নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শাহরিয়ার নাফীসের না বলা কথা
সাফল্য বা প্রতিষ্ঠা যাই বলা হোক না কেন, শাহরিয়ার নাফীসকে সবাই এক নামে চেনেন বাঁহাতি ওপেনার হিসেবে। যিনি জাতীয় দলে প্রথম বাঁহাতি ওপেনার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করে রীতিমত নতুন ইতিহাসও গড়েছেন।
কিন্তু সেই শাহরিয়ার নাফীস যে নিজেই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখতেন- তা কি জানেন? জীবনের পথ পরিক্রমায় শাহরিয়ার নাফীস হঠাৎ মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে শুরু করেছিলেন এবং মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলেন।
তবে এক জনের হাতের ছোঁয়ায় আজকের প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফীস ওপেয়ার হয়েছেন, ভাল খেলে নিজেকে সফল ও স্বার্থক ওপেনারের প্রতিমূর্তিও হয়ে আছেন। এর পেছনেও আছে এক দারুণ ইতিহাস, অন্যরকম গল্প।
ছোটবেলা থেকেই কিশোর আবির (শাহরিয়ার নাফীসের ডাক নাম) ব্যাট হাতে আবির ছড়িয়েছেন। সেই অনূর্ধ্ব-১৫ আর অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও খেলেছেন ওপেনার হিসেবেই। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার আগে দিয়েই শাহরিয়ার নাফীস ওপেন বাদ দিয়ে মিডল অর্ডারে খেলা শুরু করেন এবং মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই ক্যারিয়ার গড়ায় মন দেন।
সেই আবির আবার কিভাবে মিডল অর্ডার থেকে ওপেনার হলেন? কে তাকে ওপেন করার পরামর্শ দিলেন, কার অনুপ্রেরণায় বাঁহাতি ওপেনার শাহরিয়ার নাফীসের উত্থান? এর পেছনে আছে দারুণ এক গল্প। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপে শাহরিয়ার নাফীস শুনিয়েছেন তার জীবনের সেই না বলা কথা।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল যুব বিশ্বকাপে খেলার। ২০০৪ সালে আমাদের দেশে হয়েছিল যুব বিশ্বকাপের আসর। অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম, যদি ওপেনার হিসেবে খেলতে চাই, তাহলে হয়তো দলে জায়গা পাবো না। কারণ তখন আমাদের যুব দলের টপঅর্ডারটা একদম সাজানো-গোছানো। নাফিস ইকবাল, নাজিমউদ্দীন, আফতাব আহমেদ আর নাঈম ইসলাম খেলত সেখানে। চারজনেরই অবস্থান পাকাপোক্ত। তাদের টপকে প্রথম চারে জায়গা করে নেয়া কঠিন হবে। তা ভেবেই নিচে নেমে এসেছিলাম।’
‘মূল স্কোয়াড ঘোষণার আগে প্রাথমিক ক্যাম্প চলাকালীন নিজেদের মধ্যে যতগুলো প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছি, সবগুলোতেই আমি ৫ নম্বরে ব্যাট করেছি এবং যতটুকু মনে পড়ে ভালই খেলেছিলাম। কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে মিডল অর্ডারে নেমে এসেও মূল দলে জায়গা পাবো না। এক সময় দল ঘোষণা হলো, তাতে আমার জায়গা হলো না। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেক আশা ছিল ঘরের মাঠে যুব বিশ্বকাপ খেলার। তখন মনটা যে কত খারাপ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না। দুঃখজনক এই যে, টপঅর্ডারে জায়গা পাবো না ভেবে মিডলঅর্ডারে নেমেছিলাম, শেষ পর্যন্ত ঐ মিডল অর্ডারে জায়গা হয়নি- কারণ সেখানে ছিল বেশ কজন অলরাউন্ডার।’
‘কেন আমাকে নেয়া হয়নি- এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের সেই দলের নিউক্লিয়াস ও কোচ রিচার্ড ম্যাকিন্স আমাকে বলেছিলেন, "শোন নাফীস, মিডলঅর্ডারে তোমাকে বাদ দিয়ে যাদের বিবেচনায় আনা হয়েছে, সেই নাদিফ চৌধুরী আর আবুল বাশার- সবাই বোলিংটাও পারে। তোমার তো আর বোলিং নেই। তাই তোমাকে নিতে পারিনি"- বলছিলেন নাফীস।
কিন্তু যুব বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা না পেয়েও আপনি তো ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন? সে ঘটনাটি একটু বলুন?
‘হ্যাঁ! এখনও খুব ভাল মনে আছে। যুব বিশ্বকাপের আগে ভারতীয় যুবারা একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিল। আমি সেই দলের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সেঞ্চুরি করেছিলাম। ঐ দলে তখন আর পি সিং, ভুবনেশ্বর কুমার, স্টুয়ার্ট বিনি, পিয়ুশ চাওলারা খেলতেন। তাদের বিপক্ষে দারুণ সেঞ্চুরি করে ফেললাম। ঐ শতরানের পর খুব সাড়াও পড়ল। কেন আমাকে নেয়া হলো না? মিডিয়ায় প্রচুর লেখালেখিও হলো।’
আপনার ওপেনার হিসেবে ফেরার গল্পটা কী? আবার ওপেনার হলেন কীভাবে, নিজের ইচ্ছায় নাকি কারও পরামর্শে? নাফীসের উত্তর, ‘সেটাও তখনকার যুব দলের কোচ রিচার্ড ম্যাকিন্সের কারণে। বিশ্বকাপ খেলতে না পারায় আমার মন খুব খারাপ ছিল। তারপরও কয়েক মাস পর শুরু হলো এইচপি ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে আমি ডাক পেলাম এবং যুব দলের সঙ্গে ইংল্যান্ডও গেলাম। আমি মিডলঅর্ডারে খেলি। ইংল্যান্ডের যুব দলের সঙ্গে তিনটি চারদিনের দিনের আর তিনটি একদিনের ম্যাচ ছাড়াও কিছু ট্যুর ম্যাচ খেলেছিলাম। সেখানে ইংলিশ দ্বিতীয় যুব দলও ছিল আমাদের প্রতিপক্ষ। তাদের বিপক্ষে প্রথম ট্যুর ম্যাচেই মিডলঅর্ডারে নেমে রান করেছি। যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ নম্বরে নেমে ৭০-৮০ করেছিলাম। সে ম্যাচে ইংলিশ দ্বিতীয় যুব দলে ছিলেন মঈন আলী, স্টুয়ার্ট ব্রডরা।’
‘ঐ ম্যাচে রান করার পর রিচার্ড ম্যাকিন্স আমাকে বারবার পজিশন পাল্টে ওপেন করার জন্য বলতে থাকেন। আমি পাল্টা যুক্তি দিলাম, কেন ওপরে খেলব? আমি তো পাঁচে খেলে রান করছি। এবার ম্যাকিন্স আমাকে আরও তিরস্কারের সুরে বললেন, তুমি ভীতু। পুরনো বলে খেলতে চাও। নতুন বলের চাকচিক্য বেশি থাকে, সুইং করে। তাই তুমি ওপরে খেলতে ভয় পাও। তার ঐ উসকানিমূলক কথায় আমার জেদ চেপে গেল। পরে একপর্যায়ে আমি বলেছি যাও ওপেন করব। তারপর ওপেন করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৯৯, পরের ম্যাচে আবার ফিফটি। মনে আছে ঐ ট্যুরে আমি ১৩ ইনিংসে ৫০০’র বেশি রান করেছিলাম। নাফিস ইকবাল (৭০০+) শুধু আমার চেয়ে বেশি রান করেছিল। প্রথম দুটি ম্যাচ বাদে সবকটা ইনিংসগুই ছিল ওপেন করতে নেমে।’
‘ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে শ্রীলঙ্কার ম্যাক্স ক্রিকেট একাডেমির সঙ্গে খেলার জন্য আবার এইচপি ক্যাম্প। আবার সেই রিচার্ড ম্যাকিন্সের জোরাজুরি, "ওপেন করো, ওপেন করো"। এক ইনিংসে ওপেন করে তিন দিনের ম্যাচে ৮০ রানের ইনিংস খেলে ফেললাম।’
‘তখন আমাকে ডেকে ম্যাকিন্স বললেন, এই ছেলে তুমি এত বোকা কেন? তোমাকে আমি ওপেন করতে বলি তুমি কি বোঝ না? তোমার কি বুদ্ধি নেই? আরে আমি চাই তুমি বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলো। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ দলে ঢোকার সবচেয়ে ভাল জায়গা হলো ওপেনিং। জাতীয় দলে যারা ওপেনার আছে সেই নাফিস ইকবাল আর জাভেদ ওমর কেউ ধারাবাহিকভাবে রান করছে না। কারো জায়গাই পাকাপোক্ত না। আমার বিশ্বাস তুমি ঐ জায়গায় ঢুকে যেতে পারবে। তাই তোমাকে আমি বারবার ওপেন করতে বলি।’
‘তখন আমি বুঝলাম, আরে ম্যাকিন্স তো আমার ভালই চান। বললাম, ঠিক আছে এখন থেকে ওপেনই করব। সেই থেকে আবার ওপেনার হিসেবে ফিরে যাওয়া এবং এক বছরের মধ্যেই কপাল খুলে গেল। আমি জাতীয় দলে জায়গা পেলাম। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে জাভেদ ভাইয়ের সঙ্গে নটিংহ্যামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হলো। শুধু মিডলঅর্ডার থেকে বুঝিয়ে আমাকে ওপেনার বানানোই নয়, আমার ব্যাটিং স্টাইল, অ্যাপ্রোচ পাল্টে আমাকে প্রথাগত উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান থেকে ড্যাশিং ও আক্রমণাত্মক ওপেনার হিসেবে গড়ে তোলার কৃতিত্বটাও ম্যাকিন্সের। কাজেই বলতেই পারেন, আমার ক্যারিয়ারের পেছনে রিচার্ড ম্যাকিন্স রেখেছেন অনেক বড় ভূমিকা। আমি তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ।’
এরপর আপনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণ করবেন একটু? নাফীস বলেন, ‘জানেন, সেখানেও কিন্তু ম্যাকিন্সের একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে।’
সেটা কী করে সম্ভব? রিচার্ড ম্যাকিন্স তো তখন বাংলাদেশ হাই পারফরমেন্স ইউনিট, যুব দলের কোচিং ছেড়ে টিম অস্ট্রেলিয়ার অ্যানালিস্ট। তিনি কী করে আপনার ভাল খেলা ও সেঞ্চুরির পেছনে ভূমিকা রাখেন?
নাফীস বলেন, ‘২০০৬ সালের এপিলে অস্ট্রেলিয়া আসলো। ম্যাকিন্স তখন অস্ট্রেলিয়ার কম্পিউটার অ্যানালিস্ট। আমার সঙ্গে ঠিক ফতুল্লা টেস্টের আগের দিন দেখা। আমি তখন ইন্টার স্পোর্টস থেকে এক জোড়া বিদেশি বুট কিনে হোটেলে ফিরছিলাম। লবিতে দেখা ম্যাকিন্সের সঙ্গে। ভদ্রলোক আমার ক্যারিয়ার বদলে দিয়েছেন। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আমি মুখিয়ে ছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে। কিন্তু আমাকে খানিক অবাক করে দিয়ে প্রথম আলাপে ম্যাকিন্স তেমন কথা বললেন না। আমার হাতে থাকা বুটের প্যাকেট দেখে জিজ্ঞেস করলেন তোমার হাতে ওটা কী? বললাম, কালকে টেস্ট শুরু। তাই এক জোড়া নতুন ব্যাটিং বুট কিনে আনলাম।’
‘আমাকে চরম হতাশায় ডুবিয়ে মনে আগুন ধরিয়ে ম্যাকিন্স বলে উঠলেন, ‘যাক তোমার বুটটি নতুনই থাকবে। মানে তোমার তো আর রান করার সম্ভাবনা নেই। খেলাটা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। এ মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর দল, বোলিং লাইনআপ ভয়ঙ্কর। বোলার হিসেবে যে দলে ব্রেট লি, গিলেস্পি, শেন ওয়ার্ন আর স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল আছেন, তুমি কি তাদের বিপক্ষে রান করতে পারবে? আমার মনে হয় খুব শীঘ্রই আউট হয়ে ফিরে আসবে। তোমার ব্যাটিং বুটও নতুন থাকবে। ময়লা হবে না।’
‘ম্যাকিন্সের ঐ কথায় মনে আগুন ধরে গেল। কোথায় আমার উৎসাহ জোগাবেন। তা না করে উল্টো অবজ্ঞা করলেন। পণ করলাম যদি পারি ভাল খেলে রান করে তাকে জবাব দিব। তারপর তো আল্লাহর রহমতে রান করে ফেললাম। অস্ট্রেলিয়ার ঐ দুরন্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে’ সেঞ্চুরি করে ফেললাম।’
এখানেই শেষ হয় না নাফীসের না বলা কথা। তিনি বলতে থাকেন, ‘অনেক না বলা কথাই তো বলা হলো। ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। আমি তখন ১২ বছরের কিশোর। খালাতো ভাই ফারুক ভাইদের ধানমন্ডির বাসায় (ফারুক আহমেদ, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচক) বসে টিভিতে অ্যাশেজ দেখছিলাম। তখন ওয়ার্নের বল খেলতে গিয়ে সে কী নাজেহাল অবস্থায় ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। তখনকার অত সাত-পাঁচ না ভেবে নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে খেলা দেখতে দেখতে বলছিলাম, আরে ওয়ার্ন আর এমন কী বোলার, যে তাকে খেলাই যাবে না? তার বলে এমন নাজেহাল হওয়ারই বা কী আছে? ফারুক ভাই রেগেমেগে অস্থির হয়ে চোখ বড় করে বলছিলেন, পাকামো ছাড়। তুই কি বুঝবি ওয়ার্ন কর্ত বড় স্পিনার? নিজে খেললে বুঝতি।’
‘বিশ্বাস করুন, আমি যখন ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম ওয়ার্নকে মোকাবিলা করি, তখন আমার মনে ওয়ার্নের বোলিং দেখে সেই মন্তব্য আর ফারুক ভাইয়ের কড়া সংলাপটি মনে পড়ে গিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি ওয়ার্নের লেগস্পিন ও গুগলি ভালই সামলেছিলাম। মনে হয় আট-দশটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ছিলাম বিশ্বসেরা লেগি ওয়ার্নকেই।’
‘ম্যাচ শেষে কথা হলো ম্যাকিন্সের সঙ্গে। তখন তিনি আমাকে বললেন, সাবাশ! এটাই আমি চেয়েছিলাম। তুুমি ভাল খেলো, রান করো। এটা চেয়েছিলাম বলেই তোমাকে টেস্ট শুরুর আগের দিন ভেতরে জেদ ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর যা বলেছিলেন, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশংসার সার্টিফিকেট।’
সেটা কী? নাফিসের উত্তর, ‘ম্যাকিন্স বললেন, যেহেতু তুমি প্রায় আমার হাতে গড়া, তাই তোমার সবকিছুই আমার জানা। আমি অজি বোলারদের একদম প্ল্যান কষে দিয়েছিলাম তোমাকে আটকাতে কী কী করতে হবে? কিন্তু তুমি সব বোলিংকে নিরস্ত্র করে ছেড়েছ। কী অবলীলায় সাহস নিয়ে বিশ্বের সেরা বেলারদের মোকাবিলা করে সেঞ্চুরি করলে। দেখে খুব ভাল লেগেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি স্বার্থক।’
এআরবি/এসএএস/এমকেএইচ