ১০-১২ বছর আবাহনীর অধিনায়ক ছিলেন লিপু। তার অধিনায়কত্বে আবাহনী তখন অন্তত ৭-৮ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়।
১৯৮৪-১৯৮৫ সৌমুমে আবাহনীর অধিনায়ক লিপু প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে এক লিগে হাজার রান করার কৃতিত্ব দেখান। সুলাতানাবাদ জিমখানার হয়ে সেই ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে ঢাকাই ক্রিকেটে যাত্রা শুরু লিপুর।
সেই জানুয়ারি থেকে অনেক দৌড়ঝাঁপ। ছুটাছুটি। প্র্যাকটিসে নিয়মিত যাওয়া; কিন্তু সাকুল্যে হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র। তাও শেষ দিকে। মানে রেলিগেশন নিশ্চিতের পরে। তখনকার দুর্দান্ত দল ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে লিপু প্রথম সুযোগ পেলেন মাঠে নামার।
ভিক্টোরিয়ায় তখন তানভির হায়দার, ইউসুফ বাবু এবং জিএস হাসান তামিমরা খেলতেন। তাও তাকে মাঠে নামানো হতো না। মাঠে গিয়ে দেখা গেল যখন ১১ জন হচ্ছে না। তখন সে সুযোগে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামনে লিপু।
ওই বছরই রেলিগেশনে পড়ে গেল সুলাতানাবাদ জিমখানা। পরের বছর আপন খালাতো ভাই আবাহনী তথা জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার জিএস হাসান তামিমের মধ্যস্থতায় ধানমন্ডি ক্লাবে (আজকের শেখ জামাল ধানমন্ডি) যোগ দেন। তখন ঢাকার সিনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ১৭-১৮টি দল অংশ নিত। তার মানে এক লিগেই গড়ে ১৭-১৮টি ম্যাচ খেলার সুযোগ হতো।
কিন্তু তখনকার উদ্যম তরুণ লিপুর ভাগ্যে অতগুলো ম্যাচ জোটেনি। সেখানেও সাইড বেঞ্চে বসেই কাটলো বেশিরভাগ সময়। শেষ ৪ ম্যাচে নামলেন মাঠে। এরমধ্যে একটিতে পঞ্চাশ, অন্যাটিতে ২১ আর ওয়ারির বিপক্ষে অনবদ্য শতরান করে নিজের মেধা ও যোগ্যতার জানান দিলেন লিপু।
এখনো সেই শতরানের স্মৃতি মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করছে লিপুর। এখন যেটা হকি স্টেডিয়াম, সেখানেই দুটি মাঠ ছিল পাশাপাশি। আউটার স্টেডিয়াম বলা হতো। একটি মাঠ ছিল গুলিস্তান সিনেমা হল ঘেঁষে (এখন সেই বিল্ডিং নেই। তা ভেঙ্গে নতুন ভবন করা হয়েছে)। ওই মাঠে ওয়ারির বিপক্ষে শতরান আসলো লিপুর ব্যাট থেকে। প্রতিপক্ষ দলে তখন ঢাকা লিগের অন্যতম দুই দ্রুত গতির বোলার রফিকুল আলম ও তানজিব আহসান সাদ।
এর দুই বছর ধানমন্ডি ক্লাবে খেলে যোগ দেয়া আবাহনীতে (১৯৮০-৮১)। মাঝে ১৯৯১-৯২’তে দুই বছর গ্রেটার ময়মনসিংহ ক্রিকেট ক্লাব জিএমসিসিতে চলে যান। আবার ফিরে এসে আবাহনী থেকেই অবসর নেন।
১৯৮৪ সালে আবাহনীর অধিনায়ক হন লিপু। এর মধ্যে ৮২-৮৩’তে ক্লাব সংলগ্ন ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কলকাতা এরিয়ান্স ক্লাবের বিপক্ষে এক ম্যাচের স্মৃতির কথা খুব মনে দাগ কেটে আছে লিপুর। সেই ম্যাচে তার ৮৪ আর নান্নুর অপরাজিত ৪৪ রানের ওপর ভর জিতেছিল আবাহনী। খেলা শেষে এরিয়ান্স ম্যানেজারের প্রশংসাসূচক বাক্যটি এখনো কানে বাজে,‘আরে লিপু তুমি তো রঞ্জির মানের ব্যাটসম্যান হে...।’
এরপর আবাহনীর সাফল্যর কান্ডারি হলেন লিপু। ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক লিপুর যোগ্য ও গতিশিল নেতৃত্বে চির প্রতিদ্বন্দি মোহামেডানকে টপকে লিগ ট্রফি বেশী উঠলো আবাহনীর ঘরে। সামনে থেকে সে সাফল্যর নেতৃত্ব দিলেন লিপু। ৮৫ Ñ ৮৬‘ তে এক লিগে হাজার রানের রেকর্ডও গড়ে বসলেন।
আবাহনীর অনেক সাফল্যের রূপকার লিপুর নেতৃত্বেই ঢাকা লিগ খেলে গেছেন ইংলিশ ওয়ানডে স্পেশালিস্ট নেইল ফেয়ারব্রাদার। পুরো লিগে রান না পাওয়া ফেয়ারব্রাদারকে মোহামেডানের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারনী ম্যাচে না খেলানোর চিন্তাই ছিল চূড়ান্ত। লিপু জোর করে তাকে খেলান এবং ৯০ প্লাস রানের এক ঝড়ো ইনিংস খেলে ম্যাচে ভাগ্য গড়ে দেন ফেয়ারব্রাদার।
ওই ভাইটাল ম্যাচে মোহামেডানের লঙ্কান রিক্রুট অতুলা সামারাসেকেরার উত্তাল উইলোবাজি থামে লিপুর বুদ্ধিদীপ্ত অফস্পিনে। ফ্লাইটে বৈচিত্র্য এনে একটু টেনে দেন লিপু। প্রথমে সামনে খেলতে চেয়ে পিছনের পায়ে এসে চকিতে পুল আর ফ্লিকের মাঝামাঝি একটা শট খেলেন সামারা। বল নিচু হয়ে চলে যায় ফেয়ারব্রাদারের তালুতে। পুরো লিগ রান না পাওয়া ফেয়ারব্রাদারের মোহামেডানের সাথে জ্বলে উঠলেন আর সামারাসেকেরাকে আউট করার স্মৃতি মনে হলে অন্যরকম ভাললাগায় লিপুর মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
যেমন ভাল লাগে ৮৭-৮৮ কিংবা ৮৮-৮৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর অলরাউন্ডার অরুপ ভট্টাচার্য্যকে বোল্ড করার দৃশ্য মনে করে। মোহামেডানের সাথে দামাল স্মৃতির ফাইনালে লিপুর বলে শূন্য রানে বোল্ড হয়েছিলেন তখনকার সময়ে পশ্চিম বঙ্গের এক নম্বর অলরাউন্ডার অরুপ।
তার এখনো মনে আছে অরুপের সঙ্গী ছিল জাহিদ রাজ্জাক মাসুম। লিপু বলেন, ‘আমাকে বল হাতে দেখে অরুপ মাসুমকে বললো, ও কী বল করেরে? মাসুম বললো অফ স্পিন। এখনো মনে পড়লে ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হই। আমার বল স্পিন করে অরুপের উইকেট ভেঙ্গে দিল। অরুপের কী অসহায় চাহনি! এছাড়া ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে দামাল স্মৃতির ফাইনালে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ৯৫ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসটির কথাও খুব মনে হয়। আমার ক্যারিয়ারের প্রায় শেষের দিকে অমন ট্রফি জেতানো ইনিংসটি খুব বেশি করে মনে পড়ে।
৮২তে শুরু, এরপর ৮৬ আর ৯০’র আইসিসি ট্রফিতেও অধিনায়কত্ব করলেন লিপু। ৯০’তে তার নেতৃত্বে হল্যান্ডে আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলেছিল টিম বাংলাদেশ।
সেই আসরের পরপরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। আর ৯০ এর আইসিসি ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে থেকেই বেশ অনেকদিন বাঁ হাতের ‘টেনিস এলবো’ ইনজুরিতে ভুগলেন। সাথে কোমরে ব্যাথা। সে কারণেই ৯৫-৯৬’তে ক্রিকেট মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর ক্লাব ক্রিকেট কোনোটা থেকেই ঘটা করে অবসর নেয়া হয়নি লিপুর।
খেলা ছাড়লেও ক্রিকেটের সাথে ঠিকই জড়িয়ে ছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে দলকে আইসিসি ট্রফি উপহার দিতে না পারলেও বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টে থেকে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বয়ে আনেন লিপু। ৯৭’র আইসিসি ট্রফি বিজয়ের অন্যতম নেপথ্য কারিগর ছিলেন ক্রিকেট ম্যানেজার।
১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় এসিসি ট্রফি বিজয়ের পিছনের প্রধান কারিগরও তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ৯৭’র আইসিসি ট্রফি একাদশ সাজানো, ব্যাটিং অর্ডার নির্ধারনে লিপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এরপর বোর্ড ব্যবস্থাপনায়ও ছিলেন বেশ কয়েকবার। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স, টুর্নামেন্ট আর গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন এ তীক্ষ্ণ ক্রিকেট বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তিজীবনে সফল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী লিপু এক কন্যা ও পুত্র সন্তানের জনক। স্ত্রী ভিকারুননেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক।
এআরবি/আইএইচএস/জিকেএস