গুরুর মুখে ‘ফুচকা বিক্রেতা’ ক্রিকেটারের জীবনের গল্প
‘এখন ওকে জানাবো, আমি যে ওর খেলা দেখতে এসেছি’- কথাগুলো বলছিলেন যুব ক্রিকেট বিশ্বকাপের উজ্জ্বল তারকা জশস্বি জাসওয়ালের কোচ ও পিতৃতুল্য গুরু জ্বলা সিং। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছেন ভারতীয় যুব দলের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পরপরই। বাড়তি চাপ পড়তে পারে ভেবে জানাননি প্রিয় শিষ্য জশস্বিকে। তবে জশস্বির সেঞ্চুরিতে ভারত ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করতেই জ্বলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, এবার জানাবেন তার উপস্থিতির কথা, ফাইনালের আগে কথা বলবেন প্রিয় শিষ্যর সঙ্গে।
মঙ্গলবার পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপের ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করেছে ভারত। ১১৩ বলে ৮ চার ও ৪ ছয়ের ১০৫ রানের ইনিংস খেলে জয়ের নায়ক ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেয়া ও মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা জশস্বি। এ ম্যাচটি মাঠে বসেই দেখেছেন জশ্বসির গুরু জ্বলা। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিলো না শিষ্যের। মূলত জশস্বি নিজেই জ্বলাকে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে বারণ করেছিলেন।
কিন্তু তর সইছিল না জ্বলার। ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল জেতার পরপরই চলে গিয়েছেন পচেফস্ট্রুমে, ভারতের সেমিফাইনাল ম্যাচের ভেন্যুতে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিপক্ষে নিজ দেশের খেলা দেখতে দেখতেই জ্বলা বলতে থাকেন, ‘জশস্বি দেশ ছাড়ার আগেই ওকে একটা ওয়াদা করিয়েছিলাম। আমি ওর কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলাম যে, বিশ্বকাপ শেষে সর্বোচ্চ রান যেন ওর হয়। আমিও ওয়াদা করেছিলাম, যদি এটা করতে পারে, তাহলে আমি ওকে একটা গাড়ি উপহার দেব।’
মঙ্গলবারের অপরাজিত সেঞ্চুরিটি, নিজের গুরুকে দেয়া ওয়াদা পূরণে অনেক পথ এগিয়ে দিয়েছে জশস্বি জাসওয়ালকে। এখনও পর্যন্ত ৫ ম্যাচে ৩ ফিফটি ও ১ সেঞ্চুরিতে ১৫৬ গড়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ৩১২ রান এসেছে তার ব্যাট থেকেই। যে ম্যাচে পঞ্চাশ পেরুতে পারেননি, সে ম্যাচে জয়ের জন্য লক্ষ্যই ছিলো মাত্র ৪২, তিনি অপরাজিত ছিলেন ২৯ রানে। বাকি চার ম্যাচের জশস্বির ব্যাট থেকে এসেছে ৫৯*, ৫৭, ৬২* ও ১০৫* রানের ইনিংস।
কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত নিজের সন্তানতুল্য শিষ্যের ব্যাটিং টিভিতেই দেখতে হয়েছে জ্বলাকে। সে চার ম্যাচে তিনবার পঞ্চাশ পেরিয়েই শতক ছুঁতে পারেননি জশস্বি। নিয়তির কী খেল! যেদিন স্বশরীরে মাঠে এলেন জ্বলা, সেদিনই কি না সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলকে ফাইনালে তুললেন ১৮ বছর বয়সী জশস্বি। খেলা দেখতে দেখতেই ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর প্রতিনিধিকে জ্বলা শুনিয়েছেন জশস্বির বেড়ে ওঠার গল্প, জানিয়েছেন কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সকল গুণ রয়েছে তার শিষ্যের মাঝে।
২০১৩ সালে জশস্বির বাবা নিজের ছেলের সকল দায়িত্ব ছেড়ে দেন জ্বলা সিংয়ের হাতে। সেদিনের পর থেকে জশস্বির কোচের চেয়েও বেশি কিছু হয়ে আছেন জ্বলা। তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন মুম্বাইয়ে। সময়ের সঙ্গে ক্রমেই জশস্বির পিতৃতুল্য চরিত্রে পরিণত হয়েছেন জ্বলা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮০তম রান নিতেই শ্রীলঙ্কার রাভিন্দু রাসান্থাকে ছাড়িয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে উঠে যান জশস্বি। তখন জ্বলার মুখে অশ্রুসিক্ত হাসি, নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান জশস্বিকে।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ঠিক যতটা আক্রমণাত্মক খেলে থাকেন জশস্বি, বিশ্বকাপে দেখা যাচ্ছে পুরো ভিন্ন রুপে। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে দুইটি ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে, একটি মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে আর অন্যটি মুম্বাইয়ের সিনিয়র দলের হয়ে। যা প্রমাণ করে আক্রমণাত্মক ক্রিকেটটাও বেশ ভালোই পারেন জশস্বি। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৯.৭২ স্ট্রাইকরেটে ৫৯, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৪.০২ স্ট্রাইকরেটে ৫৭ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭৫.৬০ স্ট্রাইকরেটে ৬২ রানের ইনিংসগুলো ঠিক চেনা জশস্বির সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না।
এমনটা হওয়ার কারণ জানালেন জশস্বির কোচ জ্বলাই। তার মতে মুম্বাই সিনিয়র টিম এবং ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দল- দুই জায়গায় জশস্বির দায়িত্ব দুইরকম। এ দায়িত্ব বুঝে ব্যাটিং করাটা জশস্বির মাঝে থাকা বড় ব্যাটসম্যান স্বত্তারই প্রমাণ। জ্বলার ভাষ্যে, ‘মুম্বাইয়ে ওর আশপাশে সবাই সিনিয়র ক্রিকেটার। যার ফলে স্বাধীনতা নিয়ে নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারে। কিন্তু এখানে ও জানে যে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা ওকেই রাখতে হবে। এ জিনিসটাই জশস্বিকে বিশেষ করে তুলেছে, সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা।’
এ কথার খানিক পরেই একটি শর্ট ডেলিভারিকে আলতো ছোঁয়ায় ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ব্যক্তিগত ফিফটির কাছে পৌঁছে যান জশস্বি। এ শট দেখে জ্বলার চোখেমুখে ঝিলিক দেখা যায়। খালি চোখে শটটা বিশেষ কিছু মনে হবে না। তবে জ্বলা শোনালেন শটটার বিশেষত্ব, ‘শটটা দেখলেন? এ জিনিসটা ওকে আলাদা করে রাখে। অন্য যে কোনো ব্যাটসম্যান হলে এই শর্ট ডেলিভারিতে পুল খেলতে চেষ্টা করতো। কিন্তু জশস্বি জানে, এখন যেহেতু রানরেটের চাপ নেই, তাই পুল খেলার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।’
শুধুমাত্র জ্বলার পক্ষেই সম্ভব জশস্বির ব্যাটিং এতো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা। কেননা এখন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এক ছাদের নিচে বসবাস করছেন তারা। মুম্বাইয়ে নিজের ক্রিকেট জীবন শুরুর সময় আজাদ ময়দানের তাবুতে থাকতেন জশস্বি। খেলার পাশাপাশি নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য সন্ধ্যার দিকে আজাদ ময়দানের সামনেই বিক্রি করতেন ফুচকা। কিন্তু যখন থেকে জ্বলার দরজা খুলে গেল জশস্বির জন্য, তখন থেকে দিনে অনুশীলন আর সন্ধ্যার পরে ক্রিকেটের আলোচনাই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র উপজীব্য।
‘বাড়িতে আমাদের একটা নিয়ম আছে। প্রতি সন্ধ্যায় ও আমাকে শরীর ম্যাসাজ করে দেয় এবং বলে যে সারাদিনে কী কী করবে। এমনকি আমি যদি ম্যাসাজ করার কথা বলতে ভুলেও যাই, ও নিজেই আমার কাছে চলে আসে। কারণ বাল্যকাল বলতে ঠিক কিছু নেই জশস্বির। যার ফলে বর্তমান সময়ে সহজেই উচ্ছনে চলে যেতে পারতো ও। তাই আমরা জীবনের প্রতিটা বিষয় একসঙ্গে আলোচনা করি। বোঝার চেষ্টা করি। তবে জশস্বির ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি শক্ত ও কঠিন কারণ আমি কখনওই ওকে সহজে কিছু দিয়ে দেইনি। এমনকি আইপিএলের নিলামের দিনও ওকে দোকানে পাঠিয়েছি বাজার করার জন্য।’
নিজের শিষ্যকে কীভাবে গড়ে তুলেছেন জ্বলা, তা বলতে থাকেন এক নিশ্বাসে, ‘কোনো প্রজন্মে মাত্র একজনই কিংবদন্তি হতে পারে। জশস্বির মধ্যে সেই ব্যাপারটা আছে। আর এটি অর্জন করতে আপনাকে সবসময় শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। অনেক খেলোয়াড় আছে যারা ভারতের হয়ে খেলেছে এবং ভালোও করেছে। কিন্তু কিংবদন্তি তো আর প্রতিদিন বের হয় না। আমি ওর মধ্যে এ বিষয়টাই ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। এখন ও বুঝতে শিখেছে, কোনো কিছু পেতে হলে মাথা সোজা রেখে লক্ষ্যপানে একাগ্রচিত্তে ছুটতে হবে।’
‘একবার একটা স্থানীয় টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো জশস্বি। সেখানে পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার রুপির চেক দেয়া হলো। সেটি নিয়ে আমার কাছে এসে বললো যে, একটা হেলমেট কিনতে চায়। এ কথা বলায় আমি ওকে অনুমতি দিলাম। হেলমেট কিনে ফিরে এসে আমাকে বললো- ৩ হাজার রুপি বেশি খরচ করে ফেলেছি আমি, আপনি কি আমাকে এই টাকাটা দেবেন? তখন আমি ওর ওপর প্রথমবারের মতো রাগ করলাম। হেলমেটটা ছিনিয়ে নিয়ে বললাম, একটা হেলমেটের জন্য ১৩ হাজার রুপি? এটা মানার মতো নয়। তুমি এটা তখনই ব্যবহার করতে পারবে, যখন এটার যোগ্য হবে?’
সে যোগ্যতা ঠিকই অর্জন করেছেন জশস্বি। আর সে কারণেই বয়স ১৯ পেরুনোর আগেই অভিষেক হয়েছে সম্মানজনক রঞ্জি ট্রফিতে, সুযোগ পেয়েছেন আইপিএলে খেলার। যেদিন রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হলো জশস্বির, সেদিন তিনি ফেরত পেয়েছিলেন ১৩ হাজার রুপির সেই হেলমেট। জ্বলা বলছিলেন, ‘আমি হেলমেটটা নিয়ে আলমারির ওপরে রেখে দিলাম, যাতে করে প্রতিদিন ও এটা একবার করে দেখে। পরে যেদিন রঞ্জিতে অভিষেক হলো, আমি নিজে ওকে হেলমেটটা হাতে তুলে দিলাম। সেদিনই আমি বুঝতে পারলাম, ওকে যদি নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয়, যে কোনোভাবে সেটি পূরণ করেই ছাড়বে।’
শুধু জশস্বিই নয়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে ভারতের আরেক তরুণ তারকা পৃথ্বি শ’রও কোচ ছিলেন জ্বলা। সমসাময়িক দুই ক্রিকেটারে গ্রেট ক্রিকেটারে পরিণত হওয়ার সকল টোটকাই শিখিয়েছেন জ্বলা। যা তাকে দেয় পরিপূর্ণ তৃপ্তি। তবে ব্যক্তিগত জীবনে জ্বলা নিজেও চেয়েছিলেন ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরি কেড়ে নিয়েছে তার সেই স্বপ্ন। বিনিময়ে দিয়েছে পৃথ্বি-জশস্বিদের মতো অমূল্য প্রতিভা। কিন্তু জশস্বিরা কী দিয়েছেন জ্বলাকে? এমন কথায় যেনো মুখের হাসি আরও চওড়া হলো জ্বলার। উত্তর দিলেন, ‘আপনি ওর জার্সি নম্বর দেখছেন? এটা ২৩ কেনো জানেন? কারণ আমার জন্মতারিখ ২৩! এর চেয়ে বেশি কীইবা চাইতে পারি আমি?’
খানিক আবেগাপ্লুত হয়ে জ্বলা বলতে থাকেন, ‘আমার মেয়ে হওয়ার আগে জশস্বিই ছিলো একমাত্র সন্তান। এখন আমার মেয়ের বড় ভাই সে। এমনকি আমার মেয়েও জশস্বির জন্য সৌভাগ্যবান। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর আমার মেয়ের জন্ম, সেদিন মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকায় জশস্বি। বর্তমানে ও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। আমি যখন ওকে বলেছিলাম, যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলে গাড়ি উপহার দেব। তখন আমাকে উল্টো বললো, আপনি নতুন গাড়ি নিয়েন। আমাকে আপনার পুরনো ব্রেজা গাড়িটা দিয়েন।’
কোচ এমন কথা বলার খানিক পরেই পাকিস্তানের স্পিনার আমির আলিকে স্লগ সুইপ করে সেঞ্চুরি পূরণ করেন জশস্বি। যা দেখে দুই হাত ছড়িয়ে, আকাশপানে তাকিয়ে, প্রশান্তির হাসি মুখে নিয়ে নীরব প্রার্থনা শেষে জ্বলা বলেন, ‘এখন ওকে জানাবো, আমি যে ওর খেলা দেখতে এসেছি।’
এসএএস/এমএমআর/এমএস