আশা জাগিয়েও হতাশার হার

ক্রীড়া প্রতিবেদক ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:১৫ এএম, ০৬ জুন ২০১৯

‘ইশ! যদি তখন রানআউট হয়ে যেতেন উইলিয়ামসন। যদি মুশফিক সে ভুলটা না করতেন!’- নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভক্ত-সমর্থকদের প্রায় সবার কণ্ঠেই শুধু এই একটি কথা। নিজের ইনিংসের শুরুতেই মুশফিকুর রহীমের বাচ্চাসুলভ ভুলে নিশ্চিত রানআউটের হাত থেকে বেঁচে যান কিউই অধিনায়ক।

পরে রস টেলরের সঙ্গে গড়েন ম্যাচ জেতানো ১০৫ রানের জুটি, অথচ তিনি সাজঘরে ফিরতে পারতেন জুটির মাত্র ৬ রানের মাথায়। তবু উইলিয়ামসনের এ ঘটনার পরেও সাকিব, মিরাজ, মোসাদ্দেকদের বোলিংয়ে ম্যাচ জমিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারেনি টাইগাররা। মাত্র ২৪৪ রানের পুঁজি নিয়ে দুর্দান্ত লড়াই করে কিউইদের ৮ উইকেট তুলে নিলেও আসেনি জয়। নিউজিল্যান্ডের নিচের সারির ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় ১৭ বল হাতে রেখে ২ উইকেটে ম্যাচ জিতে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড।

বাংলাদেশের করা ২৪৪ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই দুই ডানহাতি বোলার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং মেহেদী হাসান মিরাজের ওপর চড়াও হন গাপটিল। মাত্র ৫ ওভারে নিয়ে নেন ৩৫ রান।

উপায়অন্ত না দেখে ষষ্ঠ ওভারেই নিজের ডেপুটির হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক মাশরাফি। আস্থার প্রতিদান দিতে দ্বিতীয় বল পর্যন্তও যাননি সাকিব।

ব্যাট হাতে ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, দলকে বলার মতো সংগ্রহ এনে দেয়ার পথে তার ৬৪ রানের ইনিংসের ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। তবে তিনি তো অলরাউন্ডার, শুধু ব্যাটিং দিয়ে কি আর হয়?

না, হয়নি সাকিব আল হাসানের। বল হাতে নিয়ে নিজের প্রথম বলেই ভয়ঙ্কর মার্টিন গাপটিলকে সাজঘরে পাঠিয়েছেন বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকেও আউট করার।

সাকিবের করা প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করেন গাপটিল। কিন্তু ধরা পড়ে যান লংঅনে দাঁড়ানো তামিম ইকবালের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৩ চার ও ১ ছয়ের মারে ১৪ বলে ২৫ রান করেন গাপটিল।

এদিকে গাপটিল ফিরে গেলেও ঝড়ো ব্যাটিং চালিয়ে যান কলিন মুনরো। তাই তো মাত্র সপ্তম ওভারেই দলীয় পঞ্চাশ পূরণ করে ফেলে তারা। তবে সাকিব আল হাসান ও মেহেদী মিরাজের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিপক্ষে হাঁসফাঁস করতে করতে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি মুনরোর।

ইনিংসের দশম ওভারের শেষ বলে সাকিবের বোলিংয়ে মিরাজের দারুণ ক্যাচে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন ৩৪ বলে ২৪ রান করা মুনরো। এরপরই হাল ধরেন টেলর এবং উইলিয়ামসন, গড়েন ১০৫ রানের জুটি। অথচ তাদের জুটিটা ভাঙতে পারতো মাত্র ৬ রানের মাথায়।

ইনিংসের দ্বাদশ ওভারের দ্বিতীয় বলের ঘটনা। সদ্যই উইকেটে আসা রস টেলরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। মিড অফ থেকে তামিম ইকবালের থ্রো ধরে উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম যখন উইকেট ভেঙে দেন, তখনো পপিং ক্রিজের অনেক বাইরে উইলিয়ামসন।

ঘটনাটা হতে পারতো এমন। কিন্তু টাইগার উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম করে বসেন বাচ্চাসুলভ ভুল। তামিমের করা থ্রোটি সরাসরি ছিলো উইকেট বরাবরই। কিন্তু বাড়তি সতর্কতা নিতে গিয়ে স্ট্যাম্পের সামনে এসে বল ধরে উইকেট ভাঙতে যান মুশফিক। ঠিক তখন তার হাতে লেগে আগেই পড়ে যায় বেলস।

যে কারণে পরে তিনি বল গ্লাভসে জমিয়ে উইকেট ভাঙলেও এবং কেন উইলিয়ামসন নিজের ক্রিকের অনেক বাইরে থাকলেও, বেঁচে যান রানআউট থেকে। আর এ জীবন কাজে লাগিয়ে নিজের দলকে জয়ের দিকে পরিচালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন কিউই অধিনায়ক।

দ্বাদশ ওভারে যখন ঘটে এ ঘটনা, তখন ১৬ বল খেলে মাত্র ৮ রান করেছিলেন উইলিয়ামসন। নিউজিল্যান্ডের রান তখন ১১.২ ওভারে ২ উইকেটে ৬১ রান। উইলিয়ামসনের উইকেটটি তখন পড়লে স্কোরকার্ড রূপ নিতো ৩ উইকেটে ৬১ রানে। সেটি হয়নি মুশফিকের ভুলের কারণে।

উইলিয়ামসনকে আউট করতে অপেক্ষায় করতে হয় ৩২তম ওভার পর্যন্ত। সে ওভারের প্রথম বলে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে এবং শেষ বলে উইকেটরক্ষক টম লাথামকে ডিপ মিডউইকেটে ক্যাচে পরিণত করেন মেহেদী মিরাজ। তাতেই জমে উঠতে শুরু করে নিউজিল্যান্ডের হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ।

মুশফিকুর রহীমের বাচ্চাসুলভ ভুলের কারণে জীবন পেয়ে রস টেলরের সঙ্গে ১০৫ রানের জুটি গড়েন কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসন। তবে নিজে কখনোই সে অর্থে হাত খুলে খেলতে পারেননি, আড়ষ্ট ছিলেন পুরো ইনিংসেই।

৩২তম ওভারে মেহেদী মিরাজকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন মিডউইকেটে দাঁড়ানো মোসাদ্দেক সৈকতের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৭২ বলে ৪০ রান করেন উইলিয়ামসন। সে ওভারেরই শেষ বলে বাঁহাতি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লাথামও চেষ্টা করেন একই অঞ্চলে বড় শট খেলার।

কিন্তু তিনি ধরা পড়ে যান মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের হাতে। রানের খাতাই খুলতে ব্যর্থ হন লাথাম। মিরাজের এ জোড়া আঘাতে ফিরে আসে ম্যাচের প্রাণ।

পানি পানের বিরতির সময় মোসাদ্দেক সৈকতকে বোলিংয়ের নানান পরামর্শ দিচ্ছিলেন সাকিব আল হাসান। যা কাজে লেগে যায় একদম সঙ্গে সঙ্গে। ইনিংসের ৩৯তম ওভারে উইকেটে টিকে থাকা রস টেলরের উইকেট তুলে নেন মোসাদ্দেক। আউট হওয়ার আগে ৯১ বলে ৮২ রান করেন টেলর।

পরে কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে (১৩ বলে ১৫) মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং জিমি নিশামকে (৩৩ বলে ২৫) সাজঘরে পাঠান মোসাদ্দেক। কিন্তু মিচেল স্যান্টনার একপ্রান্ত ধরে রেখে এগিয়ে নেন দলকে। তবু ৪৭তম ওভারে ম্যাট হেনরিকে সরাসরি বোল্ড করে ফের আশা জাগিয়েছিলেন সাইফউদ্দিন।

মোস্তাফিজের করা ৪৮তম ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে জয় নিশ্চিত করেন ১২ বলে ১৭ রান করা স্যান্টনার। টাইগারদের পক্ষে বল হাতে ২টি করে উইকেট নেন মেহেদী মিরাজ, সাকিব, মোসাদ্দেক ও সাইফউদ্দিন।

এর আগে কেনিংটন ওভালে টস জিতে আগে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও জানান তিনি টস জিতলে আগে বোলিংই নিতেন। ফলে টসের সময়ই খানিক পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ।

তবে প্রতিপক্ষের আমন্ত্রণে ব্যাট করতে নেমে দুই ওপেনার তামিম ও সৌম্য ঠিকই শুরু করেন ইতিবাচক ভঙ্গিতে। দুই কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট এবং ম্যাট হেনরি শুরুতে খানিক মুভমেন্ট পেলেও টাইগার ব্যাটসম্যানদের দাপটে তা খুব একটা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি।

আগের ম্যাচের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে প্রথম ৮ ওভারেই ৪৪ রান করে বাংলাদেশ। ড্যাশিং ওপেনার সৌম্য তখন অপরাজিত ২৪ বলে ২৫ রান করে। নবম ওভারের প্রথম বলেই ম্যাট হেনরিকে বড় শট হাঁকাতে গেলে সরাসরি বোল্ড হয়ে যান তিনি।

পরে তামিমও টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। ১৪তম ওভারে লকি ফার্গুসনের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ব্যাটের ওপরের কানায় লাগে তার। শর্ট মিড উইকেটে দাঁড়িয়ে লোপ্পা ক্যাচ ধরেন ট্রেন্ট বোল্ট। আউট হওয়ার আগে ৩৮ বলে ২৪ রান করেন তামিম।

তৃতীয় উইকেটে জুটি বাঁধেন আগের ম্যাচের দুই নায়ক সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহীম। তবে এদিন আর লম্বা হয়নি তাদের জুটি। ঠিক পঞ্চাশ রান যোগ করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন মুশফিক। শর্ট কভারে ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল নিতে গিয়ে কাঁটা পড়েন রানআউটে। তিনি থামেন ১৯ রানে।

মুশফিক ফিরে গেলেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় সাকিব ঠিকই তুলে নেন ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি। কিন্তু তিনি আবারও ব্যর্থ নিজের ইনিংস বড় করতে। দলীয় ১৫১ রানের মাথায় কট বিহাইন্ড হয়ে ফেরার আগে ৭ চারের মারে ৬৮ বলে ৬৪ রান করেন সাকিব।

এরপরের গল্পটা পুরোটাই হতাশার। ব্যাটে-বলে করতে ব্যর্থ হন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। এ দুইয়ের আগে আশা জাগিয়েও ৩৩ বলে ২৬ রান করে ফিরে যান মোহাম্মদ মিঠুন।

মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে আসে ৪১ বলে ২০ রান, মোসাদ্দেক আউট হন ২২ বলে ১১ রান করে। শেষদিকে অল্প যা রান আসে তার পুরো কৃতিত্ব মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের। ইনিংসের একমাত্র ছক্কার সঙ্গে ৩ চারের মারে ২৩ বলে ২৯ রান করে দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন তিনি।

নিউজিল্যান্ডের পক্ষে বল হাতে ম্যাট হেনরি নেন ৪ উইকেট, ট্রেন্ট বোল্টের ঝুলিতে যায় ২ উইকেট। এছাড়া ১টি করে উইকেট নেন লকি ফার্গুসন, কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম এবং মিচেল স্যান্টনার।

এসএএস

 

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।