ফাস্ট ও বাউন্সি পিচে সৌম্যর ব্যাট হতে পারে কার্যকর অস্ত্র

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০১:৩৪ পিএম, ০৩ মার্চ ২০১৯

কঠিন সত্য হলো, সৌম্যর শতকে বদল হয়নি বাংলাদেশের ভাগ্য। আগের দিনই প্রায় অনিবার্য পরিণতি লিখা হয়ে গিয়েছিল টাইগারদের ললাটে। ইনিংস পরাজয় একরকম স্থিরই ছিল। ইনিংস পরাজয় এড়াতে দরকার ছিল ৪৮১ রান। হাতে ছিল ৬ উইকেট। আগের দিন ৪ উইকেটে ১৭৪ রান নিয়ে আজ যখন সৌম্য (৩৯) আর মাহমুদউল্লাহ (১৫) চতুর্থ দিন সকালে ব্যাটিংয়ে নামেন, তখনো ইনিংস পরাজয় এড়াতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৩০৭ রান।

ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নেইল ওয়েগনার আর গ্র্যান্ডহোমের ধারালো ফাস্টবোলিংয়ের বিপক্ষে ঐ রান করে ইনিংস পরাজয় এড়ানো যে ছিল খালি হাতে এভারেস্টের চূরায় ওঠার মতই কঠিন। সে কঠিন কাজটি শেষ পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। অনিবার্য ইনিংস পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া বাংলাদেশ শেষ অবধি ইনিংস পরাজয় এড়াতেও পারেনি।

তারপরও সৌম্য আর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। ১২৬ রানে তামিম, সাদমান, মুমিনুল আর মিঠুন আউট হবার পর সৌম্য আর রিয়াদ পঞ্চম উইকেটে দাঁতে দাঁত কামড়ে প্রতিটি মুহূর্ত লড়াই-সংগ্রাম করে অবস্থা বদলাতে ছিলেন সচেষ্ট।

ঐ চরম সংকটে তারা দুজন ২৩৫ রানের দারুণ জুটি গড়ে ইনিংস পরাজয় এড়ানোর পথে অনেকদূর এগিয়েও দিয়েছেন। লিটন দাস (১) আর মেহেদি মিরাজ (১) চরম ব্যর্থতার পরিচয় না দিলে হয়ত ইনিংস হার এড়ানো যেত। তারপরও সৌম্য-রিয়াদের সংগ্রামী শতকের প্রশংসা সবার মুখে মুখে।

ঠিক সোয়া চার ঘন্টা (২৫৫ মিনিট) উইকেটে কাটিয়ে ১৭১ বলে ১৪৯ রান করেছেন সৌম্য। যার ১১৪ রান এসেছে শুধু চার (২১টি ) ও ছক্কা (৫টি) থেকে।

চা বিরতির ঠিক পরে কিউই ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসন নতুন বল হাতে নেবার পর থেকে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়েন সৌম্য। অফস্ট্যাম্পের বাইরে সুইং মানে বলের লাইন ও ডিরেকশন ঠাউরে উঠতেই যেন সমস্যা হচ্ছিল। অবশ্য তখন বাড়তি সুইংও করছিলো বোল্টের বল। ভাল জায়গায় বল ফেলে তাই নতুন বল হাতে বেশ কয়েকবার পরাস্ত করলেন বোল্ট। সুইংয়ের কারণেই হোক কিংবা হঠাৎ নতুন বল দেখে আত্মবিশ্বাস ও আস্থায় চির ধরার কারণেই হোক, কেন যেন নতুন বলে বোল্টের গুডলেন্থ, ফুললেন্থ ডেলিভারির বিপক্ষে রান করতে কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে সেই বোল্টের ছোট্ট ইনকাটারে অমন দুর্দান্ত ইনিংসের সমাপ্তি।

সম্ভবত সিঙ্গেলস নিয়ে ক্যারিয়ারে প্রথম দেড়শো রানের মাইলফলকে পৌঁছুতে চেয়েছিলেন। অফস্ট্যাম্পের ইঞ্চি খানেক বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি সোজা ব্যাটে খেলতে গেলে হয়ত অনায়াসে খেলা যেত। কিন্তু স্ট্রেইট ব্যাটে না খেলে সৌম্য কব্জির মোচড়ে মিড উইকেট আর স্কোয়ার লেগের আশপাশে ফ্লিক করে সিঙ্গেলস নেবার আশায় ছিলেন। শরীর আর ডান পা ঠিক বলের পিছনে ছিল না। আর ঠিক ভিতরে ঢোকা বলকে খানিক আড়াআড়ি বা ক্রস ব্যাটে খেলার চেষ্টা তাই ব্যর্থ হল। ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল গিয়ে আঘাত হানলো উইকেটে। এভাবেই শেষ এক সংগ্রামী ইনিংসের।

আউট হবার আগের অল্প কয়েক মিনিট বাদ দিলে পুরো ইনিংসে সৌম্য ছিলেন আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। যেন গভীর সমুদ্রে প্রচন্ড ঝড়ের মাঝে এক সাহসী নাবিক।

ড্রাইভ, কাট, ফ্ল্যাশ, পুল, হুক আর ফ্লিক কোন শটই বাকি ছিল না। এই বোল্টের বাউন্সারে হুক করে ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে বিশাল এক ছক্কা হাঁকিয়েই পূর্ন করেছিলেন হাফ সেঞ্চুুরি।

এর পর শতরানের খুব কাছে গিয়েও সৌম্য ছিলেন শতভাগ সাহসী। ৮৯ থেকে লেগস্পিনার টড অ্যাস্টলকে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে পৌছে যান ৯৫ ‘তে। সেখান থেকে ফাস্টবোলার টিম সাউদিকে সামনের পায়ের ওপর ভর করে অফড্রাইভে মিডঅফ দিয়ে চার মেরে ৯৯। আর এক বল পর সাউদির খাটো লেন্থের বলকে বাতাসে না ভাসিয়ে কব্জি ঘুরিয়ে ডিপ স্কোয়ারে ঠেলে সিঙ্গেলসে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতরান পূর্ণ করেন সৌম্য।

ম্যাচ ড্র হলে সৌম্যর এ সেঞ্চুরি নিয়ে অনেক কথা হতো। সাতক্ষীরার এ ২৬ বছরের যুবা ‘জিরো থেকে হিরো’ হয়ে যেতেন। কিন্তু যেহেতু দল হেরেছে, তাই এমন লড়িয়ে শতক পূর্ণতা পায়নি। দিন শেষে কিছু প্রশংসাসূচক কথা বার্তাই সঙ্গী সৌম্যর।

তবে হ্যামিল্টনে আজ কিউই ফাস্টবোলারদের বোলিং তোড়ের মুখে তার এ ১৪৯ রানের ইনিংসটিতে সৌম্য একটি বার্তা দিয়ে ফেলেছেন। তা হলো, সৌম্য সরকারের মেধা-মান আর সামর্থ নিয়ে কটাক্ষ-অবজ্ঞা করা অযৌক্তিক। যারা তাকে নিয়ে সমালোচনা করেন, তির্যক ভাষায় বলেন, 'সৌম্য ... কোটায় খেলে। তাকে অনর্থক দলে নেয়া হয়। তার না আছে পারফরমেন্স, না তার ব্যাট ধারাবাহিক-তারাও এ ইনিংস দেখার পর চুপ মেরে গেছেন।'

সমালোচকদের মুখে তালা পড়বেই। ভুলে গেলে চলবে না, এই সৌম্য ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একদম শুরুতে পাকিস্তান (১১০ বলে ১২৭) আর দক্ষিণ আফ্রিকার মত বিশ্বমানের দলের বিপক্ষে পর পর দুই খেলায় যথাক্রমে ৭৯ বলে ৮৮ আর ৭৫ বলে ৯০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, দেশের বাইরে ফাস্ট ও বাউন্সি পিচে ভাল খেলার পর্যাপ্ত সাহস, সামর্থ্য ও আস্থা আছে তার। ঐ সব ফাস্ট পিচে ভাল খেলার পূর্ব শর্ত দুটি। এক, সাহস আর দুই, উইকেটের সামনে ও দুদিকে শটস খেলার ক্ষমতা। বিশেষ করে অফস্ট্যাস্পের বাইরে কাট, ফ্ল্যাশ, পুল ও হুক-খেলার ক্ষমতা বেশি থাকা জরুরী। তা সৌম্যর আছে।

আর সে কারণেই ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নেইল ওয়েগনারদের বাড়তি গতি ও বাউন্স তাকে ঘায়েল করতে পারেনি। সৌম্য বুক ভরা সাহস নিয়ে তাদের মোকাবিলা করেছেন। আর লেগ স্পিনার টড অ্যাস্টল কে তো গোণায়ই আনেনি। এ কিউই স্পিনারকে মুড়ি মুড়কির মত উড়িয়ে মেরেছেন।

হ্যাঁ, চাঁদেরও নাকি কলঙ্ক আছে। সৌম্যরও অফস্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করা ডেলিভারির বিপক্ষে পা না নিয়ে ব্যাট পেতে দেয়ার ‘কু অভ্যাস’ আছে। বেশির ভাগ সময় পা না নিয়ে কিংবা অল্প পা বাড়িয়ে অফস্টাম্পের আশপাশে ব্যাট চালিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন সৌম্য। সেই ‘কু অভ্যাস’ ত্যাগ করতে পারলে সৌম্যর ব্যাট হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কার্যকর অস্ত্র। তিন ফরম্যাটেই সৌম্য হতে পারেন বড় নির্ভরতা। আজকের ইনিংসটিই যে তার বড় প্রামাণ্য দলিল। কাজেই তার মান ও সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং অবান্তর কথা বার্তা বলা নেহায়েত অযৌক্তিক।

এআরবি/এমএমআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।