স্বপ্নপূরণের দিন আজ
দেশে তখনও এক নম্বর খেলা ফুটবল। ঘরোয়া ফুটবল তথা আবাহনী-মোহামেডানে বিভক্ত প্রায় গোটা দেশ। এর মধ্যে ক্রিকেট ছিল স্রেফ অংশগ্রহণ করার মতো একটি ডিসিপ্লিন। তবে চিত্রনাট্য বদলাতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফিতে খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসা, ১৯৯৪’ও তাই। শেষপর্যন্ত আকরাম খানের নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে স্বপ্নপূরণ। বাংলাদেশ জিতে নেয় আইসিসি ট্রফি, সে আসরেই নিশ্চিত হয় টাইগারদের বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা।
বিশ্বকাপ টিকিট নিশ্চিত হয়েছিল আগেই। তবু ফাইনাল ম্যাচ মানেই বাড়তি মর্যাদা। বিশেষ করে সহযোগী সদস্য দেশগুলোরে মধ্যে তখনকার ত্রাস কেনিয়ার বিরুদ্ধে যখন খেলা! সেই লড়াই বাংলাদেশ দল জিতেছে দারুণ লড়াই করে, আজ থেকে ঠিক ২৩ বছর আগে, আজকেরই তারিখে।
অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ জিতেছিল আইসিসি ট্রফি। যা পুরোপুরি বদলে দেশের খেলাধুলার চিত্রনাট্যই। ফুটবলের ওপর যে ধাক্কাটা আস্তে আস্তে দিচ্ছিল ক্রিকেট, সেটির বেগ হাজারগুণ বেড়ে যায় আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে।
যা শুধুমাত্র বিশ্বকাপ খেলার টিকিটই দেয়নি, নিশ্চয়তা দিয়েছিল আগামী দিনগুলোতে ক্রিকেটপাগল এক জাতি পেতে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। সেই উন্মাদনার শুরুটা হয়েছিল ঠিক ২৩ বছর আগে কেনিয়াকে ফাইনাল ম্যাচের হারানোর মাধ্যমে অর্থাৎ স্বপ্নপূরণের দিন আজ।
আর্জেন্টিনাকে ৫ উইকেটে হারনো দিয়ে যাত্রা শুরু টাইগারদের। তারপর পশ্চিম আফ্রিকাকে ৯ উইকেট, ডেনমার্ককে ৫ উইকেট, আরব আমিরাতকে ১১০ রান ও মালয়েশিয়াকে ৫৯ রানে হারিয়ে ‘বি’গ্রুপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে চলে যাওয়া।
হংকংকে ৭ উইকেটে হারিয়ে শুভসূচনা। কিন্তু পরের ম্যাচেই বাধা। আইরিশদের মাত্র ১২৯ রানে অলআউট করেও বৃষ্টির বৈরি আচরণ, আইরিশদের অখেলোয়াড়চিত মনোভাব ও আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারির অদূরদর্শিতায় নিশ্চিত জয় হাতছাড়া।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে বৃষ্টির পর বাংলাদেশ ইনিংসের ৬.৪ ওভার (বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ২৪) পর খেলতে অস্বীকৃতি জানায় আইরিশরা। আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারি তা মেনে নিলে ম্যাচ পন্ড হয়ে যায়। এতে করে জয়ের বদলে মেলে এক পয়েন্ট। তাতেই হিসেবটা কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের।
তখন নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে জয় অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। হারলেই বাদ- এমন পরিস্থিতির মুখে মাঠে নেমে ফিল্ডিং সেশনটা ভালই কাটে। বাংলাদেশের সুনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখে ১৭১ রানে অলআউট হয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। মনে হচ্ছিল জেতা কঠিন হবে না মোটেও।
কিন্তু শুরুতেই কঠিন বিপদ। মাত্র ১৫ রানে ৪ টপঅর্ডার আতহার আলী (৪), নাইমুর রহমান দুর্জয় (০), সানেয়ার (০) ও আমিনুল বুলবুল (৪) আউট হয়ে গেলে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। ত্রাণকর্তার ভুমিকায় আকরাম খান। প্রথমে মিনহাজুল আবেনি নান্নুর (২২) সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে ৬২ আর পরে সপ্তম উইকেটে সাইফুলকে (১৮) নিয়ে ৫০ রানের দুুটি জুটি গড়েন আকরাম।
কঠিন বিপদে, প্রচন্ড চাপে এবং টুর্নামেন্ট থেকে ষষ্ঠবারের মত খালি হাতে ফেরার শঙ্কায় পড়ে অনমনীয় দৃঢ়তা দেখান বাংলাদেশ অধিনায়ক। সন্দেহাতীতভাবেই সংকটে, বিপদে ও চাপের মুখে ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন আকরাম। তার ৬৮ রানের (৯২ বলে) মহামূল্যবান ইনিংসে ভর করে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় জয়ের বন্দরে। এরই সাথে সেমিফাইনালও হয়ে যায় নিশ্চিত।
আকরামের অতি মানবীয় ও ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সংগ্রামী উইলোবাজির পাশাপাশি বৃষ্টিও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ ইনিংসের একপর্যায়ে বৃষ্টি চলে আসে। তাতে ২ ঘন্টা ৯ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল। আর সে কারণেই বৃষ্টির পর ৩৩ ওভারে ১৪১ রানের লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয় বাংলাদেশকে।
শুরুতে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসা দলের জন্য ১৭২ রানের টার্গেটই অনেক বড়। ওভার কমে গেলেও পরে ডিএল মেথডে কর্তিত ওভারে টার্গেটও ছোট হয়ে হয়ে। সেটা শাপে বরই হয়।
এরপরও বৃষ্টি ছিল টাইগারদের সঙ্গী। বৃষ্টিভেজা সেমিতে স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়ে ফাইনালে। আগের রাতের বৃষ্টিতে মাঠ ভিজে ছিল। খেলা শুরু হতে দেরি হয় বেশ। স্থানীয় সময় দুপুর ২.৪৩ মিনিট খেলা শুরু হয়। সে কারণে শুধু বাংলাদেশের ইনিংসই খেলা সম্ভব হয়।
খেলা গড়ায় রিজার্ভ ডে’তে। স্কটল্যান্ডের ইনিংস হয় পরদিন (৯ এপ্রিল)। খালেদ মাসুদ পাইলট (৭০) আর আমনুল ইসলাম বুলবুলের (৫৭) জোড়া ফিফটি আর মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর (৩১ বলে ৩৯*) কার্যকর ইনিংসে ভর করে ৭ উইকেটে ২৪৩ রানের বড় স্কোর গড়ে ওঠে।
দুই বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক (৪/২৫) ও এনামুল হক মণির (৩/৩১) সাঁড়াশি বোলিংয়ের মুখে ১৭১ রানে অলআউট হয়ে যায় স্কটিশরা।
পরে ফাইনালেও বৃষ্টি। প্রথমে ব্যাট করা কেনিয়া স্টিভ টিকোলোর অনবদ্য সেঞ্চুুরিতে (১৫২ বলে ১৪৭) দাঁড় করায় ৭ উইকেটে ২৪১ রানের সংগ্রহ। কেনিয়ার ইনিংস ভালোয় ভালোয় শেষ হলেও বাংলাদেশের ইনিংস শুরুর আগেই বৃষ্টি চলে আসে।
তারপর হেলিকপ্টার দিয়ে মাঠ শুকানো হয়। ফাইনাল গড়ায় পর দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। ডিএল মেথডে আকরাম বাহিনীর সামনে আইসিসি ট্রফি জিততে নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয় ২৫ ওভারে ১৬৬ রানের।
শেষ ওভারে ১১ রান দরকার থাকায় অবস্থায় খালেদ মাসুদ পাইলটের ঐতিহাসিক ছক্কা। আর শেষ বলে ১ রান দরকার থাকা অবস্থায় লেগ বাই থেকে জয়সূচক রান পাওয়া। শর্ট ফাইন লেগে বল যেতেই হাসিবুল হোসেন শান্ত আর খালেদ মাসুদ পাইলটের জয়সূচক রান নিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরা।
এআরবি/এসএএস/পিআর