আবারও সময়মত রংপুরের হাল ধরবেন গেইল?

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৩:৪১ পিএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

তার সম্পর্কে নতুন করে বলার কিইবা আছে? গেইলের ব্যাটের তেজ আর ঝাঁঝ নিয়ে হাজারো কথা বললেও ফুরোবে না। ‘ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক, বিধ্বংসী, খুনে- যত বিশেষণই দেয়া হোক না কেন, কম হয়ে যাবে।

জ্যামাইকার ৩৯ বছর চার মাস ১৪ দিন বয়সী ক্রিস্টোফার হেনরি গেইলের ব্যাট যে তারচেয়েও ধারালো। যার সাথে শুধু প্রচন্ড ‘সাইক্লোন’, ‘হ্যারিক্যান’ আর ভয়াবহ ‘সুনামিরই’ তুলনা চলে। কারণ, গেইলের ব্যাট যেদিন জ্বলে ওঠে এ জ্যামাইকান (কিংস্টন), যেদিন নিজেকে খুঁজে পান, তার ব্যাট থেকে যে ম্যাচে ছক্কার নহর বইতে থাকে- সেদিন আসলে বিশ্বের কোন দলের কোন বিশ্বমানের বোলারেরও কিছু করার থাকে না।

দিনে বিশ্বের যে কোন বোলিং শক্তি দুমড়ে মুচড়ে, লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায়। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাট বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিধ্বংসী উইলোবাজ গেইলই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। ২০ ওভারের ফরম্যাটের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।’

একজন ব্যাটসম্যানের একার পক্ষে যে কোন ফরম্যাটে যত রকম রেকর্ড গড়া সম্ভব, টি-টোয়েন্টি’তে তার সবগুলি রেকর্ডই আছে গেইলের। ২০ ওভারের ফরম্যাটে শুধু বিধ্বংসী উইলোবাজ হিসেবেই যে তিনি বেশি পরিচিত, তা নয়। ব্যাট হাতে টি-টোয়েন্টিতে কোন রেকর্ড নেই তার, বলুন?

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান তিনি। সবচেয়ে বেশি ১০০০০ প্লাস রান তার। সর্বাধিক ২১ সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরির মালিকও এ দীর্ঘদেহী ক্যারিবয়ান। আবার সবচেয়ে বেশি চার ও ছক্কা হাকিয়েছেন গেইল। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এক ম্যাচের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত ইনিংসটিও (১৭৫) তার। শতরান করায়ও তার ধারে কাছে নেই কেউ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেরুণ জার্সি গায়ে (দুটি), আইপিএল (ছয়টি), বিগ ব্যাশ, সিপিএল আর বাংলাদেশের বিপিএলসহ (পাঁচটি) গেইল যে ২১টি সেঞ্চুরি করেছেন, শতরানকারীদের মধ্যে তার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রেন্ডন ম্যাককালাম করেছেন তার তিন ভাগের একভাগ সেঞ্চুরি। দেশি-বিদেশি মিলে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে গেইলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শতরানকারী নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককালামের। এ কিউই টপ অর্ডারের সেঞ্চুরি সাতটি।

ভারতের বিশ্ব মাতানো আসর আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের মত বাংলাদেশের বিপিএলেও গেইলের ব্যাট সমান সচল। বিপিএলের আগের পাঁচ আসরে প্রতিবার অংশ নেয়া গেইলই একমাত্র ব্যাটসম্যান যার আছে পাঁচ-পাঁচটি সেঞ্চুরি রয়েছে। যার প্রথম দুটি (১০১ ও ১১৬), ২০১২ সালে বিপিএলের প্রথম আসরে বরিশাল বার্নার্সের হয়ে। তৃতীয় শতকটি ২০১৩ সালে দ্বিতীয় বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের পক্ষে (৫১ বলে ১১৪)।

আর সর্বশেষ গতবারও একজোড়া শতরান করেছিলেন গেইল। শুধু দুটি সেঞ্চুরি করাই নয়। বলা যায় রংপুর রাইডার্সকে এলিমিনেটরের বৈতরণী পার করে দেয়া এবং ট্রফি নিশ্চিতের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও গেইলই করে দিয়েছিলেন।

এলিমিনেটর-এ খুলনা টাইটান্স আর ফাইনালে ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে ঝড়ো শতক দুটিই আসলে রংপুরকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে রেখেছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

এবার অবশ্য প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। আগের বার চার নম্বর দল হিসেবে শেষ চারে পা রাখা রংপুরের এলিমিনেটর-১’এ আগে জয় দরকার ছিল। না হয় সেখান থেকেই বিদায় ঘটতো। আর এবার মাশরাফির রংপুর এক নম্বর হয়ে শেষ চারে। তাই এবার আর কোয়ালিফায়ার-১ গেইলের দলের জন্য ‘সাডেন ডেথ’ নয়। জিতলে সরাসরি ফাইনালে। হারলেও সুযোগ থাকবে। তখন এলিমিনেটরের বিজয়ীর সাথে খেলতে হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি।

Gayle

কাজেই একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি গেইলের দল। তাহলো ফাইনাল খেলতে নক আউট পর্বে অন্তত একটি ম্যাচ জিততেই হবে। সেই জয়ে গেইল কি আগের মত ভূমিকা রাখতে পারবেন? এবারো সময়মত জ্বলে উঠবে তার ব্যাট? কাল রংপুর আর কুমিল্লা কোয়ালিফায়ার-১ ম্যাচ যত কাছে আসছে, সেই প্রশ্ন ততই জোরালো হচ্ছে।

সবার একটা কৌতুহলি প্রশ্ন, ‘ আচ্ছা গেইল কি আগের বারের মত এবারো ঠিক সময়মত হাল ধরে রংপুরকে জায়গামত পৌঁছে দেবেন? রাউন্ড রবিন লিগ পর্বে তার ব্যাট কথা বলেনি দেখে রংপুর সমর্থকদের বড় অংশ হতাশ। কিন্তু তারপরও গেইলই তাদের আশার প্রদীপ।

তাই কাল ৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচেও গেইলের দিকে তাকিয়ে রংপুর। ‘আমি বা আমরা গেইলের দিকেই তাকিয়ে, গেইলই ভরসা’- সরাসরি এমন মন্তব্য না করলেও গতকাল সন্ধ্যায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে হারিয়ে এক নম্বর হবার পর মিডিয়ার সাথে কথা বলতে এসে মাশরাফি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনিও নকআউট পর্বে গেইলের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছেন।

তার প্রবল বিশ্বাস ও আস্থা, গেইল যে কোন সময় জ্বলে ওঠার ক্ষমতা রাখেন এবং একাই ম্যাচে ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন। তার কথায় পরিষ্কার, আগের বারের মত মাশরাফি এবারো গেইলের ব্যাটিং জাদুর অপেক্ষায়; কিন্তু গেইল এখন পর্যন্ত সেভাবে নিজেকে খুঁজে পাননি। রীতিমত রান খরায় ভুগছেন।

তার ব্যাট কি এবার আদৌ কথা বলবে? প্র্যাকটিস ও ম্যাচে গেইলের হাঁটাচলা, হাবভাব ও ব্যাটিং দেখে কি মনে হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে রংপুর অধিনায়কের আত্ববিশ্বাসী ও আস্থার সংলাপ, ‘দেখেন ক্রিকেটে তো কিছুই বলা যায় না। আজকেই গেইল ভাল খেলবে এমন গ্যারান্টি দেয়াও যায় না। বাট সে এমন এক ক্লাসের ক্রিকেটার এবং পারফরমার, যে কিনা একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে ফেলতে পারেন। সেই প্রমাণ যে শুধু আগেরবার বিপিএলে দিয়েছেন তাই নয়, সারা বিশ্বে অনেকবার এই ফরম্যাটে প্রমাণ মিলেছে গেইল একাই ‘একশো’।

সত্যিই তাই। গেইল এমন এক পারফরমার, যার সম্পর্কে আগাম মন্তব্য করা রীতিমত বোকামি। এবার রংপুরের হয়ে রাউন্ড রবিন লিগের ১০ ম্যাচে (১+৮+২৩+৭+০+৫৫+২+১+১০+৩৫* = ১৪২) গেইল একদমই রান পাননি বলেই যে নকআউট পর্বে পাবেন না- তা আগাম বলা কঠিন।

কারণ, ইতিহাস জানাচ্ছে আগেরবারও রাউন্ড রবিন লিগে গেইল ততটা উজ্জ্বল ছিলেন না। পার্থক্য একটাই, এবার ১০ ম্যাচ খেলে একবার মাত্র পঞ্চাশে পা রেখে দেড়শোর নিচে রান করেছেন, আর আগেরবার রবিন লিগে আট খেলায় (১৭+৫০+৫১+১৬+৩৩+৫+০+৩৮ = মোট ২১০ রান) ২টি ফিফটি সহ ২০০ প্লাস রান করেছিলেন।

রাাউন্ড রবিন লিগে তার হাফ সেঞ্চুরির একটি ছিল সিলেট সিক্সার্সের বিপক্ষে ৩৯ বলে ৫০ (পাঁচ ছক্কা, ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর শেরে বাংলায়) আর অন্যটি ঠিক তার পরেরদিন ২১ নভেম্বর ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে ২৮ বলে ৫১ (চার ছক্কা)। দুটি হাফ সেঞ্চুরির বিপক্ষে একটি শূন্য ছিল। সেটা ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে অফ স্পিনার মেহেদি হাসানের বলে প্রথম বলেই বোল্ড হয়েছিলেন।

সেই গেইল এলিমিনেটর রাাউন্ডে খুলনা টাইটান্সের বিপক্ষে রংপুরের জয়ের নায়ক। ৫১ বলে ১৪ ছক্কা, ২৪৭.০৬ স্ট্রাইকরেটে ১২৬ রানের ঝড়ো-বিধ্বংসী ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা। কোয়ালিফায়ার-২ এ অবশ্য রান করতে পারেননি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে ১০ বলে ৩ রান করে তরুণ অফস্পিনার মেহেদি হাসানের বলে শোয়েব মালিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।

কিন্তু ফাইনালে আবার স্ব-মূর্তিতে ফিরলেন। সাকিব, সুনিল নারিন ও আফ্রিদির ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে ছক্কা বৃষ্টিতে মাঠ সয়লাব। টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচের এক ইনিংসে সর্বাধিক ১৮ ছক্কা হাঁকিয়ে বিশ্ব রেকর্ড। ৬৯ বলে ১৮ ছক্কা ও ২১১.৫৯ স্ট্রাইকরেটে ১৪৬ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস।

এক গেইল ‘সাইক্লোনে’ ঢাকার শিরোপা স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। শেষ হাসি মাশরাফির। রংপুরেরও। এবারও ঠিক সময় মত সেই গেইলের দেখা মিলবে কি? শুধু রংপুর ফ্র্যাঞ্চাইজি, টিম ম্যানেজমেন্ট, মাশরাফি বাহিনী আর রংপুর সমর্থকরাই নয়, সারা বাংলাদেশ তা দেখতে অধীর।

দেখা যাক গেইল এবার সবার সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন কি না? গেইলভক্তরা আশাবাদী হতেই পারেন, বিপিএলে গেইলের সব ক’টা সেঞ্চুরি কিন্তু এই শেরেবাংলায়। বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট তাই গেইলেরও যে সাফল্যের স্বর্গ! এবং তার ২১টি টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির মধ্যে সর্বাধিক সেঞ্চুরি কিন্তু এই মাঠে (৫টা)। পয়মন্ত এই ভেন্যুতেই কি তবে দেখা যাবে সেই গেইল ম্যাজিক!

এআরবি/আইএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।