বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারি পেকারের ধাক্কা এবং আবারও ক্যরিবীয় রাজ
ক্যারি পেকার ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজের ধাক্কা তখনও সামলে উঠতে পারেনি ক্রিকেট, তথা আইসিসি। যে কারণে ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের সময় অস্ট্রেলিয়া যে দলটিকে খেলতে পাঠায়, সেটাকে বলা হচ্ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্য দল। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সেরা সেরা ক্রিকেটাররা তখনও ক্যারি পেকার সিরিজে চুক্তিবদ্ধ।
এমনই এক পরিস্থিতিতে চার বছর পর আবারও ইংল্যান্ডের মাটিতে গড়ালো বিশ্বকাপের আসর। অফিসিয়ালি যেটার নাম দ্বিতীয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ঠিক চার বছর আগের ফরম্যাটই ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপে। শুধু ফরম্যাট কেন, বিশ্বকাপ শেষে বিজয় মঞ্চে যে নাটক মঞ্চস্থ হলো, তা যেন প্রথম বিশ্বকাপেরই কার্বন কপি। অর্থ্যাৎ, চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেই ক্লাইভ লয়েডের হাতেই বিশ্বকাপ ট্রফি।
স্বাগতিক ইংল্যান্ড। প্রতিযোগির সংখ্যা আটটি। ভেন্যু ছয়টি। এবারও পৃষ্ঠপোষক প্রুডেন্সিয়াল এবং এবারও ক্লাইভ লয়েডের হাতে শিরোপা। ১৯৭৫ সালের পূনরাবৃত্তি বলা হবে না তো এটাকে কি বলা হবে?
তবে সেই যে ক্যারি পেকার ওয়ার্ল্ড সিরিজের কথা বলা হলো, তার ধাক্কায় টালমাটাল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। আইসিসির সামনে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বকাপ আয়োজন করার। অর্থ্যাৎ বিশ্বকাপটি ছিল আইসিসির অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা।
১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসায়ী ক্যারি পেকার তখনকার আইসিসির সঙ্গে প্রবল মতোবিরোধের জের ধরে আয়োজন করে বসেন ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ। আইসিসির নিষেধাজ্ঞার হুমকি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও তখনকার দিনের নিষিদ্ধ এই সিরিজে যোগ দেন বিশ্বের নামকরা সব ক্রিকেট তারকারা।
আইসিসির সাদা পোশাক ও লাল বলে দিনের আলোয় ‘ম্যাড়মেড়ে’ ওয়ানডের বিপরীতে ক্যারি পেকার সামনে নিয়ে আসেন চকচকে এক ক্রিকেটের প্রদর্শনির। রঙ্গিন পোশাক, সাদা বল (হলুদাভ), ফ্লাড লাইটের আলোয় খেলা, এক গাদা ক্যামেরায় খেলা সম্প্রচার মিলিয়ে ক্যারি পেকার তখন বিশ্ব ক্রিকেটেরই প্রধাণ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ালেন।
এ অবস্থায় প্রথম শুরু হওয়া আইসিসি ট্রফির শিরোপা জেতা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কানাডাকে নিয়ে আয়োজন করা হয় আট দেশের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। তবুও তাতে খুব একটা রক্ষা হয়নি। পরের দু’বছরও ওয়ার্ল্ড সিরিজে যোগ দিয়েছেন আরও অনেক তারকা ক্রিকেটার।
এই বিশ্বকাপও ছিল ৬০ ওভারের। গ্রুপ পর্বে ‘এ’ গ্রুপে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গে ছিল পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা। ‘বি’ গ্রুপে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত।
‘এ’ গ্রুপে ৩ ম্যাচের সবগুলোতে জিতে গ্রুপ সেরা হয়েই সেমি ফাইনালে ওঠে স্বাগতিক ইংল্যান্ড। পাকিস্তান জিতেছিল ২টা। দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিতে ওঠে তারা। অস্ট্রেলিয়া মাত্র কানাডাকে পরাজিত করতে পেরেছিল এবং গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় তাদের।
‘বি’ গ্রুপে ৩ ম্যাচের ২টিতে জিতে রান রেটের ব্যবধানে এগিয়ে থেকে উঠলো সেমিফাইনালে। নিউজিল্যান্ডও জিতেছিল ২ ম্যাচ। তারাও উঠলো সেমিতে। এই গ্রুপে শ্রীলঙ্কার কাছেও হেরেছিল ভারত। অর্থ্যাৎ কোনো ম্যাচ না জিতেই বিদায় নিতে হয়েছিল ভারতকে। সঙ্গে বিদায় নেয় শ্রীলঙ্কাও।
সেমিফাইনলে ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটি ছিল টান টান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ৩৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বসে ইংলিশরা। সেখান থেকে মাইক ব্রেয়ারলির ৫৩, গ্রাহাম গুচের ৭১ রানের ওপর ভর করে ৮ উইকেট হারিয়ে ২২১ রান তোলে। জবাব দিতে নেমে নিউজিল্যান্ড একেবারে কাছে এসে হেরে যায়। তারা তুলতে পেরেছিল ৯ উইকেট হারিয়ে কেবল ২১২ রান। অর্থ্যাৎ ৯ রানে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
অন্য সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে বলতে গেলে উড়িয়ে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গর্ডন গ্রিনিজের ৮৪ বলে ৭১, ডেসমন্ড হেইন্সের ১১৫ বলে ৬৫ রানের ওপর ভর করে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৯৩ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাব দিতে নেমে মাজিদ খানের ৮১ এবং জহির আব্বাসের ৯৩ রান সত্ত্বেও পারলো না পাকিস্তান। অলআউট হয়ে যায় ২৫০ রানে।
ফাইনালে আবারও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের তীর্থ লর্ডসে মুখোমুখি দুই দল। টস জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানায় ইংল্যান্ড। ব্যাট করতে নেমে এক ভিভ রিচার্ডসের তাণ্ডবের সামনেই হার মানতে বাধ্য হয় ইংল্যান্ড।
শুরুতে দ্রুত উইকেট হারায় ক্যারিবীয়রা। ৫৫ রানেই বিদায় নেয় টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান। এরপর ৯৯ রানের মাথায় বিদায় নেয় ৪র্থ উইকেট। ৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়া ক্যারিবীয়দের টেনে তোলেন ভিভ রিচার্ডস এবং কলিস কিং জুটি। দু’জনের ব্যাটে ওঠে ১৩৯ রান।
দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বসেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। ১৫৭ বলে অপরাজিত ১৩৮ রান করেন ভিভ রিচার্ডস। ৮৬ রান করেন কিং। নিচের সারির ব্যাটসম্যানরা একের পর এক বিাদয় নিলেও ভিভ রিচার্ডস টিকে থেকে দলকে পৌঁছে দেন ২৮৬ (৯ উইকেটে) রানের চুড়ায়।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ছিল ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত। মাইক ব্রেয়ারলির ৬৪ এবং জিওফ্রি বয়কটের ৫৭ রান এবং উদ্বোধনী জুটিতে ১২৯ রান সত্ত্বেও ইংল্যান্ড অলআউট ১৯৪ রানে। ক্যারিবীয় পেসার জোয়েল গার্নার ৩৮ রান দিয়ে একাই নেন ৫ উইকেট। এছাড়া কলিন ক্রফট ৪২ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। মাইকেল হোল্ডিং ৮ ওভারে ১৬ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। ৯২ রানের জয়ে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ফাইনালের সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ২৮৬/৯, ৬০ ওভার (ভিভ রিচার্ডস ১৩৮*, কলিস কিংস ৮৬; ফিল এডমন্ডস ২/৪০, মাইক হেন্ডরিক্স ২/৫০)
ইংল্যান্ড : ১৯৪/১০, ৫১ ওভার (মাইক ব্রিয়ারলি ৬৪, জিওফ্রি বয়কট ৫৭, গ্রাহাম গুচ ৩২; জোয়েল গার্নার ৫/৩৮, কলিন ক্রফট ৩/৪২, মাইকেল হোল্ডিং ২/১৬)।
ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯২ রানে বিজয়ী।
আম্পায়ার: ডিকি বার্ড এবং বারি মেয়ার।
সেরা খেলোয়াড়: ভিভ রিচার্ডস।
আইএইচএস/আরআইপি