‘শর্ট বলে’ ছক্কা হাঁকাতে গিয়েই যত বিপত্তি!
ম্যাচের আগের দিন প্রেসের সাথে কথা বলতে গিয়ে টাইগার কোচ স্টিভ রোডস জানিয়ে দিয়েছিলেন, কে বলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বড় শটস খেলার সামর্থ্য নেই? এটা ভুল ধারণা। আমাদের দলের ব্যাটসম্যানরাও ‘বিগ হিট ’ খেলতে পারে। তাদেরও সামর্থ্য আছে বড় শটস খেলার। তারাও পারে ছক্কা হাঁকাতে।’
কোচের এমন মন্তব্যেই একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা। সবাই ভাবলেন, আরে কোচ স্টিভ রোডস যখন সার্টিফিকেট দিয়েছেন, আমরা বিগ শট খেলতে পারি, আমাদেরও ছক্কা হাঁকানোর সামর্থ্য আছে বেশ- তাহলে তো ম্যাচে তা করে দেখাতেই হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ!
আজ সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে যেন সেই সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে চাওয়া। কোচের কথা সত্য প্রমাণ করতেই যেন একযোগে সবার বড় শটস খেলার সাধ জাগলো। বলের লাইন ও লেন্থ দেখে, বিচার না করে বিগ হিট বিশেষ করে পুল শট খেলতে গেলেন তামিম, লিটন, সৌম্য আর সাকিবও। আর অতিমাত্রায় পুল খেলার চেষ্টাটাই সর্বনাশের পথে প্রথম পদক্ষেপ।
আর বেশি করে বিগ হিট নেয়ার চেষ্টা এবং একটু খাটো লেন্থের বল পেলেই তেড়েফুঁড়ে পুল খেলতে যাওয়ার পুরো সুযোগটা নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাষ্টবোলাররা।
কট্টেল আর থমাসও বারবার খাট লেন্থে বল ফেলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পুল খেলতে প্রলুব্ধ করেছেন। বোঝাই গেল, সেটাই ছিল হোমওয়ার্ক। আর ক্যারিবীয়দের লক্ষ্য-পরিকল্পনা এবং কৌশলের ফাঁদে পা দিয়েই মরণ ডেকে আনলেন স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা।
প্রথম ভুল পথে হাঁটলেন তামিম। খেলার বয়স তখন মাত্র দ্বিতীয় ওভার। কট্রেলের প্রথম ওভারের চার নম্বর বলে পুল করতে গিয়ে একটু আগেভাগে খেলে ফেললেন তামিম। বল পরে এসে লাগলো ব্যাটের ওপরের দিকে। চলে গেল মিড অফে। তামিম শুরুতে ফিরে গেলে দলের ওপর চাপ বাড়ে। পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের সাহস যায় কমে। সেটা আজ আবারও প্রমাণ হলো।
ঠিক পরের ওভারে আউট লিটন দাস। এবার বোলার ছিলেন থমাস। প্রায় একই ধরনের ডেলিভারি। লেন্থে কিছুটা খাট, তবে পুল খেলার জন্য ততটা শর্ট ডেলিভারি ছিল না; কিন্তু লিটন আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলেন পুল খেলবো। তাই টাইমিংয়ের হেরেফেরে বল দুরে না গিয়ে আকাশে উঠে চলে গেল মিড অনে।
চতুর্থ ওভারে আবারো উইকেটের পতন। সৌম্য আউট। এবারও বোলার কট্রেল। এটু খাট লেন্থের ডেলিভারি। বাঁ-হাতি কট্রেলের একটু কৌণিক বল সৌম্য ঠিক শরীর ও পা পিছনে না নিয়ে চালালেন। উদ্দেশ্য পুল খেলা; কিন্তু শটের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সেটাও উঠলো আকাশে।
ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ শটের সাথে যোগ হলো বাজে রান আউট। নির্ভরতার প্রতীক মুশফিক রান আউট হলেন। নিজে স্ট্রাইকে থেকে কভার আর পয়েন্টর মাঝে ঠেলে সিঙ্গেলস নিতে গিয়ে আর পৌঁছাতে পারেননি মুশফিক। পয়েন্ট থেকে আসা পাওয়েলের ডিরেক্ট থ্রো তাকে সাজ ঘরে ফেরত পাঠালো।
পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে বোর্ডে রান ৫৪। এটা বিনা উইকেটে বা এক উইকেটে থাকলে বলা যেত শুভ সূচনা। আদর্শ সূচনা; কিন্তু ঐ রানেই চার চারজন সাজঘরে। এরপর পঞ্চম উইকেটে সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ খানিক্ষণ লড়াই করলেন শুরুর ক্ষত সারতে। হোক ভিন্ন ফরম্যাটে, মানে ৫০ ওভারের খেলায়, তারপরও দলের বিপর্যয়ে বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর রেকর্ড আছে।
কিন্তু কেন যে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এলেই কেমন যেন হয়ে যান রিয়াদ। দলের বিপর্যয়ে খানিক বিচলিত ও অপ্রস্তুত মনে হয় তাকে। আজও ঠিক তাই মনে হলো। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, অস্বস্তিতে আছেন। আর তাই বাঁ-হাতি ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার কাট্রেলের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের আলগা ডেলিভারিকে জায়গায় দাঁড়িয়ে হাতে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন রিয়াদ।
এমনিতে সুযোগ পান না। দল থেকে ম্যাচ খেলতে পারছেন না তেমন, আর একাদশে থেকেও ব্যাটিং পাচ্ছেন নাম মাত্র। যখন ক্রিজে যাচ্ছেন তখন অল্প কটা বল বাকি থাকছে; কিন্তু আজ বড় ইনিংস খেলার প্লাটফর্ম ছিল আরিফুলের সামনে। যখন উইকেটে গেলেন তখন খেলার বয়স মাত্র ১০.২ ওভার। মানে ৫৮ বল ছিল বাকি।
একদিকে নিয়মিত বিরতিতে উইকেটের পতন ঘটলেও আরিফুল যখন উইকেটে গেলেন তখনো অপর প্রান্তে অধিনায়ক সাকিব নট আউট ৩৪ রানে। অনড়, অনমনীয় ৪০ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন। ৪৫ থেকে বিশাল এক ছক্কায় পৌঁছুলেন পঞ্চাশে।
কোথায় অধিনায়কের ছায়ায় থেকে সামনে এগিয়ে যাবেন; কিন্তু আরিফুল আর তা পারলেন না। ফাস্ট মিডিয়াম কিমো পলের বলে অফ সাইডে মিড অফ ও কভারের মাঝামাঝি জায়গার ওপর দিয়ে তুলে চার মারার পর মনে হচ্ছিল নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। মাহমুদউল্লাহর চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসীও লাগছিল; কিন্তু পরক্ষণেই সে ধারণা গেল পাল্টে। ইনিংসের ২৬ বল আগে বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার ফ্যাবিয়্যান অ্যালেনের বলে হাঁটুমুড়ে স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ডিপ স্কোয়ার লেগে।
এরপর অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিনও উইকেটে এসেই সেই আগেরদিনের নেটের অ্যাপ্রোচেই চালাতে গেলেন। প্রথম বলে রানের খাতা খোলা সাইফউদ্দিন দ্বিতীয় বলেই গেলেন পুল করতে। জায়গামত না লাগায় ক্যাচ উঠে গেল সীমানার ৫-৭ গজ সামনে।
সঙ্গী কেউ নেই। একা আর কতটুকু করা যায় অধিনায়ক সাকিবেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ১৫ বল আগে আউট হলেন অধিনায়কও। সারাক্ষণ ভাল খেলে শেষ পর্যন্ত সাকিবও বাঁ-হাতি কট্রেলের শর্ট বলে পুল করতে গিয়েই আকাশে তুলে ফিরে আসলেন।
৪০ বলে সাত বাউন্ডারি আর এক ছক্কায় ৫০ করা সাকিব শেষ পর্যন্ত ১৪১.৮৬ স্ট্রাইকরেটে ৬১’তে ফিরলেন। পরের ১০ রান আসলো মোটে তিন বলে। সাকিব আউট হবার পর শেষ ১৫ বলে যোগ হলো মাত্র ৭ রান।
এক ওভার আগে ১২৯-এ শেষ বাংলাদেশের ইনিংস। তবে সাকিব শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে থাকলে হয়ত আরও ২৫-৩০ রান যোগ হতো। তাতে করে রানটা ১৬০-এ গিয়ে ঠেকতে পারতো। পরের সেশনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান সাই হোপ, এভিন লুইস, নিকোলাস পুরান আর কিমো পলরা ব্যাট হাতে ঝড় তুলে মাত্র ৬৫ বলে ১৩০ রানের লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া দেখে নিশ্চয়ই ভাবছেন ১৬০ করলেই বা কি হতো?
তা হয়তো হতো না; কিন্তু আসল কথা হলো, বাংলাদেশের সামনে সুযোগ ছিল অনেক বেশি রান করার। সেটা যা হয়েছে, তারচেয়ে ৫০-৬০ বেশিও হতে পারতো। হয়নি ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলারদের শর্ট বলের ফাঁদে পা দেয়ায়।
ওয়ানডেতে পজিটিভ বোলিং মানে কম শর্ট বল করে বেশির ভাগ সময় ওপরে ওপরে বল করে সুবিধা হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অনায়াসে সে পজিটিভ আর গুডলেন্থ ডেলিভারিগুলো সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করেছেন। সেই না পারা থেকে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলাররা বেছে নিলেন ‘শর্ট বল’ ফর্মুলা।
ঠিক বাউন্সার ছোড়ার চেষ্টায় না গিয়ে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলাররাা আজ একটু বেশিই শর্ট বল করেছেন। আর সেগুলোকেই চার-ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ‘সর্বনাশ’ ডেকে আনলেন টাইগাররা।
এআরবি/আইএইচএস/এমএস