এখন ‘আর্লি সামার’ বলেই এত বৃষ্টি, জুলাই মাসে কমবে বৃষ্টির উৎপাত!
কেরালার জোসেফের আজ মুডটা ভালো। কারণ দুটো, আকাশের অবস্থা আগের চেয়ে ধীরে ধীরে ভাল হতে শুরু করেছে। আকাশ আর একদম গোমড়া মুখ করে নেই। কখনো কখনো মেঘ কেটে সূর্য আর মেঘের দেখা মিলছে। এই যেমন আজ দিনের শুরুতেই সূর্যেরৎ উজ্জল আলোর দেখা মিলেছে।
তার চেয়েও জোসেফের মন ভাল হবার আরও একটি উপলক্ষ্য আছে। তা হলো- তার দেশ ভারত মেনচেস্টারের ওল্ডট্রাফোর্ডে চীর প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে শুভ সূচনা করেছে। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দুরে থেকেও জোসেফ প্রায় প্রতিটি বলের খবর রাখছে। দেখার সুযোগটা ঠিক নেই তার। কারণ পেশাটাই এমন যে সারা দিন টনটনের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াতে হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না কেরালার বছর চল্লিশের জোসেফ পেশায় ট্যাক্সিচালক। এ নিয়ে তিনদিন তার ট্যাক্সিতে চাপার সুযোগ হলো। ভারতীয় হিসেবে ক্রিকেট তার ধ্যান-জ্ঞান। এক যুগের অল্প কিছু সময় বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে আছেন জোসেফ।
টনটনে থাকেন তিন বছর। দীর্ঘ এক যুগ থাকার কারণে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা জন্মে গেছে। জোসেফ জানালেন, সাধারণতঃ বছরের এ সময়টায় বৃষ্টি একটু কম হয়। এবার নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় একটু বেশিই বৃষ্টি হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। অন্তত গত পাঁচ-সাত বছরে জুন মাসে এত বৃষ্টি হয়নি। তবে জোসেফ একটি তাৎপর্য্যপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাহলো আসলে যুক্তরাজ্যে সত্যিকার সামার বা গ্রীষ্মকাল শুরুই হয়নি। গত এক সপ্তাহে কার্ডিফ, ব্রিস্টল আর টনটনের স্থানীয় বাংলাদেশিদের সাথে কথা বলে এবং বিভিন্ন হোটেল রিসেপশনিস্ট এবং বিভিন্ন ভেন্যুর মিডিয়া ও সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ইংলিশদের সাথে কথা বলেও তাই জানা গেছে।
আসলে যুক্তরাজ্যে ঠিক জুনে সামার বা গ্রীষ্মকাল শুরু হয় না। এটাকে এ অঞ্চলের মানুষরা বলেন, ‘আর্লি সামার’ বা গ্রীষ্মের শুরু। প্রকৃত গ্রীষ্মকাল শুরু হয় জুলাই থেকে। জুনকে এদেশের মানুষ কাছে ‘আর্লি সামার’ বলেই মনে হয়।
তার মানে আসল সামার বা গ্রীষ্মকাল শুরু হবে জুলাই থেকে। তাই সবার ধারনা, আর সপ্তাহ দুয়েক পর মানে জুলাই মাস শুরু হলেই বৃষ্টির প্রকোপ কমে যাবে। ভারতীয় ট্যাক্সিচালক জোসেফ, প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে পাওয়া এ তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে ধরেই নেয়া যায় যে- এ মাসের আর ও যে ১৩/১৪ দিন বাকি আছে- এই সময়টাতে বৃষ্টির প্রকোপ থাকবেই।
তবে জুলাই শুরুর পর থেকে বৃষ্টি কমে যেতে পারে। তখন পুরোদস্তুর গ্রীষ্মকাল শুরু হবে। তার মানে বাংলাদেশের শেষ দুটি ম্যাচে বৃষ্টির হানা ও বৈরি আচরণ কম থাকতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী ২ জুলাই বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে ভারত আর ৫ জুলাই লন্ডনে লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ দুটি ম্যাচে বৃষ্টির উৎপাত কম থাকতে পারে।
কেউ কেউ পুরোপুরি অবগত না হয়ে সমালোচনায় মুখর- কেন এই গ্রীষ্মের প্রারম্ভে বিশ্বকাপের মত বড় আসর যুক্তরাজ্যেআয়োজন করা হলো? তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
তাদের হয়তো জানা নেই, যুক্তরাজ্যে বিশ্বকাপ এবারই প্রথম নয়। এ নিয়ে পঞ্চমবার বিশ্বকাপের স্বাগাতিক যুক্তরাজ্য। এর আগে সেই ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩ আর ১৯৯৯ সালেও বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে এ দেশে। এবং দিন-ক্ষণের হিসেব কষলে প্রায় এই সময়েই বিশ্বকাপের আসর বসেছে ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডে।
কিন্তু কোনোবারই এত বৃষ্টি হয়নি। মানে এবারের মত বৃষ্টির উতপাৎ দেখা যায়নি কোনবার। স্থানীয়দের বদ্ধমূল ধারণা, এটা আসলে প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণ। যেটা গত পাঁচ থেকে সাত বছরে দেখা যায়নি।
তবে তারপরও একটি কথা কিন্তু উঠেছে। তাহলো, বিশ্বকাপ আরও একটু পিছিয়ে আয়োজন করা যেত কি না? জুনের শেষ সপ্তাহে শুরু করে জুলাই পার করে আগস্টের প্রথম দিক পর্যন্ত আয়োজন করা সম্ভব ছিল কি না?
অনেকেরই মত, তা করা যেত অনায়াসেই। কিন্তু তা করা হয়নি, কারণ, ওই সময়ে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া মহাদ্বৈরথ, মহারণ ‘অ্যাশেজ’ হবে। আর যত সাজ সাজ রব ওই দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই নিয়েই।
প্রথম কথা হলো, জুনে এমন বৃষ্টি হবে, তা কেউ ভাবেননি। আর দ্বিতীয়ত, জুলাইতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ হবে। তাই মে মাসের শেষ আর জুন ও জুলাইয়ের মাঝামাঝি বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত।
ভাবছেন, বিশ্বকাপের আয়োজক তো যুক্তরাজ্য নয়, আইসিসি। কাজেই ইংল্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) চাইলেই কি জুলাইতে বিশ্বকাপ শুরু করতে পারতো? হ্যাঁ, পারতো। কারণ দিন শেষে বিশ্বকাপ আইসিসির ইভেন্ট হলেও যে দেশে খেলা হয়, মানে স্বাগতিকদের একটা মত অগ্রাধিকার পাবেই।
ইংলিশ ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) আবহাওয়ার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে খেলা বিঘ্ন হবার সম্ভাবনা থাকার চিন্তা করে সময় পিছিয়ে দিতে বললে আইসিসি অবশ্যই বিবেচনা করতো; কিন্তু ইংলিশরা বিষয়টি হয়ত সেভাবে আমলে আনেনি। আর আইসিসিকে বলাও হয়নি।
কারণও আছে। বাংলাদেশে বসে বিশ্বাস করা খুব কঠিন, বৃটিশ-ইংলিশদের কাছে অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের পারস্পরিক সিরিজ বা অ্যাশেজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অনেক বেশী জনপ্রিয়। ইংলিশরা ওই সিরিজ দেখে যত সুখ আর আনন্দ অনুভব করে, বিশ্বকাপ দেখেও ততটা নয়।
অ্যাশেজ চলাকালীন লর্ডস, ওভাল, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, এজবাস্টনের গ্যালারি ভরে যায় দর্শকে। এত মানুষ কি বিশ্বকাপ দেখতে মাঠে আসেন বা এসেছেন?
একটা কথা বলে রাখি, বিশ্বকাপে গ্যালারি ভরা দর্শক মানেই কিন্তু ইংলিশ বা বৃটিশ নন। প্রতিটি ভেন্যুর ৬০ থেকে ৭০ ভাগ দর্শক , সমর্থক হলো ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, শ্রীলঙ্কান, অস্ট্রেলিয়ান, কিউই আর দক্ষিণ আফ্রিকান। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের বিশ্বকাপের সব সময় প্রতিটি ভেন্যুতে ইংল্যান্ডের ম্যাচগুলো ছাড়া ভিনদেশিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ইংলিশরা বরাবরই অ্যাশেজ দেখে হন মোহিত, মুগ্ধ, পুলকিত। কাজেই অ্যাশেজের আনন্দ, প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর চিরায়ত ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রাখতেই তাহলে ‘আর্লি সামারে’ বিশ্বকাপ আয়োজনে উদ্যোগী যুক্তরাজ্য- এমন কথা কেউ বললে তার মাথায় বাড়ি দেয়া যাবে না।
কারণ কথটা ভিত্তিহীন ও অমূলক নয়। এবার আগের যে কোনোবারের চেয়ে ইংল্যান্ড ভাল দল। কঠিন প্রতিপক্ষ। তাই হয়ত একটু আবেগ-উচ্ছাস বেশি; কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইংলিশ ও বৃটিশদের কাছে ‘অ্যাশেজ’-এর আকর্ষণ ও আবেদন অনেক বেশি।
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম