রাস্তায় হঠাৎ দেখা বিরাট কোহলির সঙ্গে, অতঃপর...
একবার ভাবুন তো ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম শহরের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন বিরাট কোহলি। সুলতান অফ ক্রিকেট। কেমন হবে ব্যাপারটা? নিশ্চয়ই হাজারো ভক্ত, সমর্থক আর জনতার লাইন লেগে যাবে তাকে এক নজর দেখার জন্য! একটি সেলফি কিংবা অটোগ্রাফের জন্য- নিশ্চয়ই তাকে পাগল করে ছাড়বেন হাজারো ভক্ত-সমর্থক। তাই না!
আজ বিকেলে ঠিক চারটার দিকে, সাউদাম্পটন সিটির প্রাণ কেন্দ্রে স্ট্র্যান্ড রোডে একাকী হেঁটে এক ইতালিয়ান, আইরিশ ও ইংলিশ যৌথ রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার খেতে আসলেন ভারতের অধিনায়ক ও সময়ের ক্রিকেট হার্টথ্রুব বিরাট কোহলি। অথচ, তার পেছনে লাইন লেগে যাওয়া তো বহুদূরে, একজন মানুষও নেই!
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। ব্যস্ত শহরে যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কারও দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। তাই বিরাট কোহলিকে কেউ চিনে থাকলেও খুব একটা আগ্রহ দেখিয়ে পাশে আসলো না।
তবে বিরাট কোহলি বাইরে বেরিয়েছিলেন কালো কাপড়ে গা ঢেকে! গা ঢেকে এই কারণে বলা যে, তার পরনে ছিল কালো ট্রাউজার্স, কালো গোল গলার টি-শার্ট আর কালো জ্যাকেট এবং হুডি ওঠানো। সুতরাং, একবার তাকিয়ে হুট করে তাকে চেনাও সম্ভব নয়। বোঝা গেল, হুডিকে অনেকটা ‘বোরকার’ মত বানিয়েই নিজেকে সবার দৃষ্টির বাইরে রেখে রাস্তায় নেমেছেন বিরাট।
বিরাট যে ফুটপাত ধরে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে অন্যপাশে আসলেন, ঠিক সেখানেই বাংলাদেশের সাংবাদিক বহরের একটা ছোট্ট গ্রুপ দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। ঠিক ওই সময় একজনের চোখ গেল বিরাট কোহলির দিকে।
আরে! এতো বিরাট কোহলি! সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে দু’জন ছুটলেন তার দিকে। বিরাট, একটা ফটোগ্রাফ প্লিজ। একটু সেলফি তোলা যাবে? এ সময় অবশ্য তারা নিজেদের পরিচয় দেননি বিরাট কোহলির কাছে। বলেননি যে, বিশ্বকাপ কাভার করতে তারা এসেছেন বাংলাদেশ থেকে।
‘নো স্যরি...’ বলে শর্ট সিঙ্গেলস নেবার দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতায় এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলেন রেস্টুরেন্টে; যার নাম ‘ক্যাফে থ্রাইভ।’ মূলতঃ তিনি বেরিয়েছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। রাত পোহালে এই শহরের রোজ বোল স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচ ভারতের। বোঝাই গেল, অনুশীলন শেষে হয়ত দুপুরে খেতে বেরিয়েছেন একা।
যেহেতু রাস্তায় একবার ‘না’ করে দিয়েছেন, কথা বলা দূরে থাক, ছবিও তুলবো না। এ চিন্তায় দ্বিতীয়বার অনুরোধ করা নিয়েও ছিল রাজ্যের দ্বিধা। দূর থেকে ছবি তোলা নিয়েও ভেতরে চলছিল দ্বিধা-সংশয়। এবার আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট দারুণ কড়া। কি জানি আবার যদি নিরাপত্তাকর্মী ডেকে বলে বসেন, এই যে এরা আমার অনুমতি ছাড়া ছবি তুলেছে।
এ সব সাত-পাঁচ ভেবে ৫/৬ জনের বাংলাদেশের সাংবাদিক বহরের একজনও দূর থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করেননি। ওদিকে সবার ভেতরেই একটা অন্যরকম অনুভুতি। বিরাট কোহলির মত সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান ও বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার চোখের সামনে, তার সাথে কথা বলা হলো না। ছবি বা অটোগ্রাফও নেয়া হলো না!
নাহ, কিছু একটা করতেই হবে। যা হয় হবে। না হয় বাজে ব্যবহার করবেন। বলবেন, তোমাদের তো ‘না’ করে দিয়েছি। আবার কেন এসেছো? এরপর বুদ্ধি এঁটে তার রেস্তোঁরায় ঢুকলাম আমরা। কৌশলে হালকা পেস্ট্রির মত একটা মিষ্টি আইটেম অর্ডার দেয়া হলো। বিরাট কোহলি তখন ব্যস্ত লাঞ্চ নিয়ে। আর আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, কেউ তাকে ফলো করছে কি না?
এরপর সোজা তার সামনে চলে গেলাম আমরা। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি বাংলাদেশের জার্নলিস্ট, বিশ্বকাপ কাভার করতে এসেছি। একটু কথা বলা যাবে?
নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে সোজা তার সামনে দাঁড়িয়ে যখন বললাম, আমি আরিফুর রহমান বাবু, বাংলাদেশের সাংবাদিক, বিশ্বকাপ কভার করতে এসেছি। একটু কথা বলা যাবে আপনার সাথে? একদম সোজাসুজি তাকিয়ে খুব ভদ্রতার সাথে বলে উঠলেন, ‘স্যরি আসলে আমার কালকে খেলা। আমিতো আর রেস্টুরেন্টে বসে উইদাউট অ্যাপয়েন্টমেন্ট তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে পারি না। আর এটা প্রেস মিটও না। তাই দুঃখিত কথা বলা যাবে না।
তখন বললাম, আচ্ছা একটা সেলফিতো তোলা যাবে, নাকি? খেতে খেতে বললেন হুম। তারপর দারুন এক রসিকতা করলেন। কেন তিনি উইকেটে গিয়েই চট জলদি সেট হয়ে যান। মাঝ ব্যাটে খেলতে শুরু করেন আর যাকে তাকে মারতে থাকেন- তার একটা জ্বলন্ত নজির নিজ চোখে দেখলাম। আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলেও একটা অন্যরকম ধৈর্যের পরিচয় নিলেন।
ঠিক আছে, ছবি তুলবো। তবে আমিতো খাচ্ছি। আর তুমি যখন ছবি তুলতে চাইছো, তাহলে আমি কিন্তু আরও বেশি সময় ধরে খাব। ততক্ষণ ধৈর্য থাকবে তোমার? অবশ্যই থাকবে। আপনি খেয়ে যান। আমি অপেক্ষায় আছি।
অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হলো। সর্বোচ্চ মিনিট দশ-বারো লাগলো। এরপর উঠেই, হাত ইশারায় ডাকলেন। বললেন, ‘রেস্টুরেন্টে না। ছবি তুলবো বাইরে রাস্তায় গিয়ে।’
‘ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই।’ এরপর ছবি তোলার ফাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের দল (বাংলাদেশ দল) কেমন খেলছে? একটু কিছু বলবেন কি? ‘ওহ, বাংলাদেশ? হ্যাঁ, ভালোইতো খেলছে।’
বলে ছবি দিয়েই, কাল বিলম্ব না করে পা চালিয়ে দিলেন। এরপর রেস্টুরেন্টের ক্যাশে বসা ইতালিয়ান মেয়ে সোফিয়ার কাছ থেকে জানা হলো কি খেলেন বিরাট কোহলি? যে ডিশটি কোহলি খেলেন, তার নাম ‘বিগ থ্রিভ বোল।’ দাম শুনবেন? মাত্র ৮ পাউন্ড ২৫ পেনি। মাশরুম, ভেজিটেবল, লেমন, সালাদ, এবোকাডোসহ আরও কিছু ইংলিশ আর ইতালিয়ান ফুডের সমাহারে গড়া ‘বিগ থ্রিভ বোল’।
মাঠে এক ইঞ্চি জায়গা যিনি প্রতিপক্ষ দলকে দিতে চান না। ব্যাটিং ও ফিল্ডিংয়ের সময় চোয়াল শক্ত করে থাকেন। সদা তৎপর ভালো করতে। প্রতিপক্ষকে এতটুকু সুযোগ না দিতে। শতভাগ উজাড় করে দেয়া যার মানসিকতা, সেই কোহলি মাঠের বাইরে কতটা বিনয়ী! অনুমান করা কঠিন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় বাংলাদেশের আরও ক’জন সহকর্মী সাংবাদিকও চলে আসলেন উৎসাহ নিয়ে। বিরাট তাদেরও হতাশ করেননি। নিজে সরে জায়গা করে দিলেন গ্রুপ ছবি তুলতে।
সত্যিই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা! সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনের এক রেস্তোঁরায় বিরাট কোহলির সাথে ছোট্ট কথোপকথন আর সেলফি ও গ্রুপ ছবি তোলা। সত্যিই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা !
এআরবি/আইএইচএস