‘সেই’ নান্নুর সাজানো প্রথম বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেই কোনো বিতর্ক

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৯:৪২ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট। সহযোগী নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন, ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান, মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস ও মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামকে সঙ্গে নিয়ে ব্লু ব্লেজার গায়ে চাপিয়ে শেরে বাংলার কনফারেন্স হলে ঢুকলেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দল ঘোষণার কাজও শুরু করলেন। তারপর প্রথা মেনে শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। হঠাৎ এক সাংবাদিকের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা নান্নু (মিনহাজুল আবেদিন নান্নু) ভাই, আপনি যখন ২০ বছর আগে প্রথম বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছিলেন তখন অনেক হইচই হয়েছিল। দলগঠন এবং পরে আপনাকে নেয়া নিয়েও অনেক কথা উঠেছিল। সেই আপনি প্রধান নির্বাচক হিসেবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে দল সাজালেন। অনুভূতিটা কেমন?’

নান্নুর ফরসা মুখ খানিক লালচে হয়ে গেল, তবে সে উত্তরটা তিনি পাশ কাটিয়ে গেলেন। বর্তমান প্রধান নির্বাচক তার প্রথম বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার প্রসঙ্গটা সু কৌশলে এড়িয়ে গেলেও ইতিহাস জানাচ্ছে বিশ বছর আগে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডে গিয়েছিল, তখন দল নির্বাচনে ঘটেছিল তুলকালাম কাণ্ড। বর্তমান বিসিবি পরিচালক, সাবেক ক্রিকেটার ও বোর্ডের বর্তমান ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন সিরাজ ছিলেন তখন প্রধান নির্বাচক।

তিনি ১৫ সদস্যের যে দলটি সাজিয়েছিলেন তাতে জায়গা হয়নি তখনকার দেশসেরা ব্যাটসম্যান এবং আজকের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর। এই ঘটনাকে ঘিরে ঘটে যায় তুমুল কাণ্ড। পত্র-পত্রিকায় কড়া সমালোচনা এবং চারিদিকে রব ওঠে, নান্নু কেনো নেই? নান্নুকে নিতে হবে।

মিডিয়াতেও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে নান্নুর পক্ষে এবং শেষপর্যন্ত সমালোচনা ও মিডিয়ার লেখালেখির কারণেই বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের একটি মহলের উদ্যোগে নিয়ম ও প্রথা ভেঙে প্রধান নির্বাচকের মতামতের বাইরে বিকেএসপিতে অনির্ধারিত বোর্ড সভা ডেকে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে দলে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান জাহাঙ্গীর আলমের জায়গায় নান্নুকে ঢোকানো হয়। এবং দলে সুযোগ পাওয়া নান্নু প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হাফসেঞ্চুরি করেন। স্কটিশদের বিপক্ষে চাপের মুখে করা তার ফিফটিই মূলত বাংলাদেশকে জয়ের সুবাস এনে দিয়েছিল।

তারপর ২০০৩ সালেও দলগঠনে কিছু সমালোচনার উদ্রেক ঘটেছিল। সেবারও বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা হয়নি তখনকার অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ আকরাম খানের। পরে মাশরাফির গোড়ালির ইনজুরিতে কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলতে উড়ে গিয়েছিলেন আজকের ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিকপাল আকরাম।

২০০৭ সালে ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। একসাথে দলে ঢোকেন তিন তরুণ তুর্কি সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহীম। এর মধ্যে সে সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক ও ২০০৩ বিশ্বকাপের অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটকে বাইরে রেখে ১৮ বছরের আনকোরা মুশফিকের ওপর আস্থা রেখে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন ফারুক। মুশফিকের অন্তর্ভুক্তির সমালোচনা না হলেও, দেশসেরা উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলটের বাদ পড়া নিয়ে হয়েছিল বিস্তর আলোচনা।

এরপর ২০১১ সালে ঘরের মাঠে ‘মাশরাফি ট্র্যাজেডি’। খেলোয়াড়ি জীবনের অসীম সাহসী, তুখোড় উইলোবাজ রফিকুল আলম নির্বাচক হিসেবে সাহসের পরিচয় না দিয়ে অতি সতর্ক-সাবধানী হবার চেষ্টা করেই ইতিহাসের খলনায়ক বনে যান। অসীম সাহসী মাশরাফি যে ইনজুরিকে জয় করার পর্যাপ্ত সাহস ও সামর্থ্য রাখেন- বোধ করি সেই বিশ্বাসটাই ছিলো না ২০১১ সালের প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলমের।

এবার যেমন তাসকিন আহমেদের ফিটনেসটাই দলে জায়গা না পাওয়ার মূল কারণ, ২০১১ সালে মাশরাফিকে বাদ দেয়ার কারণ হিসেবেও রফিকুল আলম ঠিক এই ফিটনেস ঘাটতির কথাই বলেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিলো চরম ভুল। কারণ মাশরাফি বরাবরই ইনজুরি আর অপারেশনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা এক সংগ্রামী ক্রিকেটারের প্রতিমূর্তি।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল অধিনায়ক মাশরাফির ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যায় নির্বাচকদের ঐ একটি সৎ সাহসী পদক্ষেপের অভাবে।

এরপর ২০১৫ সালেও বড় ধরনের কোনো সমালোচনা হয়নি। তবে চমক ছিলো সাহসী ও বেপরোয়া উইলোবাজ সৌম্য সরকারের অন্তর্ভুক্তি। আর এবার সে তুলনায় একদমই বিতর্ক নেই দলগঠনে। সে অর্থে দল সাজানো ও ক্রিকেটার নির্বাচনে তেমন কোনো তীর্যক কথাবার্তাও নেই।

তারপরেও সংবাদ সম্মেলনে দুটি প্রশ্ন উঠেছিল। প্রথমত তাসকিনের দলে না থাকা এবং তার বিকল্প হিসেবে আবু জায়েদ রাহীকে বেছে নেয়া, অফফর্মে থাকা টপঅর্ডার সৌম্য সরকারের বদলে অন্য কাউকে নেয়া যেত কিনা সে প্রশ্নটাও উঠলো।

এ দুই প্রশ্নের ব্যাপারে নিজের যুক্তিও পরিষ্কার জানিয়েছেন নান্নু। তাসকিনের জায়গায় রাহী কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাসকিন তো আসলে বড় সময় ইনজুরিতে ছিলো। ফিরে এসে লিগে মাত্র ১টি ম্যাচ খেলেছে। কাজেই তার ম্যাচ ফিটনেস এবং ছন্দে ফিরতে পেরেছে কি-না সে ব্যাপারে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিলো না। যে কারণে আমরা তাকে নিতে পারিনি।’

সৌম্যের ব্যাপারে অবশ্য অতীত অভিজ্ঞতার কথাই বলেন প্রধান নির্বাচক। তার ভাষ্যে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সৌম্য এবং লিটন হয়তো খুব একটা ফর্মে নেই। ব্যাটে রান পাচ্ছে না, এটাও ঠিক। তবে সৌম্য বা লিটন প্রমাণ করেছে যে তারা বড় মঞ্চে কার্যকরী ইনিংস খেলতে পারদর্শী। অতীতে তারা অনেক কার্যকরী ইনিংস খেলে দেখিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে তারা পুনরায় নিজেদের মেলে ধরতে পারবে।’

এআরবি/এসএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন