খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই রেকর্ড জুটির গল্প
টেস্ট এবং ওয়ানডেতে বেশ কিছু ভাল ইনিংস আছে তার। ম্যাচ সেরার পুরস্কারও পেয়েছেন কয়েকবার। ঘরের মাঠে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইমরুল কায়েসই বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি দুই ম্যাচে সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কিন্তু টেস্টে এমন এক পারফরমেন্স আছে, যা তাকে রীতিমত স্মরণীয় করে রেখেছে। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে নিজের নামকে সোনালী হরফে লিখে রেখেছেন ইমরুল কায়েস।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাস যতদিন থাকবে, তার ওই ইনিংসের কথাও তত দিন থাকবে। অবশ্য ইমরুল কায়েসের একার কৃতিত্ব নয় সেটা। আসলে একটি সফল, স্বার্থক, কার্যকর আর সময়োচিত জুটির গল্প সেটা। যার নায়ক দু’জন। একজন তামিম ইকবাল, অন্যজন ইমরুল কায়েস।
সময়কাল ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ২মে। খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ধুঁকছিল বালাদেশ। প্রায় হারের রাস্তায় পৌঁছে গিয়েছিল তারা। ৩২৮ রানে প্রথম ইনিংস শেষ করা টাইগাররা তখন ২৯৬ রানের বড় ব্যবধানে পিছিয়ে।
প্রথমতঃ ইনিংস পরাজয়ের শঙ্কা এসে গ্রাস করেছিল। যা এড়াতে দরকার ছিল ২৯৭ রানের। তার চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ম্যাচ বাঁচানো। সব মিলিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। জটিল সমীকরণ। গভীর সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে হাবুডুবু খাওয়ার মত অবস্থা।
এমন অবস্থায় চাপের মুখে দুই পাকিস্তানি দ্রুত গতির বোলার জুনায়েদ খান ও ওয়াহাব রিয়াজ এবং লেগ স্পিনার ইয়াসির শাহ’র বোলিং মোকাবিলা-সহজ কাজ ছিল না মোটেই। অতিবড় বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকও ম্যাচ বাঁচানোর আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঠিক এমন অবস্থায় দ্বিতীয় ইনিংসে শক্ত হাতে হাল ধরেন তামিম আর ইমরুল।
চতুর্থ দিন প্রথম সেশনে ৮০ মিনিট পর থেকে শুরু। ওই দিনের বাকি সময়ে ৬১ ওভারে অবিচ্ছিন্ন ২৭৩ রান তুলেই ম্যাচ বাঁচানোর পথে অনেকদুর এগিয়ে গিয়েছিল তারা দু’জন। এরপর পঞ্চম ও শেষ দিনে আরও এক ঘণ্টা উইকেটে কাটিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ৩১২ রানের উদ্বোধনি জুটিও গড়ে ফেললেন তামিম-ইমরুল। যা এখন পর্যন্ত প্রথম উইকেটে টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে পার্টনারশিপ। আর যে কোন উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
প্রায় ৩০০ রানে (২৯৬) পিছিয়ে থাকা অবস্থায় পাল্টা ব্যাটিংয়ে নেমে যতটা সম্ভব ইস্পাত কঠিন মনোবল, অসীম সাহস আর দৃঢ় প্রত্যয়ে খেলা সম্ভব, তামিম-ইমরুল পাকিস্তানি বোলিং আক্রমণ সামলে ঠিক ওভাবে ঘুরে দাঁড়ান। এতটুকু ভয়-ডর না রেখে সর্বোচ্চ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসে পাকিস্তানি বোলিংয়ের মোকাবিলা করেন তারা।
প্রথম উইকেটেই ৩১২ রানের জুটিতে তামিম ইকবাল ডাবল সেঞ্চুরি করেন। ইমরুলও কম যাননি। তিনি বড় ইনিংস হাঁকিয়ে বসেন। তার ব্যাট থেকে আসে ১৫০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। তাতেই ইনিংস পরাজয়ের শঙ্কা উবে যায়। ম্যাচ হারের শঙ্কা থেকে বাংলাদেশ উল্টো পায় এক বীরোচিত ড্রয়ের স্বাদ।
তামিম-ইমরুলের অসামান্য দৃঢ়তা, বুক চিতানো লড়াই আর কঠিন সংগ্রামী ব্যাটিংয়ের প্রশংসায় মাতে গোটা দেশ। ক্রিকেট বিশ্বও। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে, বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম-ইমরুল নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে খাদের কিনারায় পড়ে গিয়েও সাহস, আস্থা আর আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে প্রাণপন লড়াই করে গেলেন।
প্রায় একদিন, তিন সেশন উইকেটে কাটিয়ে দেন। ৩১২ রানের রেকর্ড জুটিতেই পরাজয় এড়িয়ে বীরের মত ম্যাচ ড্র করার দাওয়াই পায় বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটে যে কোন জুটিতে বাংলাদেশের ৩০০ প্লাস জুটি আছে মোটে দুটি। যার প্রথমটির স্রষ্টা তামিম-ইমরুল। আর পরেরটি সাকিব আল হাসান (২১৭) ও মুশফিকুর রহীমের (১৫৯)। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে ৩৫৯ রানের ইনিংস খেলেন তারা দু’জন।
সংখ্যাতত্তে সাকিব ও মুশফিকের পার্টনারশিপ অনেক বড়। আর নিউজিল্যান্ডের কনকনে ঠান্ডা, প্রচন্ড বাতাসের সীমিং কন্ডিশনে টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, নেইল ওয়াগনার, কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের ধারালো ও শক্তিশালী বোলিংকে মানদন্ড ধরলেও সাকিব ও মুশফিকের সাড়ে তিনশোর বেশি রানের পার্টনারশিপকে এগিয়ে রাখতে হবে।
তবে কঠিন সত্য হলো, ওয়েলিংটনে ওই বিরাট জুটিও শেষ পর্যন্ত বিফলে। জেতা বহুদুরে, বাংলাদেশ ম্যাচও বাঁচাতে পারেনি। হেরেছে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে; কিন্তু তামিম আর ইমরুলের জুটি ম্যাচের প্রেক্ষাপট, পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে সন্দেহাতীতভাবেই এক নম্বর। সেরাও।
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের আগে সেই জুটির বীরোচিত নৈপুণ্যের কথাই সবার মুখে মুখে। এবার ইমরুল নেই। তামিম আছেন। আর কাউকে নিয়ে কি এমন একটি জুটি গড়ে তুলতে পারবেন তামিম?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম