বাংলাদেশের প্রথম বাঁহাতি ‘স্পেশালিস্ট ওপেনার’ শাহরিয়ার নাফীস
এখন বাংলাদেশে বাঁহাতি ওপেনারের ছড়াছড়ি। তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, সাদমান ইমলাম, মোহাম্মদ নাঈম শেখ। তারও আগে জুনায়েদ সিদ্দিকী খেলেছেন বেশ কিছু ম্যাচ। কিন্তু বলুন তো বাংলাদেশের প্রথম বাঁহাতি ওপেনার কে? ওয়ানডে বা টেস্টে বাংলাদেশের ইনিংসের সূচনাকারী প্রথম বাঁহাতি উইলোবাজ কে?
নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃত বাঁহাতি ওপেনার হলেন শাহরিয়ার নাফীস। ১৯৭৯ সালে প্রথম আইসিসি ট্রফি স্কোয়াড থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি, শ্রীলঙ্কার মাটিতে ১৯৮৬ সালে শুরু হওয়া ওয়ানডে যাত্রায়ও ছিলেন না কোন বাঁহাতি ওপেনার।
কেউ কেউ হয়ত অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ভাবতে পারেন, মাঝের সময় বাংলাদেশ স্কোয়াডে বাঁহাতি ওপেনার থাকতেও পারেন। তাদের জন্য বলা, ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৭- এই ১৮ বছরে বাংলাদেশ যে ছয়টি আইসিসি ট্রফি খেলেছে, তাতে কোন বাঁহাতি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানই ছিলেন না।
১৯৭৯ আর ১৯৮২ সালের আইসিসি ট্রফির দলে বাঁহাতি ওপেনার বহু দূরে, বাঁহাতি ক্রিকেটারই ছিলেন মোটে একজন- দিপু রায় চৌধুরী। দ্রুতগতির বোলার ও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত মিডল অর্ডারে (কখনও কখনও ওপেন করেছেন, সেটা ক্লাব ক্রিকেট আর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে) ব্যাট করা অলরাউন্ডার দিপু রায় চৌধুরী ছিলেন তখন আবাহনীর অধিনায়ক।
৮৬’র আইসিসি ট্রফি স্কোয়াডে কোন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিল না। মূল দলের সঙ্গে খেলতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন দুজন বাঁহাতি বোলার গোলাম নওশের প্রিন্স (মূল পেসার) আর আতিক খান (বাঁহাতি স্পিনার)। ১৯৯০’র দলেও দুজন বাঁহাতির (গোলাম নওশের প্রিন্স আর এনামুল হক মনি) দুজনই বোলার।
১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় আইসিসি ট্রফির পঞ্চম আসরেও টিম বাংলাদেশে কোন বাাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিল না। বাঁহাতি পেসার গোলাম নওশের প্রিন্স, জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দুলু ও বাঁহাতি স্পিনার শরফুদৌলা ইবনে শহীদ সৈকত। আর ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি বিজয়ী দলের দুই বাঁহাতির (এনামুল হক মণি আর মোহাম্মদ রফিক) উভয়ই বাঁহাতি স্পিনার।
এমনকি ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকেও টিম বাংলাদেশের ইনিংসের সূচনা করেছিলেন দুই ডানহাতি শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ আর মেহরাব হোসেন অপি। যারা একটু বেশি ইতিহাস-পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন, তারা কেউ হয়তো বলে বসবেন, কেন মোহাম্মদ রফিক? এই বাঁহাতিও তো ইনিংসের সূচনা করেছেন। হ্যাঁ করেছেন। ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৯৯৮ সালের ১৭ মে ভারতের হায়দরাবাদে কেনিয়ার বিপক্ষে তিন জাতি আসরে নিয়মিত ওপেনার আতহার আলীর সঙ্গে ওপেনার হিসেবে খেলতে নেমে ৮৭ বলে ৭৭ (১১ চার ও ১ ছক্কা) রানের ঝড়ো ইনিংস উপহার দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের (৬ উইকেটে) নায়কও হয়েছেন রফিক।
কিন্তু কথা হচ্ছে, তিনি তো আর প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত ওপেনার নন। ক্রিকেটীয় ভাষায় ‘মেকশিফট’ ওপেনার। মূলত নিচের দিকে ব্যাট করতেন, তাকে হঠাৎ কোন খেলায় বিশেষ কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বা কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় ইনিংসের ওপেন করতে পাঠানো হয়েছিল। এমন নজির ক্রিকেটে ভুরিভুরি আছে। অনেকেই লেট ও মিডল অর্ডার থেকে হঠাৎ কয়েকটি খেলায় ওপেন করেছেন। কিন্তু তারা কেউই স্বীকৃত ওপেনার হিসেবে পরিগণিত হন না। তাই মোহাম্মদ রফিক একাধিক ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে ওপেন করলেও তিনি কখনওই ওপেনার ছিলেন না।
২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ টেস্ট আর ওয়ানডে দলে কোন বাঁহাতি ওপেনার বহু দূরে, বাঁহাতি স্বীকৃত ব্যাটসম্যানই ছিলেন না। কাজেই সব হিসেবেই শাহরিয়ার নাফীস টিম বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃত বাঁহাতি ওপেনার ও বাঁহাতি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান।
২০০৫ সালের ২১ জুন ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে সময়ের এক নম্বর ওপেনার জাভেদ ওমর বেলিমের সঙ্গে ইনিংসের সূচনা করেছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। সেই নাফীসই পরবর্তীতে দেশের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শাহরিয়ার নাফীস জানান দিয়েছিলেন, আমি জয় করতেই এসেছি। আমার সামর্থ্য আছে বড় মঞ্চে ভাল পারফরম করার। ব্যাট থেকে রানের ফলগুধারা বইতো প্রায় নিয়মিতই। ক্যারিয়ারের বয়স এক না পেরুতেই এ বাঁহাতি ওপেনার হয়ে উঠেছিলেন দেশের এক নম্বর ওপেনার। কিন্তু ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে ছন্দপতন। তারপর আসা-যাওয়ার পালা শুরু। একসময় বাইরে ছিটকে পড়া।
তারপরও নাফীসের কৃতিত্ব, অর্জন কম নয়। ২৪ টেস্টে এক সেঞ্চুরি, ৭ ফিফটিতে ১২০৭ রান, ৭৫ ওয়ানডেতে ৪ শতক ও ১৩ অর্ধশতকে ২২০১ রান- সে সত্যই জানান দিচ্ছে। একটি মাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিই শাহরিয়ার নাফীসকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান ও বোলারদের বেশিরভাগ সাফল্য, কৃতিত্ব ও অর্জন তখন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেই সময় বাঁহাতি শাহরিয়ার নাফীস ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ক্লার্কের মত ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার আর সবসময়ের দুই অন্যতম সেরা লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের সাজানো অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দেন।
সেটা ২০০৬ সালের ঘটনা। সময়কাল ছিল ৯ থেকে ১৩ এপ্রিল। ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে গতিসম্রাট ব্রেট লি, সুইং মাস্টার গিলেস্পি আর দুই বিশ্বসেরা লেগি শেন ওয়ার্ন-স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে বুক ভরা সাহস, অবিচল আস্থা ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলে ২৭৪ মিনিটে ১৮৯ বলে ১৯ বাউন্ডারিতে ১৩৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দিয়ে রীতিমত সাড়া জাগান শাহরিয়ার নাফীস। ঐ একটি ইনিংসের কারণেই তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তার আগে ও পরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোট ৬ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও অজিদের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটি সেই শাহরিয়ার নাফীসেরই।
হোক তা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ওয়ানডেতেও তার একটি দূর্লভ কৃতিত্ব আছে। তা হলো কোন দলের বিপক্ষে পরপর তিন ম্যাচে সেঞ্চুুরি। ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট হারারেতে ১১৮ রান দিয়ে শুরু। একই বছর ১৩ অক্টোবর ভারতের জয়পুরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে (১২৩*) পরের সাক্ষাতে ঠিক দেড় মাস পর ঘরের মাঠে খুলনায় সেঞ্চুুরি (১০৫*) দিয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা তিন খেলায় তিন ম্যাচে তিন অংকে পা রেখে সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক।
এআরবি/এসএএস/পিআর