ব্যাটিংয়ে জন্মানো স্বপ্নটা ভাঙল সেই ব্যাটিংয়েই

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা এজবাস্টন, বার্মিংহাম থেকে
প্রকাশিত: ০১:১৩ এএম, ০৩ জুলাই ২০১৯

খেলা শুরুর আগে স্টেডিয়ামের বাইরে বাংলাদেশিদের সরব উপস্থিতি কম ছিল না। সেই সকাল থেকেই লাল-সবুজের দেখা মিলল বেশ। হৈচৈ, প্রাণচাঞ্চল্য, উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে বোঝাই যায়নি স্টেডিয়ামের ভেতরটা এমন একপেশে হবে।

মনে হচ্ছিল ভারতীয় সমর্থক ও ভক্তরা সংখ্যায় বেশি থাকলেও, বাংলাদেশিরা খুব পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু খেলা শুরুর পর দেখা গেল অন্য চিত্র। পুরো এজবাস্টন জুড়েই নীল, আকাশি আর গেরুয়া রংয়ের আধিক্য। সংখ্যায় বেশি থাকার কারণে ভারতের তেরঙ্গা পতাকাই চোখে পড়েছে বেশি।

টিভির পর্দায় খেলা দেখারা হয়ত অনুমান করতে পারেননি মাঠে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও কিন্তু খুব কম ছিলেন না। তবে খেলার সময় একমাত্র ভারতীয় ইনিংসের শেষ ১০ ওভার ছাড়া প্রায় সারাদিন তেরঙ্গা পতাকাই বেশি উড়ল। সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’ ধ্বনিও কানে বাজল বেশি।

ওদিকে খেলার ১৫ ওভারের বেশি বাকি থাকতে ভারতীয় সমর্থকরা ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ দিতে শুরু করলেন। তাদের অমন আগাম উৎসবে মেতে ওঠার কারণ একটাই, ততক্ষণে খেলা ভারতের দিকে পুরোই হেলে পড়েছে।

শুরু ভাল হয়নি তেমন। যাকে ঘিরে ছিল অনেক আশা, সেই তামিম হতাশায় ডুবিয়েছেন আরেকবার। তারপর যখনই মনে হয়েছে টাইগাররা খেলায় ফিরতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আশাভঙ্গের বেদনা এসে গলা চিপে ধরেছে।

এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একমাত্র দল যারা আগে তিন-তিনবার ৩২০+ রান করেছে। এর মধ্যে একবার ৩২১ রান করে জিতেছে। আর একবার অস্ট্রেলিয়ার করা ৩৭০ রানের পিছু ধেয়ে ৩৩৩ রান করেছে। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে ৩৩০ রান করে জেতারও রেকর্ড ছিল।

সেই খেলাগুলোর সবকটায় অন্তত এক বা দুটি বড় পার্টনারশিপ হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সাকিব-মুশফিকের তৃতীয় উইকেটে ১৪২, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে সাকিব-লিটনের অবিচ্ছিন্ন ১৯০ আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারা ম্যাচে মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ ১২৭ রানের পার্টনারশিপগুলোর কথা খুব মনে পড়লো সবার আক্ষেপ থাকলো, ইশ, আজ ঠিক অমন একটা পার্টনারশিপ যে খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা হলো কই?

আগে যতই ৩২০-৩৩০ করার রেকর্ড থাকুক আজকের দিনে ৩১৫ করতেও প্রয়োজন ছিল বড় পার্টনারশিপ। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দেখে মনে হলো তারা ঐ জুটি গড়ায় তেমন মনোযোগী আর উৎসাহ ছিলেন না। ভাবটা এমন, সাকিব আছে না? সাকিব একাই যা করার করবে। মূল বোঝাটা সাকিব বইবে আর আমরা ঐ কোনাকাঞ্চি দিয়ে একটু ধরবো শুধু।

তা কি আর প্রতিদিনই হয়? হয় না। সাকিব তার দায়িত্ব পালনের প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যারা তার সঙ্গী হতে পারতেন, সেই সৌম্য, মুশফিক আর লিটন দাসরা সাকিবের সেই পরিশ্রম আর চেষ্টার সঙ্গী হতে পারলেন না। পারলেন না, না বলে চেষ্টা করলেন না বলাই হয়ত ঠিক হবে।

তামিম ছন্দে আর ফর্মে নেই, বোঝা গেছে। তাই তার কথা বেশি না বলাই ভাল। মোহাম্মদ শামির অফস্টাম্পের বাইরের যে বল নিজের ব্যাটে টেনে এনে প্লেইড অন হলেন তামিম, এর চেয়ে অনেক ভাল বলকে চোখের পলকে কভার দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠানোর ভুরিভুরি উদাহারণ আছে তার। কিন্তু সময় খারাপ হলে যা হয়। জানা অঙ্কও নাকি ভুল হয়। তামিমেরও তাই হলো।

কিন্তু সৌম্য, মুশফিক আর লিটন দাস একদম উইকেটে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন। পরিবেশ-পরিস্থিতি, উইকেটের গতি-প্রকৃতি আর ভারতীয় বোলারদের কার কী বোলিং- সব জানা হয়ে গিয়েছিল তিন জনেরই। কিন্তু সবাই হতাশায় ডোবালেন ওয়েল সেট হয়ে আউট হয়ে।

প্রথম ভুল পথের যাত্রী হলেন সৌম্য (৩৮ বলে ৩৩)। মোহাম্মদ শামি, ভুবনেশ্বর আর জাসপ্রিত বুমরাকে দেখে ও ভাল খেলার পর আউট হলেন হারদিক পান্ডিয়ার অফস্টাম্পের বেশ বাইরে হাফভলি বলে। অফসাইডে তুলে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে কভারে ক্যাচ দিলেন সৌম্য।

তারপর সাকিব আর মুশফিক শুরু করলেন ভালই। দেখে মনে হলো দুই অভিজ্ঞ আর সংগ্রামী সফল যোদ্ধার হাত ধরেই হয়ত সামনে আগাবে টাইগারদের ইনিংস। কিন্তু হায় সেট হয়ে একই ভুল করলেন মুশফিক। বাংলাদেশের সংকটে, প্রয়োজনে অনেকবার ত্রাণকর্তার ভুমিকা নেয়া এ পরিপাটি ব্যাটিং শৈলির ব্যাটসম্যান আজ খুব দরকারের সময় নিজের সুনামের প্রতি সুবিচার করতে পারলেন না।

অনেক আগে ভাগে লেগস্পিনার চাহালকে স্লগ সুইপ খেলতে গেলেন। ক্যাচও দিয়ে ফেললেন। মুশফিক ২৩ বলে ২৪ রান করে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আশার প্রদিপের আলো কমতে শুরু করলো অনেকটা। এরপরও আশা ছিল। কারণ তারপরের জুটিটি ছিল সাকিব-লিটনের; যাদের হাত ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এসেছিল স্বপ্নের এক জয়।

ওশানে থমাস, শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, শেলডন কটরেল আর হোল্ডারদের বিপক্ষে অনেক সাহসী ব্যাটিং করা লিটনের আজকের শুরু ছিল তার চেয়েও সুন্দর, সাবলীল। উইকেটের সামনে ও দুদিকে কিছু নজর কাড়া শটস খেলা লিটন ঠিক আগের বলে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে সেই হারদিক পান্ডিয়ার বলেই ফিরে গেলেন। আউট হতেই পারেন। তবে ভাল ও সমীহ জাগানো বলে হলে কথা ছিল না।

লিটন আউট হলেন শর্ট বলে অহেতুক বেশী আগ্রাসী মেজাজে পুল খেলতে গিয়ে। অথচ এই লিটন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৪ রান করার দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুল না খেলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে বলের গতি বুঝে কব্জির মোচড়ে একটু নরম হাতে বলকে স্কয়ার লেগ, লং লেগ আর মিড উইকেটে চালিয়েছেন। তাতে ঝুঁকি ছিল কম। রানও উঠেছে কম। পরে ওয়েল সেট হয়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে একের পর এক বাহারি ও আক্রমণাত্মক শটস খেলে চার ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে মাঠ মাতানোর পাশাপাশি জয় সহজ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সেই লিটন অনেক আগে ভাগে একটু বেশী উচ্চাভিলাসী শট খেলতে গেলেন। সেটাই কাল হলো।

মাঝে কয়েক ম্যাচে হঠাৎ আালোর ঝলকানি দেয়া মোসাদ্দেকও আসরের সবচেয়ে বিগ ম্যাচে অউট হলেন শিক্ষানবীশের মত। তারপর সাকিবও হতোদ্যম হয়ে গেলেন। ৭৪ বলে ৬৬ রান করার পর হারদিক পান্ডিয়ার থ্রি কোয়াটার লেন্থ ডেলিভারি মারবো কি মারবো না করে শেষ মুহূর্তে চেক দিতে গিয়ে ব্যাট পেতে দিলেন। ক্যাচ উঠলো কভারে। এরই সঙ্গে নিভল আশার প্রদীপ।

২ জুন ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত টিম পারফরমেন্সে পাওয়া জয়ে যে স্বপ্নীল যাত্রার শুরু হয়েছিল, আজ বার্মিংহামের এজবাস্টনে তার ইতি ঘটলো। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলাটা স্বপ্ন হয়েই থাকলো টাইগারদের। আগে ভাল খেললেও সময় মত জ্বলে ওঠা এবং সামর্থ্যের সেরাটা উপহার দেয়াই যে আসল কাজ- সে সত্য উপলব্ধিতে বড্ড ভুল করলেন তামিম, সৌম্য, মুশফিক, লিটন আর মোসাদ্দেক।

নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শেষ দিকে কিছুটা লড়াই করলেন সাব্বির আর সাইফউদ্দিন। তাতে শুধু ব্যবধানই কমলো না, হতাশার মাত্রাও দ্বিগুণ হলো। সাব্বির খেললেন ৩৬ বলে ৩৬ আর সাইফউদ্দিন ৩৮ বলে অপরাজিত থাকলেন ৫১ রানে।

বারবার মনে হলো, ইশ একটি ১০০ রানের পার্টনারশিপ যদি হতো, তাহলে ৩১৫ করে ভারতকে হারানো যেত। সেমিফাইনালের পথে আরও এক ধাপ এগিয়েও যাওয়া সম্ভব হতো। ৩১৫ করতে গেলে যে জুটি গড়া দরকার, সেই বোধ উপলব্ধিটা আজ ভারতের সঙ্গে দেখা গেল না।

তাই পুরো ইনিংসে একটি বড় জুটিও তৈরী হলো না। প্রথম উইকেটে তামিম-সৌম্যর ৩৯, সৌম্য-সাকিব দ্বিতীয় উইকেটে ৩৫, সাকিব-মুশফিকের তৃতীয় উইকেটে ৪৭, লিটন-সাকিবের চতুর্থ উইকেটে ৪১ রানের জুটিগুলোর অন্তত একটি বড় হলেও হয়ত চলতো।

সপ্তম উইকেটে সাব্বির আর সাইফউদ্দিনের ৬৬ রানের জুটি ভাল লাগার চেয়ে আক্ষেপের জন্মই দিল শুধু। ২৮ রানের হারটি সবার বুকে ‘শেল’ হয়ে বিঁধলো। হতাশাটা বাড়লো অন্য কারণে, যে ব্যাটিং জন্ম দিয়েছিল বড় স্বপ্নের, জায়গামত সেই ব্যাটিংটাই ডোবালো।

শেষ ১০ ওভারে মোস্তাফিজের হাত ধরে ৬৩ রানে ভারতের ৫ উইকেটের পতন ঘটানোর ম্যাচের এমন ফ্যাকাশে পরিসমাপ্তি ঘটল অপরিণামদর্শী ব্যাটিংয়ে। দুর্ভাগ্য মাশরাফির। এদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তার হাত ধরে দেশের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছে।

দুই বছর আগে এই এজবাস্টনে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শেষ চারেও পা রেখেছিল। কিন্তু সেবারও ভারতের বাঁধা টপকানো সম্ভব হয়নি। এবারো সেই ভারতীয়দের কাছে ২৮ রানের হারেই শেষ হলো বিশ্বকাপ স্বপ্ন। মুখে না বললেও অনেক আশায় ছিলেন সেমিফাইনাল খেলে বিশ্বকাপের বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখতে। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের অপরিণামদর্শী ব্যাটিংয়ে যে তাও হলো না।

এআরবি/এসএএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।