শ্রীলঙ্কায় ব্যর্থতার কারণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন লিপু-ইমরান
সন্দেহের মেঘের আনাগোনা টের পাওয়া যাচ্ছিল। হ্যাঁ, না, আবার হ্যাঁ করে যখন জাতীয় দল শ্রীলঙ্কা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো; ঠিক তখনই টাইগারদের ভাগ্যাকাশে খানিক কালো মেঘের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলেন কেউ কেউ।
বিশ্বকাপের মত মহা আসরের ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে জাতীয় দল কতটা কি করতে পারবে, বিশ্বকাপের সেই বর্ণিল আর মাঠ মাতানো পারফরমেন্সের পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে খানিক সংশয় ছিলই।
তার ওপর বিশ্বকাপ মাতানো ব্যাট ও বল হাতে সামর্থ্যের সেরা ক্রিকেট উপহার দেয়া সাকিব আল হাসান নেই। ঠিক দেশ ছাড়ার আগের দিন পড়ন্ত বিকেলে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়া আরও এক বড় ধাক্কা। এর সাথে লিটন দাসের বিয়ে আর কার্যকর পেসার সাইফ উদ্দীনের ইনজুরির কারণে খেলতে না পারা।
সব মিলে ভাঙাচোরা দল। সেই মে‘র প্রথম সপ্তাহে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে তিন জাতি টুর্নামেন্ট খেলতে যাবার আগে থেকে দীর্ঘ দিনের প্রায় একটানা অনুশীলন। আজ এখানে, কাল ওখানে আর পরশু আরেক শহরে ভ্রমণ, এক শহরে ভ্রমণ ক্লান্তি আর ম্যাচ খেলার ধকল কাটতে না কাটতে আরেক শহরে ছুটে যাওয়া এবং সাথে বিশ্বকাপের শারীরিক ও মানসিক চাপ-সব মিলে টাইগাররা প্রায় অর্ধেক শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিল শ্রীলঙ্কায় ।
তাই শ্রীলঙ্কায় ভাল কিছুর সম্ভাবনা কম ছিল। তবে পারফরমেন্স একটু বেশিই খারাপ হয়েছে। কলম্বোয় লঙ্কানদের সাথে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে তামিম ইকবালের দল। এর সঙ্গে অনেকগুলো নেতিবাচক দিকও বেরিয়ে এসেছে।
প্রতি ম্যাচেই পারফরমেন্সের গ্রাফ নিচে নেমেছে। প্রথম ম্যাচে ৯১ রানে হার, দ্বিতীয় খেলায় ৭ উইকেটে আর তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে গিয়ে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে ১৭২ রানে অলআউট আর ১২২ রানের বড় পরাজয়। প্রিয় জাতীয় দলের এই বেহাল অবস্থা দেখে ভক্ত-সমর্থক, অনুরাগি-সবাই হতাশ।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো নেতিবাচক অবস্থা ও দিক নিয়ে বিশ্বকাপের পর এ সিরিজ খেলতে যাওয়া কতটা যৌক্তিক ছিল? এ সিরিজের যৌক্তিকতার পাশাপাশি এখন তিন তিনটি ওয়ানডে খেলা আদৌ জরুরী ছিল কিনা? সে প্রশ্নও উঠছে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আর সিনিয়র কোচ সারোয়ার ইমরান জাগো নিউজের সাথে এ সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শ্রীলঙ্কায় এ সময় ওয়ানডে সিরিজ খেলতে যাওয়াকে অসময়োচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেন, ‘জরুরী ছিল কিনা, তা বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয় না, বিশ্বকাপের পর এ সময়ে শ্রীলঙ্কায় তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে যাবার তেমন কোনো যৌক্তিকতা ছিল। এ সিরিজ পরে আয়োজন করা যেতো।’
দেশের ক্রিকেটের অন্যতম উজ্জ্বল তারকা লিপু বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি প্রধানের মত গুরুত্বপূর্ণ পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিপু বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি লঙ্কান বোর্ড হয়তো অনুরোধ করে থাকবে। শ্রীলঙ্কায় ঘটা প্রাণঘাতী হামলার পর সে দেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার মত অবস্থা আছে, সেটা প্রমাণের জন্যই হয়ত লঙ্কান বোর্ড মরিয়া হয়ে কোন টেস্ট খেলিয়ে দলকে তাদের দেশে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যেহেতু লঙ্কান বোর্ড আমাদের পুরনো ও পরীক্ষিত মিত্র, তাই বিসিবির জন্য হয়তো তাদের অনুরোধ উপক্ষো করা কঠিন ছিল। তবে এক্ষেত্রে সরাসরি 'না' বলে না দিয়ে সময় বদলে পরে খেলা যেতো।’
লিপু যোগ করেন, ‘বিশ্বকাপের ক্লান্তি-অবসাদ, মানসিক চাপ কতটা। তা নিরুপনে কোচ, ফিজিও, ট্রেনারসহ সব এক্সপার্টদের মতামত নেয়া যেতো। জাতীয় দলের ফিটনেস লেভেল ঠিক কোন মাত্রায় ছিল, তারা কি বিশ্বকাপের ধকল আর মানসিক চাপ নিয়ে খেলার মত অবস্থায় ছিলেন কিনা। এটা দলের সাথে থাকা ট্রেনার, ফিজিওসহ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া যেতো। তারা একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পারতেন।’
সাবেক এই অধিনায়ক আরও বলেন, ‘তখন কার কি অবস্থা, কে ফিট, কে আনফিট আর কার সত্যিকার শারীরিক অবস্থা কেমন, কার ফর্ম ভাল, কে আউট অফ ফর্ম-সেগুলোও জানা যেতো। আমার মনে হয় তখনি বোঝা যেতো, জানা যেতো দলের সত্যিকার চিত্র কি। আমি মনে করি যেহেতু ক্রিকেট এখন অনেক বেশি পেশাদারিত্বে ভরা। সেই পেশাদার ব্যবস্থাপনায় জাতীয় দলের ফিটনেস ও ফর্ম পরখ করার জন্য দলের সাথে থাকা এক্সপার্টদের মতামত নিয়ে তারাই হয়তো না করে দিতেন। তাতে করে এমন ভাঙাচোরা অবস্থায় যেতে হতো না। পরে দেখে শুনে ভাল মত প্রস্তুতি নিয়ে পরে পূর্ন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে খেলা যেতো। আমার মনে হয় না, তাতে করে পারফরমেন্স এমন খারাপ হতো।’
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক লিপুর অনুভব ও উপলব্ধি, সেই আয়ারল্যান্ডের মাটিতে তিন জাতি আসর থেকে শুরু হয়েছে। বিশ্বকাপে আট আটটি ম্যাচ। তারপর শ্রীলঙ্কা সফর। খেলোয়াড়দের চোট সমস্যাও ছিল, মনে করছেন তিনি, ‘ভেতরের ইনজুরির কথা বাদ দিলাম। খালি চোখে দেখা গেছে প্রায় প্রত্যেক ক্রিকেটারের হাতে, তালুতে না হয় আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ। একজন ক্রিকেটার হাতে, আঙ্গুলে আর তালু ও কব্জিতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ভাল ফিল্ডিং করতে পারে না। লং ক্যাচ বা ক্লোজ ইন পজিশনে ক্যাচ ধরাও সহজ না। সব সময় ভিতরে একটা কাটার মত বিঁধে। এই বুঝি আঘাত পাওয়া জায়গায় বল এসে লাগে। তাই হাত ফস্কে ক্যাচ বেরিয়ে গেছে। ফিল্ডিংটাও ভাল হয়নি। প্রচুর মিস ফিল্ডিং হয়েছে। এবং তার চড়া মাশুলও গুনতে হয়েছে।’
দেশের অন্যতম সিনিয়র সক্রিয় প্রশিক্ষক সারোয়ার ইমরান মনে করেন, শ্রীলঙ্কা সফরটি শুরু থেকেই ছিল ঝুকিপূর্ণ। তার ব্যাখ্যা, ‘আমি নিরাপত্তার আলোকে ঝুকিপূর্ণ বলিনি। আমি জেনে বুঝেই বলছি, বিশ্বকাপের সেই আগে ডাবলিনে তিন জাতি খেলার আগে থেকে ক্রিকেটাররা অনুশীলনে। তার সাথে সেখানে চার পাঁচটি ম্যাচ খেলা এবং বিশ্বকাপের আগে ওয়ার্মআপসহ প্রায় ১০ টি ম্যাচ খেলা-সব মিলে ক্রিকেটাররা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ক্লান্ত ও অবসন্ন।’
দলের সিনিয়র দুই খেলোয়াড়ের কথা আলাদা করে তুলে ধরে ইমরান বলেন, ‘আমার মনে হয় মুশফিকুর রহীম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও ইনজুরি আক্রান্ত। আমার তাদের দেখে পুরোপুুরি সুস্থ ও শতভাগ ফিট মনে হয়নি। এ সময় খেলার চেয়ে মুশফিক-রিয়াদসহ পুরো দলের বিশ্রামটাই ছিল বেশি প্রয়োজন। তাতে করে ক্লান্তি আর অবসাদ কাটতো। সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতো। অফফর্মের প্লেয়ারদেরও সামনে থাকতো ফর্মে ফেরার সুযোগ। তারা ঘষে মেজে ও ঝালাই করতে পারতেন। আমার মনে হয় সেটাই বেশি ভাল হতো।’
এআরবি/এমএমআর/এমএস