এত ভালো খেলার তাড়না রহস্য হিসেবেই রাখলেন সাকিব

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা লন্ডন থেকে
প্রকাশিত: ১১:০৯ এএম, ০৭ জুলাই ২০১৯

কে বলে সাকিব প্রচার মাধ্যমকে এড়িয়ে চলে? সাকিব মিডিয়া ফ্রেন্ডলি না! এ অভিযোগের ভিত্তি কী? সাকিব যদি সত্যিই মিডিয়াকে পাশ কাটিয়ে বা সযত্নে এড়িয়েই চলবেন, তবে দিনে দুই দুইবার দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন কি?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সাকিব বুঝি একবার টিভি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে আর অন্যবার প্রিন্ট-অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। সাকিব দুইবার দুইসময়ে সকলের সঙ্গেই কথা বলেছেন। প্রথমবার লন্ডন সময় শনিবার বেলা ১২টার দিকে। আর পরেরবার পৌনে ৮টার দিকে। বাংলাদেশে তখন গভীর রাত (প্রায় মধ্যরাত পৌনে ১ টা)।

গতকাল সারাদিন এদিক-ওদিকে বেড়িয়েই সময় কেটেছে সাকিবের। দুপুরে টিম হোটেল রয়্যাল লেঙ্কাস্টারের বাইরে স্বদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে একান্তে কথা বলার পর আবার জাতীয় দলের বহর টিম হোটেল ছেড়ে হিত্রো বিমান বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করার পর এক ঘণ্টা সময় আবার কথা বললেন এবারের বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরি আর পাঁচ হাফ-সেঞ্চুরিতে ৬০৬ রান করা সাকিব।

তবে সাকিবের দুইবারের কথোপকথনে একটি কথাই ফুটে উঠেছে। আর তা হলো, সাকিব এবারের বিশ্বকাপে নিজেকে মেলে ধরতে ছিলেন শতভাগ নিবেদিত প্রাণ। কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ওজন কমিয়েছেন অন্তত ৫-৬ কেজি। শরীরে এমনিতেই মেদ নেই। তার ওপর ৩০ বছরের পর যা একটু চর্বি লাগতে শুরু করেছিল, হায়দ্রাবাদে মেন্টর-গুরু সালাউদ্দীনের সঙ্গে একান্তে প্র্যাকটিস করে তা ঝেড়ে ফেলে একদম সতেজ-তরতাজা হয়ে উঠে বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিলেন তিনি। এবং একটা পণ করেই সব ম্যাচ খেলেছেন তিনি- আমাকে ভাল খেলতেই হবে, নিজেকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

সাকিবের সে পণ রক্ষা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ৪১ রানে ক্যাচ আউট হওয়া ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, ভারত আর পাকিস্তানের বিপক্ষে ঠিক পঞ্চাশের ওপরে রান করেছেন। বাংলাদেশ যে তিন ম্যাচ জিতেছে সেই দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাকিবই ছিলেন জয়ের রুপকার, স্থপতি আর ম্যাচ সেরা।

কিন্তু দুর্ভাগ্য সাকিবের। এত চেষ্টা করেও তিন দলকে সেমিফাইনালে নিতে পারেননি। তাই আক্ষেপ নিয়েই শেষ হয়েছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের এবারের বিশ্বকাপ।

তো সাকিব নিজে কীভাবে এবারের বিশ্বকাপে নিজের পারফরম্যান্সকে মূল্যায়ন করছেন? কতটা সন্তুষ্ট নিজের ওপর? দলের শেষ চারে পৌঁছাতে না পারা দূর্ভাগ্যজনক কিনা? হলে তা নিয়ে আক্ষেপ কতটা? এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন।

আসুন শোনা যাক সাকিবের সেই উত্তরগুলো :

প্রশ্ন : এবারের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?

সাকিব : ব্যক্তিগত দিক থেকে খুবই ভালো, খুবই খুশি। যে ধরনের মন-মানসিকতা নিয়ে এসেছিলাম, যে ধরনের ইচ্ছ ছিল, যেমন তাগিদ ছিল, তা পূর্ন হয়েছে। সেদিক থেকে সন্তুষ্ট।

প্রশ্ন : এত ভালো খেলার পেছনের রহস্য কী? কোনো বিশেষ কারণে বাড়তি উদ্যমী ছিলেন?

সাকিব : আগের প্রতিটি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রান ছিল। কিন্তু পরে আর সেভাবে করতে পারিনি। আর এবার প্রথম খেলা থেকেই ভালো কিছু হবে বলে মনে হচ্ছিল। আগেরবার শুরুতে রান পেয়েও পরে সে ধারাবাহিকতা রাখতে পারিনি। সেটাও মাথায় ছিল। সেদিক থেকেও একটা তাগিদ ছিল যে , শুরুতে মোমেন্টাম পাওয়ার পর যেন সেটা ধরে রাখতে পারি।

প্রশ্ন : আপনার পারফরম্যান্স, অর্জন ৬০০+ রান কি অবাক হবার মত? এত ভাল খেলায় কি নিজেই বিস্মিত হয়েছেন?

সাকিব : না, নিজে অবাক হয়নি। কারণ আমি জানি আমি কি চিন্তা করে এসেছিলাম।

প্রশ্ন : সেমিফাইনাল খেলতে না পারা দুর্ভাগ্যের কিনা?

সাকিব : এটা নিয়ে সেভাবে চিন্তা করি না। অবশ্যই সেমিফাইনালে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আমাদের ছিল। তবে সেসব নিয়ে তো আমি কখনোই চিন্তা করি না।

প্রশ্ন : ফিটনেস কেমন ছিল?

সাকিব : সবশেষ দুটি ম্যাচে মানসিকভাবে ক্লান্ত মনে হয়েছে নিজের কাছে। তার পরও ফিটনেস লেভেল ভালো ছিল বলে আমাকে সাহায্য করেছে। হয়তো মাঝখানে দু-একটি দিন ফিটনেস নিয়ে কাজ করলে আরেকটু ভালো হতো। কিন্তু তাতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগও ছিল। দুইটিকে ব্যালান্স করতে পারা কঠিন ছিল। সেদিক থেকে শেষ দুটি ম্যাচ একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল।

প্রশ্ন : কোন ম্যাচে রান করা বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল?

সাকিব : আফগানিস্তানের বিপক্ষে রান করতে সবচেয়ে কষ্ট করতে হয়েছে। ওদের যে ধরনের কোয়ালিটি স্পিনার ছিল ও যে ধরনের উইকেটে খেলেছি, সেটিই মূল কারণ।

প্রশ্ন : আর সবচেয়ে ভাল লেগেছে কোন ইনিংসটি?

সাকিব : খুব পছন্দের ইনিংস বলতে হয়, তাহলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংস। সবক'টিই তো ভালো লাগার, তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসটি পছন্দের।

প্রশ্ন : বিশ্বকাপের আগের প্রস্তুতিটাই কি এত ভাল খেলার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে?

সাকিব : বলা মুশকিল। কিন্তু মনে হয়েছে এটাই গুরুত্বপূর্ন কারণ। ভালো হয়েছে যে বিশ্বকাপে আসার আগে এটা মনে হয়েছে এবং ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পেরেছি।

প্রশ্ন : বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে এত ভাল খেলার পর নিজেকে কি বিশেষ স্তরের পারফরমার মনে হচ্ছে?

সাকিব : নিজেকে কোনো লেভেলেই দেখছি না। যখন এগুলো নিয়ে কথা হয়, অবশ্যই ভালো লাগে। নিজের পারফরম্যান্স নিয়েও আমি খুশি। তবে এসব নিয়ে সেভাবে চিন্তা করি না।

প্রশ্ন : এবার এত ভালো খেলার তাড়না অনুভব করলেন, কোন বিশেষ কারণ?

সাকিব : (মৃদু হেসে) কিছু জিনিস রহস্য থাকা ভালো। নইলে সেটি হারিয়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন : দলের বাকিদের পারফরম্যান্স কেমন ছিল?

সাকিব : মাঠে সবাই সবার দিক থেকে শতভাগ দেয়। বাইরে থেকে অনেক সময় অনেকরকম লাগতে পারে। কিন্তু ভেতরে সবাই সেরাটাই দেয়। এগুলো আসলে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে আমি নিশ্চিত যে সবাই যার যার জায়গা থেকে সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছিল।

প্রশ্ন : ফিল্ডিং কেমন ছিল? ক্যাচ ড্রপ হয়েছে বেশ কিছু। এগুলো নিয়ে অনেক বেশি কথাও হয়েছে। সে সম্পর্কে আপনার মত কি?

সাকিব : এগুলো আসলে আলোচনা করার ব্যাপার আমাদের ড্রেসিং রুমে। মিডিয়াতে নয়। যদি এরকম আলোচনার সুযোগ আসে, আমার কথা বলার সুযোগ আসে, আমি এসব বলতে চাই টিম মিটিংয়ে।

প্রশ্ন : সেমির আক্ষেপ?

সাকিব : অবশ্যই আক্ষেপ আছে, দলের দিক থেকে। কারণ আমাদের লক্ষ্যই ছিল সেমিফাইনালে খেলা। লক্ষ্য যখন অর্জন হবে না, আক্ষেপ তো থাকবেই। কাজেই আক্ষেপতো আছেই। তবে আমি পারফর্ম করলাম, অথচ দল পারলো না সেটা নিয়ে আক্ষেপ নেই আমার। আক্ষেপের জায়গাটা ভিন্ন আমার। আমার আক্ষেপ হলো, যে দল হিসেবে খেলতে চেয়েছিলাম আমরা, সেটি পারলাম না বা হলো না। কিংবা বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি ঠিকভাবে পূরণ করতে পারলাম না। এ অনুশোচনা রয়েই গেল।

প্রশ্ন : বিশ্বকাপ কি তাহলে শুধু বড় দলের জন্য?

সাকিব : একটু রসিকতা করে ট্রফি দরকার... সেটা বলা মুশকিল। ট্রফি সব দল পায় না। কিন্তু ট্রফি না পেলেও বড় দল হয়। ইংল্যান্ড তো মনে হয় বিশ্বকাপ জেতেনি, তবু ওরা বড় দল। ওরকম একটা কিছু থাকলেও চবলে।

প্রশ্ন : সামগ্রিক পারফরম্যান্স আর প্রাপ্তিকে কীভাবে দেখছেন?

সাকিব : আমরা যদি এবার সেমিফাইনাল খেলতে পারতাম তবে যেভাবে আমাদের নিয়ে সব সাবেক ক্রিকেটার ও বাইরের দেশের মানুষ বলেন, সবাই যেভাবে প্রশংসা করেছে, সেটির যথার্থ মূল্য দেয়া যেত। সেখানেই আমাদের একটি গ্যাপ থেকে গেছে। দিনশেষে, দক্ষিণ আফ্রিকা জিতলে আমরা আট নম্বরে নেমে যাব। ওইভাবে চিন্তা করলে খুবই বাজে ফল। তো আমাদের বাইরের সবাই যেভাবে প্রশংসা করেছে, সেটির যথার্থ মূল্যায়ন হয়তো আমরা দিতে পারলাম না। অনেকেই বলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। কিন্তু ওই মাচে যদি আমরা হেরে যেতাম? ওই ম্যাচ ছাড়াও আমাদের সুযোগ ছিল, সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি নিতে পারিনি।

এসএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।