সেই জোবায়ের লিখন এখন নেট বোলার!

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:৪০ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৯

নজরুল কাদের লিন্টু যদি হন সব সময়ের সেরা বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার, তাহলে সাকিব আল হাসান আর মোহাম্মদ রফিকই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা বাঁহাতি স্পিনার। আচ্ছা বলুন তো বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা লেগস্পিন-গুগলি বোলার কে?

সত্তর-আশির দশকে ক্রিকেট অনুরাগীরা বলবেন, কেন? ওয়াহিদুল গনিই তো। লেগস্পিন, গুগলি, ফ্লিপার সবই ছুড়তে পারতেন ওয়াহিদুল গনি। তবে বর্তমান প্রজন্ম অবশ্য তাকে দেশসেরা লেগির চেয়ে ব্যাটিং প্রতিভা মোহাম্মদ আশরাফুল, কেতাদুরস্ত নাফিস ইকবাল আর তুখোড় পেসার মোহাম্মদ শরীফদের কোচ হিসেবেই বেশি চেনে।

তবে এ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের সেরা লেগস্পিনার মানেই জোবায়ের হোসেন লিখন। ওয়াহিদুল গনির তুলনায় উচ্চতায় অনেক খাট । কিন্তু লেগস্পিনটা বেশ ভালই করতেন জামালপুরের জোবায়ের লিখন। একজন লেগস্পিনারের যতরকম অস্ত্র থাকার কথা, তার প্রায় সবকটা অস্ত্রই আছে লিখনের। লেগস্পিন, গুগলি, ফ্লিপার সব।

জোবায়ের লিখনের মাঝে ছিল অমিত সম্ভাবনা। চার বছর আগে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে লিখনের গুগলিতে বিরাট কোহলির বোল্ড হবার দৃশ্যটি এখনো অনেকের স্মৃতিতে ভাস্বর। একবার মনের আয়নায় গিয়ে দাঁড়ান। দেখবেন ঠিক ভেসে উঠছে জোবায়ের লিখনের ছোড়া গুগলিতে কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড ভারত তথা সময়ের সেরা উইলোবাজ বিরাট কোহলি।

লেগস্পিন ছুড়ে আগের বলে কভার দিয়ে বাউন্ডারি হজম করা লিখন, বিরাট কোহলিকে পরের ডেলিভারিটি ছুড়েছিলেন গুগলি। তা ঠিক না ঠাউরে লেগস্পিন ভেবে আগের বলের মত কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান বিরাট।

ঐ একটি আউটের দৃশ্য লিখনের বোলিং সামর্থ্যের বড় প্রামাণ্য দলিল, বড় বিজ্ঞাপন। যে বোলার তার ক্যারিয়ারের মাত্র চার নম্বর টেস্টে বিরাট কোহলির মত ঝানু ও বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানকে ঘোলপানি খাওয়াতে পারেন, তিনি না জানি আরও কী করে ফেলবেন? আরও বড় চমক উপহার দেবেন?

অতি বড় সমালোচকও ভেবেছিলেন লিখন অনেক দূর যাবেন। হয়তো ২০০-৩০০ টেস্ট উইকেট শিকার করে ফেলবেন। কিন্তু হায়, সেই মেধাবি ও সকল গুণে গুণান্বিত লেগস্পিন গুগলি বোলার লিখন অনেক দূর যাওয়া বহু দূর, কিছু দূরও যেতে পারেননি। টেস্টে ২০০-৩০০’তো অলিক কল্পনা। মোটে ২০ উইকেট শিকারিও নন। ৬ টেস্টে উইকেট মোটে ১৬ টি। আর ৪ ওয়ানডেতে নামের পাশে ৬টি মাত্র। একটি মাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে উইকেটও ঠিক ১টিই।

পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে খুব অল্প সময় জাতীয় দলে ছিলেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে রাজধানী ঢাকায় জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্ট অভিষেক হওয়া লিখনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৩ মাস। ২০১৫ সালের জুলাই-আগস্টে শেরে বাংলায় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ টেস্ট খেলার পর ঐ বছরই নভেম্বরের ১৩ তারিখ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে শেষ ম্যাচটি খেলেন লিখন। সেটি ছিল টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।

তারপর কেটে গেছে প্রায় ৪ বছর কিন্তু জাতীয় দলে খেলা হয়নি লিখনের। জাতীয় দল বহু দূরে এ দল, হাই পারফরমেন্স ইউনিট আর একাডেমি দলেও জায়গা মেলে না।

মাঝে একবার ‘এ’ দলের হয়ে আয়ারল্যান্ড সফরে গেলেও তারপর আর খবর নেই। জাতীয় দল, ‘এ’ দল, একাডেমি, এইচপি আর ইমার্জিং দলই শুধু নয়, ঢাকা লিগ, জাতীয় লিগ ও বিপিএল-বিসিএল কোনটায়ই সেভাবে সুযোগ পান না লিখন।

কোথাও না থাকার কারণে মাঝে তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন অনেকে। তবে সেই প্রতিভাবান ও পরিপূর্ণ লেগস্পিনার জোবায়ের লিখনের দেখা মিললো জাতীয় দলের নেটে। ভাববেন না আফগান বধে বুঝি দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলে ডাকা হয়েছে তাকে।

likhon

নাহ, জাতীয় দলে ডাক পাননি। ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহীমের নেট বোলার হিসেবে সোমবার শেরে বাংলায় দেখা মিললো লিখনের। আজ দুপুরে প্রচন্ড খরতাপেও একটানা প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি বোলিং করলেন লিখন। তার লেগস্পিন, গুগলি আর ফ্লিপারগুলো বেশ সমীহ দেখিয়েই খেললেন মুশফিক।

উলকার বেগে এসে হঠাৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া। আজ কোন ফরম্যাটে কোথাও নেই। জাতীয় দলের নেট বোলার! ভাবা যায়? এমন তো হবার কথা ছিল না! তার তো প্রতিভা, মেধায় ঘাটতি ছিল না। তবে কেন এমন হলো? তার প্রায় একই সময় টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করা বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ২৪ টেস্টে ১০০ উইকেটের দোরগোড়ায় (৯৯) দাঁড়িয়ে। অনেক পরে এসে মেহেদি মিরাজও ১৯ টেস্টে ৮৮ উইকেট ঝুলিতে পুরে ফেলেছেন।

অথচ লিখন আজ কোথাও নেই। কেন এমন হলো? যার আজ সাকিবের সঙ্গে টেস্টে বড় বোলিং অস্ত্র হিসেবে থাকার কথা তিনি আজ কেন নেট বোলার? পর্যাপ্ত মেধা থাকার পরও কেন লিখন এখন কোথাও নেই? এ প্রশ্ন অনেকের।

তার উত্তর খুঁজতেই দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু আর হাবিবুল বাশারের শরণাপন্ন হওয়া। জাতীয় দলের এ দুই সাবেক অধিনায়কের কেউ দায় নিতে নারাজ। দুজনারই কথা, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। মাঝে একবার ‘এ’ দলের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড পাঠানো হয়েছে। এখন লিখন কেন কোথাও নেই, কেন ক্লাব ক্রিকেটে খেলার সুযোগ মেলে না । তা আমরা কী করে বলবো? এখন কোন দল যদি তাকে নিতে না চায়, সেখানে আমাদের করার কী আছে?’

লিখন নিজে কী ভাবছেন? কেন এমন হলো? সে প্রশ্নের জবাব নেই তার কাছেও। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘আল্লাহ ভরসা। এবার চেষ্টা করবো সর্বাত্মক।’ বয়স কম, মোটে ২৩। বিশ্বাস আর আস্থা হারাননি। এখনও মনে করেন ফিরে আসা সম্ভব।

মুশফিকুর রহিমের মত ‘চুজি’ আর ‘পারফেক্টশনিস্ট’ উইলোবাজ তাকে অতক্ষণ একটানা নেটে খেলেছেন। বাজে জায়গায় বল ফেললে, আলগা ডেলিভারি আর টার্ন করাতে না পারলে নিশ্চয়ই খেলতেন না।

যে লেগস্পিনার ভাদ্রের ঝাঝালো রোদ আর গলা শুকিয়ে আসা উষ্ণতায় এখনও নেটে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় মুশফিকের মত ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে একটানা নিখুঁত লাইন ও লেন্থে বল করতে পারেন, তিনি যে ফুরিয়ে যাননি, তার যে এখনও আরও কিছু করার ও দেয়ার আছে- দর্শকশূন্য শেরে বাংলার সেন্টার উইকেটে নেটেও সে সত্য জানান দিলেন লিখন।

এআরবি/এসএএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।