ইংলিশদের শক্তির জায়গায় পাল্টা আঘাতের চিন্তা মাশরাফির
ইতিহাস আর পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরলে কালকের ম্যাচের ফেবারিট বাংলাদেশ। কারণ সর্বশেষ দুই বিশ্বকাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে পারেনি ইংল্যান্ড। ২০১১ সালে ঘরের মাঠে আর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে- দুবারই জিতেছে টাইগাররা।
কিন্তু সেটাই কি শেষ কথা? কাল (শনিবার) ৮ জুন কার্ডিফে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কি আসলেই বাংলাদেশ ফেবারিট? সমীকরণ আর হিসেব নিকেশ কি শুধু এক ধরনেরই হয়? খেলা কি শুধু একটি সমীকরণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়?
একটা ম্যাচের আগে নানারকম হিসেব নিকেশ থাকে। তাই বলে শুধু পরিসংখ্যান আর ইতিহাসকে ঘিরে হিসেব করলে তো বিপদ। এ ম্যাচের আগে কিন্তু শুধু ইতিহাস আর পরিসংখ্যান কেন্দ্রিক কথা বার্তাই হচ্ছে না। অন্য ধরনের কথা ও হিসেব নিকেশও আছে।
কালকের বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে পরিষ্কার বলা হচ্ছে ইংল্যান্ড এখন সময়ের অন্যতম সেরা দল। এ মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে আক্রমনাত্মক দল। যাদের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ একদম পাল্টে গেছে। ব্যাটিংয়ের চিরায়ত সনাতন ধারা তথা ব্যাকরণ মেনে সোজা ব্যাটে খেলাই এখন আর ইংলিশদের ব্রত নেই।
জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, জস বাটলার আর ইয়ন মরগ্যানরা এখন অনেক বেশি আক্রমনাত্মক। তাদের অ্যাপ্রোচ আর অ্যাপ্লিকেশন অনেক বেশি মার মার কাট কাট। প্রতিপক্ষ বোলিংকে কোনরকম চেপে বসার সুযোগ না দিয়ে খুনে মানসিকতায় তাদের দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে সচেষ্ট এখন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা।
এইতো সেদিন বিশ্বকাপের আগের সিরিজে তাদের বিপক্ষে ৩৫০ রান করেও হালে পানি পায়নি পাকিস্তানিরা। ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা অসীম সাহস নিয়ে অসামান্য দক্ষতায় সেই রান পাহাড় টপকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে গেছেন। তাই ইংলিশ ব্যাটিংয়ের শক্তি ও সামর্থ্যকে ভাবা হচ্ছে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
অনেক বড়বড় বিশেষজ্ঞ ও ক্রিকেট পন্ডিতের ধারণা, এবারের ইংল্যান্ড দলটি সম্ভবত ইংলিশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল। হয়তো বা সবচেয়ে ইনফর্ম টিম। বিশ্বকাপে এটাই হয়ত ইংল্যান্ডের সব সময়ের সেরা দল। এজন্যই ইংলিশরা এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট। প্রতিপক্ষ হিসেবে শুধু বাংলাদেশই নয়, যে কোন দলের জন্য কঠিনতম প্রতিপক্ষ।
ভারত, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডকেও এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট এবং সম্ভাব্য বিজয়ী। তার মানে কী দাঁড়ালো? দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডের মত ‘বড় দলের’ তকমাধারি দলের চেয়েও বাংলাদেশ আগামীকাল ৮ জুন আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
আগের দুইবার টানা জয়ের রেকর্ড থাকলেও এবারের ইংল্যান্ড যে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং মিলে অনেক বেশি শক্তিশালি। প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক কঠিন। ইতিহাস-পরিসংখ্যান যাই থাকুক না কেন, আসল সত্য হলো এবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ফেবারিট ইংল্যান্ড।
সেই ইংলিশদের সাথে ম্যাচের আগে নিজেদের ফেবারিট নাকি আন্ডারডগ- কী ভাবছে বাংলাদেশ দল? ম্যাচে বাংলাদেশের লক্ষ্য, পরিকল্পনাই বা কী? আজ (শুক্রবার) ২৬ মিনিটের প্রেস কনফারেন্সে অধিনায়ক মাশরাফি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
মাশরাফি শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আসলে ইতিহাস আর পরিসংখ্যান নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আগের দুই জয় এখন শুধুই অতীত। সেটা সুখস্মৃতি, তবে কালকের ম্যাচে ভাল খেলার সহায়ক শক্তি নয়। মানসিকভাবে চাঙা ও আত্ববিশ্বাসী থাকার উপাদান মাত্র।’
প্রতিপক্ষ হিসেবে ইংলিশদের সমীহ জাগানো দল উল্লেখ করে বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেন, ‘আমার মনে হয় এ দলটি ইংল্যান্ডের সব সময়ের অন্যতম সেরা দল। বিশেষ করে বিশ্বকাপে। তারা এখন ফর্মের তুঙ্গে আছে এবং বিশ্বকাপেও তারা কক্ষপথেই আছে। ভাল খেলে ম্যাচও জিতেছে।’
তাহলে ইংল্যান্ডের এই দল কি দুর্দমনী? তাদের কি হারানো যাবে না? ইংলিশদের বধ করার সামর্থ্য কী নেই মাশরাফির দলের? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মাশরাফির ব্যাখ্যা শুনে মনে হয়েছে, ইংলিশদের শক্তির জায়গাগুলো নিয়েই বেশি ভাবছে বাংলাদেশ। ভাবছে বলা হয়ত ঠিক হলো না পুরোপুুরি। বলা যায় কাজ করছে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে হোমওয়ার্ক করছে টিম বাংলাদেশ।
মাশরাফি বোঝানোর চেষ্টা করেন, আসলে বেশ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠেন, শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভাল সূচনার বিকল্প নেই। আমাদের সেরাটা উপহার দিতে হবে সবার আগে।
সেটাই কি যথেষ্ট? এ প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেন, ‘আমরা জানি ইংলিশদের শক্তির জায়গা গুলো সম্পর্কে। তাদের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের সবচেয়ে শক্ত ঘাটিগুলো শুধু চিহ্নিত করলেই চলবে না। যে সব জায়গায় ইংল্যান্ড খুব বেশী স্ট্রং, সে সব জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে বেশি। সেই জায়গাগুলো যাতে খুব বেশি জ্বলে উঠতে না পারে, সেই কাজ করতে হবে। সেজন্য ইংলিশদের যে করেই হোক ঠান্ডা রাখতে হবে। যদি আমরা তাদের ঐ সব শক্তির জায়গাগুলো বন্ধ করে দিতে পারি, সেটা আমাদের ভাল করায় বিশেষ সহায়ক হবে।’
টিম ইংল্যান্ডকে সময়ের অন্যতম সেরা দল হিসেবে অভিহিত করলেও নিজ দলকে এতটুকু ছোট করে ভাবতে নারাজ মাশরাফি। কালকের ম্যাচে ইংলিশদের হারানোর লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাই বলে ওঠেন, ‘আমরা জানি ইংল্যান্ড এখন কেমন দল। তাদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার। আমরা নিজেদের সম্পর্কেও জানি। আমরা কী পারি, কী করতে পারবো আর কী করা সম্ভব?- এসব ধারনা আছে পরিষ্কার। তাই আমরা আসলে নিজেদের ভাল খেলার এবং সামর্থ্যের সবোর্চ্চটুকু উপহার দেয়ার কথাই ভাবাছি।’
ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা আজকাল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলায় অভ্যস্ত। চাপে পড়লেও আক্রমনাত্মক আবার শক্ত-মজবুত অবস্থায়ও আক্রমণাত্মক। তাদের ব্যাটসম্যানরা খেই হারান না। ছন্দও বিঘ্নিত হয় না। সেটা বেশ ভালমতই মাথায় আছে মাশরাফির।
এজন্যই বারবার বলেছেন, ‘আবহাওয়া যেমনই থাকুক না কেন, উইকেটের চরিত্রও যাই হোক না কেন- আমাদের খেলতে হবে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর ভর করে।’
তাইতো বার বার সাকিব আর মিরাজ- দুই স্পিনারের কথা উঠে আসে তার মুখে। ইংলিশরা বৃষ্টি ভেজা কার্ডিফে একজন বাড়তি পেসার খেলানোর চিন্তা করছে। বাংলাদেশও কি অমন ভাবছে? ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে রুবেল হোসেনের দুটি এক্সপ্রেস ডেলিভারি জয়ের পিছনে রেখেছিল দারুণ ভূমিকা। ।
কালকের ম্যাচে কি ফাস্ট বোলার রুবেলকে খেলানোর চিন্তা চলছে? এমন প্রশ্নও উঠলো প্রেস মিটে। মাশরাফির কথা শুনে মনে হলো দলে পরিবর্তনের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়, ‘আমাদের স্পিনাররা এখন পর্যন্ত ভাল বল করেছে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্পিনাররাই শেষ দিকে আমাদের সম্ভাবনার প্রদীপ জ্বালিয়েছিল। সাকিব-মিরাজ দুই ম্যাচেই ভাল বল করেছে। সমীহও আদায় করে নিয়েছে প্রচুর।’
কথায় পরিষ্কার, ঐ দুই স্পিনারের ওপর অধিনায়ক মাশরাফির আস্থা অনেক বেশি। তাই ধরেই নেয়া যায়, কালকের ম্যাচেও হয়ত সাকিব আর মিরাজ দুই স্পিনারই খেলবেন।
আজকের প্রেস কনফারেন্সে আরও একটি প্রসঙ্গ উঠেছে। একজন বাংলাদেশি সিনিয়র সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আগের দুই ম্যাচে বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বোলিংয়ে শুরুর দিকে বাংলাদেশ দলকে একটু রক্ষণাত্মক মনে হয়েছে। সেটা কেন?
জবাব দিতে গিয়ে মাশরাফি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘আসলে রক্ষনাত্মক আর আক্রমনাত্মক নয়- পরিস্থিতি যখন যেটা ডিমান্ড করেছে, সেটাই করার চেষ্টা ছিল।’
তার শেষ কথা, ‘বিশ্বকাপের মত বড় আসরে এসে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। আমরা তা ভাবতেও চাই না। আমরা জানি আমাদের অনেকদূর যেতে হলে সব ম্যাচ ভাল খেলতে হবে এবং যত বেশি সম্ভব জিততে হবে। কালকের ম্যাচসহ আমরা এখন অবধি যে তিন দলের মুখোমুখি সেই দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড আর স্বাগতিক ইংল্যান্ড- এই তিন দলের জন্যই ইংলিশ কন্ডিশন সবচেয়ে আদর্শ ও সহায়ক। সেখানে ভাল খেলা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আসরা সে চ্যালেঞ্জ অতিক্রমে সামর্থ্যে সবটুকু উজার করে চেষ্টা করবো।’
এআরবি/এসএএস