গায়ের জোরে ছক্কা হাঁকানোর লড়াইয়ে সহজ জয় ক্যারিবীয়দের!
সাফল্যের সেই সোনালী দিন আর নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। কিন্তু ক্যারিবীয়দের একটি সামর্থ্য এখনো আগের মতই অটুট আছে- তা হলো, ‘পাওয়ার হিটিং’।
শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে বিগ হিট নেয়ার কাজটি ক্যারিবীয়রা ঠিক আগের মতই ভাল পারেন। তবে এজন্য চাই অনুকূল ক্ষেত্র। সহায়ক উইকেট দরকার। শেরে বাংলার টিপিক্যাল স্লো এন্ড লো ট্র্যাক হলে চলবে না। পিচে বল পড়ে থেমে আসলে চলবে না। ঠেলাগাড়ীর গতি আর কোমড় বা তার নীচের উচ্চতায় থাকলেও হবে না। মাঝে মধ্যে নীচুও হওয়া যাবে না।
মাঝারি গতি আর গড়পড়তা কোমড় থেকে পেট বরাবর উচ্চতায় আসলেই চলবে। আর এমন উইকেট মানেই ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড ও ডুয়াইন ব্রাভোদের সাফল্যের স্বর্গ। এবার বাংলাদেশে ঐ তারকাদের কেউ নেই।
তাতে কি এভিন লুইস, সাই হোপ, নিকোলাস পুরান আর কিমো পলরা তো আছেন। উইকেট একটু অনুকূল হলে তারাও কম যান না, তাদেরও সামর্থ্য আছে মোটামুটি স্পোর্টিং পিচ পেলে যাকে তাকে মুুড়ি-মুড়কির মত উড়িয়ে মারার।
আজ দুপুরে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের স্পোর্টিং পিচে সেই দেখা মিললো। বাংলাদেশের বোলারদের বিপক্ষে কি উত্তাল উইলোবাজিটাই না করলেন সাই হোপ আর কিমো পল। ১৩০ রান ২০ ওভারে মোটেই কঠিন নয়। সহজ লক্ষ্য।
অনেকেই বলছেন টার্গেট কম ছিল তাই ক্যারিবীয়রা ইচ্ছেমত চার ছক্কার ফুলঝুৃরি ছুটিয়ে বাংলাদেশের বোলিংকে লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে। আসলেই কি তাই?
এমন যুক্তি ধোপে টিকবে না । কারণ লক্ষ্য যাই থাকুক না কেন, টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে চরমভাবে পর্যুদস্ত ক্যারিবীয়দের আসলে দরকার ছিল জয়। জয় নিশ্চিত করা যেখানে মুল লক্ষ্য থাকে, সেখানে আর যাই হোত তেড়েফুড়ে মারার দরকারই বা কি? তারা অযথা তেড়েফুড়ে মারতে গিয়ে নিজের বিপদই বা ডেকে আনবে কেন ?
কিন্তু ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ম্যাচ শেষ করলো মাত্র ১০.৫ ওভারে। মানে ইনিংসের ৫৫ বল আগে। আসল কথা হলো, উইকেটটা ভাল ছিল। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আজকাল যেমন ফ্ল্যাট ব্যাটিং ট্র্যাকে খেলা হয়, ততটা না হলেও বাংলাদেশে সাধারণত বিপিএল বা অন্য কোন টি টোয়েন্টি সিরিজ যেমন নির্জীব, স্লো আর লো উইকেটে হয়, ঠিক তেমন নয়। বাড়তি বাউন্স না হলেও বল নীচু হয়নি। মোটামুটি গতিতে ব্যাটে এসেছে। আর সেটাই ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের চার ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে যথেষ্ঠ ছিল ।
তারাও অমন পিচের অপেক্ষায়ই ছিলেন। কারণ এভিন লুইস, সাই হোপ আর কিমো পলরা খুব ভালই জানেন, আমাদের বিগ হিট খেলার সামর্থ্য আছে পর্যাপ্ত। বল থেমে আর নীচু হয়ে না আসলেই হয়। আমরা চার ও ছক্কায় মাঠ মাতাবো। আর তারা ঠিক তাই করেছেন। আর সে কারণেই ওয়ানডে সিরিজে একদিক আগলে পাশাপাশি রান চাঁকা সচল রাখা সাই হোপের ‘রুদ্র মূর্তি’ ও কিমো পলের ছক্কা বৃষ্টি।
স্লো ও লো উইকেটে মেহেদি হাসান মিরাজ টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে ক্যারিবীয়দের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছেন। তাকে খেলতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে উঠেছেন ক্যারিবীয়রা। আজ তুলনামূলক ভাল উইকেটে সেই অফস্পিনারকেই ইচ্ছেমত খেললেন লুইস আর হোপ।
মিরাজের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার থেকে তিন ছক্কার সাথে লেগ বিফোর সুত্রে পাওয়া এক বাউন্ডারিতে ২৩ রান তুলে বাংলাদেশের বোলিং মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেন ক্যারিবীয় ওপেনাররা। এরপরে আরও এক ওভার বোলিং করে আরও ১৮ রান দিয়েছেন মিরাজ। মোট পাঁচটি ছক্কা হজম করেছেন টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজে রীতিমত ক্যারিবীয় ত্রাস হয়ে দেখা দেয়া এ অফস্পিনার।
আবু হায়দার রনি আর সাইফউদ্দীনরাও প্রচুর মার খেয়েছেন। তাদেরও মুড়ি-মুড়কির মত উড়িয়ে মেরেছেন উইন্ডিজ উইলোবাজরা। তবে বাকি দুই স্পিনার অফব্রেক বোলার মাহমুদউল্লাহ (৬.৫) আর অধিনায়ক সাকিব (৮.৩৪) তুলনামুলক কম রান দিয়েছেন। তিন পেসার আবু হায়দার রনি (এক ওভারে ১৫), মোস্তাফিজ (এক ওভারে ১৫) ও সাইফউদ্দীনও (এক ওভারে ১৩) বেদম মার খেয়েছেন।
তার মানে পরিষ্কার, ক্যারিবীয়রা স্পোর্টিং পিচ পেলে ঠিক চার ও ছক্কায় মাঠ মাতাতে পারেন। কারণ তাদের শরীরে শক্তি আছে। বলের ঠিক পিছনে শরীর না নিয়েও বেশ কিছু শটস প্রায় জায়গায় দাঁড়িয়ে সীমানার ওপারে একদম গ্যালারির মাঝখানে নিয়ে ফেলেছেন ক্যারিবীয়রা।
আর সেটাই পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসমানরা। উইকেটে বল একটু জোরে আসলে আর বাউন্সটা শেরে বাংলার চেয়ে তুলনামুলক বেশী হলেও তারা চার ছক্কার নহর বইয়ে দিতে পারেন কম।
কারণ তাদের পাওয়ার মানে শারীরিক শক্তিই কম। ক্যারিবীয়রা জায়গায় দাঁড়িয়ে অনায়াসে সীমানার ওপারে ৮০-৯০ গজের বেশী নিতে পারলেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তা পারেন কম।
সবচেয়ে বড় কথা, গায়ের শক্তির জোরে ছক্কা হাঁকানোর ক্ষমতা সীমিত। আজকের ম্যাচে সে সত্যই নতুন করে দেখা মিলেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের হেড কোচ স্টিভ রোডস মনে করেন, নাহ- তার দলের ব্যাটসম্যানদেরও বিগ হিট নেয়ার পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে।
আজই প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেকনিকে না গিয়ে শক্তিতে পুল খেলতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। তামিম ছাড়া সবাই স্কোয়ার অফ দ্যা উইকেটে পুল খেলতে গিয়ে শক্তি খাটানোর চেষ্টা করেছেন। স্কোয়ার লেগ ও মিড উইকেটের চেয়ে তারা লং অন আর ওয়াইড মিড উইকেটের মাঝখান দিয়ে মারতে চেষ্টা করেছেন বেশী।
খেলা শেষে বাংলাদেশের সীমিত ওভারের ব্যাটিং উপদেষ্টা নেইল ম্যাকেঞ্জিও তা স্বীকা করলেন। তার ব্যাখ্যা, ‘আমার মনে হয় কটরেল আর থমাসের বল একটু বাড়তি গতি ও উচ্চতায় এসেছে। সাকিব দেখিয়েছে বাড়তি গতির উইকেটে কিভাবে খেলতে হয়। বাকিরা স্কয়ার লেগের সামনে দিয়ে খেলতে চেষ্টা করেছে বেশী। তারা পেস কাজে লাগিয়ে স্কয়ারের লেগের পিছনে খেললেই বিপর্যয় ঘটতো না।’
ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং দেখেই বোঝা গিয়েছে উইকেট ভালো ছিলো। দিন শেষে বাংলাদেশের স্বল্প পরিসরের ব্যাটিং উপদেষ্টা নীল ম্যাকেঞ্জির কন্ঠেও শোনা গেলো পেস এবং বাউন্স- দুটোই বেশি ছিলো সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজকের ম্যাচে।
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের ব্যাটিং তান্ডব আর বাংলাদেশের ব্যাটিং উপদেষ্টার অকপট স্বীকারোক্তি, উইকেটে পেস ও বাউন্স তুলনামূলক বেশি ছিল- তার মানে দাঁড়ালো ক্যারিবীয় বধে ঘুরে ফিরে সেই স্লো এন্ড লো ট্র্যাকই দরকার। যেখানে মিরাজকে মনে হবে মুত্তিয়াহ মুরালিধরন কিংবা মুশতাক কিংবা হরভজন আর শেল্ডন কটরেল ও থমাসরাও সংহার মূর্তি ধরতে পারবেন না।
শেরে বাংলায় পরের দুই ম্যাচে হয়তো দেখা যাবে আবার সেই টিপিক্যাল স্লো এন্ড লো ট্র্যাক! এবং তাতে তিন পেসারের ফর্মুলা থেকে সরে সাকিব-মিরাজের সাথে হয়তো একাদশে দেখা মিলবে বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপুর।
এআরবি/এসএএস/এমএস