স্পিন পিচে চার স্পিনার নিয়ে খেলা সাময়িক লাভ, ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতি

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:৫০ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮

খালি চোখে এটা ‘মধুর প্রতিশোধ’। চার মাস আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে চরমভাবে পর্যদুস্ত হয়ে দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ। এবার ঘরের মাঠে সেই ম্যাচের সিরিজেই ক্যারিবীয়দের নাকাল করে ছেড়েছে সাকিবের দল।

তাই অনেকেই এটাকে সমুচিত ‘জবাব’, ‘বদলা’, ‘প্রতিশোধ’ বলে মন্তব্য করছেন। টাইগার অধিনায়ক সাকিব অবশ্য বিষয়টাকে কিছুতেই ওভাবে দেখতে নারাজ। তার চিন্তা-ভাবনা, অনুভব-উপলব্ধি আর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার সোজা কথা, ‘আজকাল সবাই হোম অ্যাডভান্টেজ নেয়। আমরাও নিয়েছি।’

সাকিবের ভাবটা এমন, সবাই যার যেমন সামর্থ্য, তেমন পিচে খেলে সফরকারি দলকে বেকায়দায় ফেলে সাফল্যর চেষ্টা করে। আমরাও তাই করেছি। আর সে কারণেই এবার চট্টগ্রাম ও ঢাকায় স্পিন সহায় পিচে চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নামা এবং শেষ হাসি হাসা।

এটা যে মহা অন্যায়, কেউ কখনো এমন পিচে খেলেনি, খেলেনা কিংবা এমন টার্নিং উইকেটে আগে কখনো টেস্ট হয়নি-তা নয়। আসলে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসও সাক্ষী দিচ্ছে, কম বেশি সব টেস্ট খেলিয়ে দল ঘরের মাঠে নিজেদের মত করে মানে নিজ দলের সম্ভাবনা ও সাফল্যর কথা মাথায় রেখেই পিচ তৈরি করে। সেভাবেই রণকৌশল আঁটে। দলও সাজায়।

ভাবা হচ্ছে, এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাকিব বাহিনীর চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নামাও সেই কৌশলেরই অংশ। তাতে শতভাগ সাফল্যও মিলেছে। সাফল্যে অনেক কথাই ঢাকা পড়ে যায়, তবে এবার বাংলাদেশের চার স্পিনার খেলানোর কথা ঢাকা পড়েনি। হয়ত পড়বেও না। কারণ টেস্ট ক্রিকেটের শুরুর ও মাঝামাঝি সময় যাই হোক না কেন, গত ৫০ বছরে এক টেস্টে চার চারজন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামা এবং একজন জেনুইন পেস বোলার না খেলানোও একটা রেকর্ড।

সর্বশেষ ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে ভারত অজিত ওয়াদেকারের নেতৃত্বে বিষেণ সিং বেদী, ভালা সুব্রমানিয়াম ভগবত চন্দশেখর , এরাপল্লি প্রসন্ন আর আর ভেঙ্কটরাঘবন-চার স্পিনার দিয়ে একাদশ সাজিয়ে মাঠে নেমেছিল। একজন মাত্র পেস বোলার অবশ্য ছিলেন । নাম ভেঙ্কটারামান সুব্রমানিয়া।

এবার বাংলাদেশ তাই করেছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় দুই বাঁহাতি সাকিব-তাইজুলের পাশে দুই অফস্পিনার মিরাজ-নাঈমকে খেলানো হয়েছে। চট্টগ্রামে একমাত্র পেসার হিসেবে মোস্তাফিজ খেললেও ঢাকায় একজন পেসারও ছিল না। অধিনায়ক সাকিব দুই ইনিংসে বোলিংয়ের সূচনা করেন। বাংলাদেশের স্পিনাররা সফল। চট্টলায় তাইজুল-নাঈম আর ঢাকায় মিরাজ একাই ধ্বস নামিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ে।

এই চার স্পিনার খেলানো নিয়ে নানা কথা। তবে দর্শক, ভক্ত ও সমর্থকদের মত মিশ্র। একদমই প্রশংসা মেলেনি তা নয়। কেউ কেউ প্রশংসা করে বলেছেন, বাংলাদেশের মূল শক্তিই স্পিন বোলিং। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর সর্বোত্তম অস্ত্রই স্পিন। বাংলাদেশ তার ব্যবহার করে সিরিজ জিতেছে। ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশের পাশাপাশি ১৮ বছরে প্রথম ইনিংস জয়ের স্বাদ নিয়েছে। এতে দোষের কি আছে?

এটা বরং সামর্থ্যর সঠিক প্রয়োগ। আবার কেউ খুব তির্যক ভাষায় সমালোচনা করেছেন। করছেনও। এটাকে একদম নেতিবাচক ও মানসিকতা এবং নিরাপদ ও রক্ষণাত্মক কৌশল বলে অভিহিত করেছেন। তাদের শেষ কথা, এভাবে দেশের মাটিতে এক ঝাঁক স্পিনার নিয়ে টার্নিং উইকেটে খেলে সাময়িকভাবে টেস্ট জয়ের স্বাদ মিললেও এর দীর্ঘ মেয়াদের ফল খারাপ। দেশের বাইরে গিয়ে তো আর এমন কন্ডিশন মিলবে না। তখন অসুবিধা হবে। টাইগাররা একদম বিপাকে পড়ে হাবুডুবু খাবেন।

তাদের অনেক কথা, নানা প্রশ্ন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কেন এমন স্পিনবান্ধব পিচে খেলা হলো? ১১ জনে চার চারজন স্পিনার নিয়ে খেলে এবং জিতে লাভ কি? এটা কি দেশের ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করবে? যদি একজন পেসারও না খেলানো হবে, তাহলে বিরাট অংকের অর্থ দিয়ে কোর্টনি ওয়ালশ আর চাম্পাকা রামানায়েকের মত দু দুজন হাই প্রোফাইল পেস বোলিং কোচ পোষা কেন?

ঘরের মাঠে পেস বোলার ছাড়া খেলতে নামলে আর অত টাকা ব্যয় করে কোচ আনা ও রাখা কেন? তাহলে তাদের আউটপুট কি? সেটা কিভাবে বোঝা যাবে? ঘরের মাঠে যদি স্থানীয় পেসাররা নাই সুযোগ পাবে, চার স্পিনার দিয়ে দল সাজানো হবে, তাহলে বিদেশি বোলিং কোচ বিদায় করে দিলেই হয়!

কেউ কেউ বলছেন, ঘরের মাঠে চার স্পিনার নিয়ে খেলে খেলে অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। তাতে করে ব্যাটিং ও বোলিং দুই ডিপার্টমেন্টের চরম ক্ষতি হবে। উভয় বিভাগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঘরের মাঠে নির্জীব, ঠেলা গাড়ির গতি ও কম বাউন্সি ও স্পিন সহায় পিচে খেলে খেলে বাইরে গিয়ে ফার্স্ট-বাউন্সি ও ম্যুভিং উইকেটে খেলতে গেলে ব্যাটসম্যানদের অনেক সমস্যা হবে। হচ্ছেও।

তামিম, ইমরুল, লিটন, সৌম্য, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহরা ঘরের মাঠে নির্জীব পিচে স্বচ্ছন্দে খেললেও দেশের বাইরে দ্রুতগতির, বাড়তি বাউন্স ও সুইংয়ের মুখে অস্বস্তিতে ভোগেন। তাদের সমস্যা হয় প্রচুর। বিশেষ করে শর্ট বল এবং বডি লাইন ডেলিভারিগুলোয় (শরীর, মুখ, বুক ও মাথায় আসা) বেশ সমস্যা হয়। না পারেন, দেখে ছেড়ে দিতে। 'মারবো না ছাড়বো' করতে করতে এদিক ওদিক ক্যাচ দিয়ে ফেরত আসেন।

আর সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় নতুন বলে অফস্ট্যাম্পের ঠিক আশপাশে। দেশে পেসারদের বল ম্যুভ করে না একচুল। আর তাই অফস্ট্যাম্পের বাইরে খোঁচাখুচি করেও কোন রকমে পার পেয়ে যান সবাই। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে আর রক্ষা নেই। উইকেটের পিছনে ক্যাচ দেয়ার মিছিল লেগে যায়।

এই তো চার মাস আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গ্যাব্রিয়েল ও কেমার রোচকে খেলতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে। অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৪৩ রানে অলআউট হবার মত লজ্জাজনক পরিণতিও ঘটেছে। এছাড়া ঘরের মাঠে স্পিন সহায় পিচে বল ঘুরিয়ে দেশের বাইরে স্পোর্টিং আর ফার্স্ট পিচে গিয়ে স্পিনারদেরও খুব সমস্যা হবে। তারা অথৈ জলে হাবুডুবু খাবেন। কি করণীয়, তা বুঝে উঠতে গিয়ে হিমসিম খাবেন। দেশের মাটিতে টেস্টে একদম কম সুযোগ পাওয়া পেসারদেরও ‘ত্রাহিমধুসূদন’ অবস্থা হবে।

দেশের মাটিতে প্রাণহীন ও ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে বেশি খেলার কারণে পেস বোলিং ফ্রেন্ডলি উইকেটের অ্যাডভান্টেজ নেয়ার সামর্থ্য-ক্ষমতা জন্মাবে না। পেস বোলিং সহায় পিচ আর স্পোর্টিং উইকেটে কোন লাইন ও লেন্থে বল ফেলতে হয়, কোথায় বল ফেললে ব্যাটসম্য্যানকে বিপাকে ফেলা যাবে, সমীহ আদায় করা সম্ভব হবে-এসব অজানা থাকা ও রপ্ত না করার কারণে পেসাররা দেশের বাইরে পেস বোলিং সহায় উইকেটে গিয়েও তেমন কিছু করতে পারবেন না। ভুল লাইন ও লেন্থে বল ফেলে উল্টো অকার্যকর প্রমাণিত হবেন। মারও খাবেন প্রচুর।

তাই স্লো-লো ও স্পিন সহায় পিচে চার স্পিনার নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে চলবে না। সামনে এগোতে হলে বিশেষ করে দেশের বাইরে সফল হতে হলে অবশ্যই ধ্যান ধারণা পাল্টাতে হবে।

এভাবে স্পিন সহায় পিচে বেশি দিন খেললে ভারতের মত হবে। এক সময় ঘরের মাঠে স্পিন নির্ভর বোলিং ছিল ভারতের। এক গাদা স্পিনারের সাথে এক থেকে দুজন মাত্র পেসার, আবার কখনো কারসান ঘাউরি, তারও আগে আবিদ আলীদের দিয়ে সাজানো হতো নামকাওয়াস্তের ভারতীয় পেস আক্রমণ। আর সঙ্গে থাকতেন দু থেকে তিনজন কোয়ালিটি ও বিশ্ব মানের স্পিনার। তা দিয়ে দেশে পার পেয়ে গেলেও বিদেশে গিয়ে হালে পানি পেত না ভারতীয়রা।

৭০ ‘র একদম শেষ দিকে কপিল দেবের আগমণের পর থেকে ধীরে ধীরে ভারতের স্পিন নির্ভরতা কমতে থাকে। কপিল দেব অবসরে যাবার পর ভারতীয়রা হ্রদয়ঙ্গম করেন, দেশের বাইরে গিয়ে সাফল্য পেতে হলে চাই কোয়ালিটি ও ধারালো পেস বোলিং আক্রমণ। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটেও চিরায়ত স্লো-লো ট্র্যাক বদলে ঘাসের উইকেটে খেলা চালু করে ভারত।

৯০ দশকের শুরু থেকে বদলে যায় ভারতের ঘরোয়ার ক্রিকেটের চেহারা। স্পিন নির্ভরতা কমিয়ে পেস সহায় উইকেটে রঞ্জি-দুলীপ ট্রফি আয়োজন করে মনোজ প্রভাকর, জাভাগাল শ্রীনাথ, মনো ভেক্কটেশ প্রসাদ, জহির খান, ইরফান পাঠান, মোহাম্মদ সামি, ভুবনেশ্বর কুমার, ইশান্ত শর্মা, মুনাফ প্যাটেল, উমেশ যাদব আর জাসপ্রীত বুমরাহর মত এক ঝাঁক মেধাবী ফাস্টবোলার বেরিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশকে সেই পথ অনুসরণ করতে হবে। যে করেই হোক, ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেটের চেহারা ও চরিত্র পাল্টাতে হবে। ন্যাড়া , ঘাসহীন, শতভাগ ব্যাটিং উইকেটে বেশি খেললে লাভ হবে না। মাঝে মধ্যে এশিয়ার বাইরের দলগুলোকে স্পিন পিচে স্পিন দিয়ে ঘায়েল করলেও বাইরে গিয়ে আবার খাবি খেতে হবে।

এআরবি/এমএমআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।