আবার প্রমাণ হলো টাইগারদের টেস্ট ব্যাটিং বড্ড দুর্বল
চতুর্থ দিনের উইকেট, কোথাও কোথাও ভাঙবে, বোলারের বুটের স্পর্শে পপিং ক্রিজের আশপাশে ক্ষত সৃষ্টি হবেই। কাজেই স্পিনারদের বল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টার্ন করবে, সেটাই স্বাভাবিক।
তাই করেছে। অফস্পিনার সিকান্দার রাজা ভালো টার্ন পেয়েছেন। তার অফস্পিন ব্যাটসম্যানকে মাঝে মধ্যেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। আর লেগস্পিনার মাভুতার বলও খানিক ঘুরেছে।
অন্যদিকে জিম্বাবুয়ান ফাস্টবোলার কাইল জারভিস গতির সাথে মুভমেন্টের সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। তার বিপক্ষে বাংলাদেশের দুই ওপেনার ইমরুল কায়েস-লিটন দাস সকালে বেশ কবার পরাস্ত হয়েছেন। এর কোনটাই অসম্ভব কিংবা অস্বাভাবিক নয়।
একদম ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটের চেহারাও চতুর্থ দিন এমনই হয়। কাজেই উইকেট খুব বেশি জটিল ছিল, তা বলার অবকাশ নেই। টেস্টের চতুর্থ দিন পিচের যে অবস্থা থাকে, তাই ছিল। সেটা মোটেই মাথা ব্যথার কারণ ছিল না।
স্পিনারদের কিছু কিছু ডেলিভারি ব্যাটসম্যানের ধৈর্য্য ও সামর্থ্যর পরীক্ষা নিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ বল টার্ন করেনি। সাপের মত এদিক ওদিক ঘোরেনি। একই ভাবে উইকেট পেসারদের পক্ষেও যায়নি। চাতারা-জারভিস কারো বলেই বাড়তি স্পিড-বাউন্স ছিল না। যা মুখ, বুক ও মাথা সমান উচ্চতায় এসে ব্যাটসম্যানকে বিব্রত করেছে। বিষাক্ত সুইংও ছিল না।
জারভিসের কিছু ডেলিভারি সীম মুভমেন্টে ব্যাটসম্যানের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে উইকেটের পিছনে চলে গেছে। বেশির ভাগ ডেলিভারি খেলতে অসুবিধা হয়নি ব্যাটসম্যানদের। মোট কথা, উইকেট আনপ্লেয়েবেল ছিল না।
অথচ এমন উইকেটে প্রথম সেশনেই পাঁচ জন আউট। তার একটিও বোলারের কারিশমায় নয়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ভুলে।
এমন কন্ডিশনে ৩২১ রানের বড় টার্গেট সামনে। কোথায় ধৈর্য্য ধরে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে টেস্টের চিরায়ত ধারা মেনে ব্যাটিং করবেন; তা না লিটন, ইমরুল, মুুমিনুল, মাহমুদউল্লাহ, শান্ত ও মুশফিকরা বলগাহীন ব্যাটিং করলেন। যা পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে পুরোই বেমানান। অপ্রয়োজনীয়।
প্রথম আউট হলেন লিটন দাস। অফস্পিনার সিকান্দার রাজার বলকে পুল খেলতে গিয়ে। অফ ও মিডলস্ট্যাম্পে পরে ভিতরে আসা ডেলিভারিকে পুল করতে গিয়ে ব্যাটে বলে করতে না পেরে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালেন লিটন। আম্পায়ার প্রথমে আঙুল না তুললেও রিভিউতে দেখা গেলো বল লেগস্ট্যাম্প আঘাত করতো। তাই আউট হলেন লিটন।
এর পর ভুল পথের যাত্রী ইমরুল কায়েস। কাইল জারভিসের বলে অন্তত দুই বার কট বিহাইন্ড হতে হতে বেঁচে যাওয়া বাঁহাতি ইমরুলও সিকান্দার রাজার অফব্রেকেই আউট। লেগ মিডলে পড়া ফুললেন্থ ডেলিভারিকে সুইপ খেলতে গেলেন ইমরুল। বল তার গ্লাভসে লেগে ভেঙে দিল উইকেট।
ওয়ান ডাউনে এসে মুমিনুল শুরু করেছিলেন দারুণ এক বাউন্ডারিতে। দেখে মনে হচ্ছিল অফস্পিনার সিকান্দার রাজার লাইন ও লেন্থ নষ্ট করার মিশনে নেমেছেন। প্রথম স্কোরিং শটটিও ছিল উইকেট ছেড়ে এক পা বেড়িয়ে ফুলটচ করে মিড অন ও মিড উইকেটের পাশ দিয়ে বাউন্ডারি।
তারপর সিকান্দার রাজার বলে বার বার উইকেট থেকে বেড়িয়ে খেলেছেন। যেন দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, বাঁহাতি হলে কি হবে আমাকে অফস্পিনে ঘায়েল করা যাবে না। কিন্তু একটু বেশি ছটফট করা মুুমিনুল আউট হলেন কাইল জারভিসের বলে হাফকক খেলতে গিয়ে। গুডলেন্থ ডেলিভারির বিপক্ষে ডান পা সামনে না এনে খানিক জায়গায় দাঁড়িয়ে ডিফেন্স করার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হলো। বল ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে উইকেটে গিয়ে আঘাত হানে তার।
এরপর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও হাঁটলেন ভুল পথে। অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যানও হলেন অফস্পিনার সিকান্দার রাজার শিকার। সুইপ খেলতে গিয়ে উইকেট বিসর্জন দিলেন টাইগার অধিনায়ক। বল ব্যাট ও গ্লাভসে লেগে চলে গেল শর্ট লেগ ফিল্ডারের হাতে।
আর বাঁহাতি নাজমুল হোসেন শান্ত সাজঘরে ফিরেন লাঞ্চের ঠিক আগে। সেটাই ছিল মধ্যাহ্ন বিরতির আগে শেষ ওভার। কয়েকটি মাত্র ডেলিভারি। এখন শটস খেলার সময় নয়। উইকেটে টিকে থাকাই একমাত্র কাজ। কোথায় সে বোধ- উপলব্ধি!
অযথা স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে আউট হলেন। অভিষেক হওয়া লেগস্পিনার ব্রেন্ডন মাভুতার প্রথম টেস্ট উইকেট হলেন শান্ত। কিছুটা খাট লেন্থে পড়লেও বলটি ছিল গুগলি। ব্যাটসম্যান শান্ত লেগস্পিন ভেবে স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে সপাটে ব্যাট চালিয়ে দেন। বল পয়েন্টে না গিয়ে চলে যায় কভারে। নীচু সে ক্যাচ ধরে উল্লাসে মেতে ওঠেন ফিল্ডার সিকান্দার রাজা।
লাঞ্চের পর আউট হলেন মুশফিকুর রহিম। বার বার বহুবার সংকটে, বিপদে ও প্রয়োজনে যিনি হাল ধরেছেন শক্ত হাতে; সেই মুশফিকুরও আজ প্রয়োজনে হাল ধরার বদলে ব্যর্থতার ঘানি টানলেন।
আজকাল ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে প্রচুর স্লগ সুইপ খেলেন মুশফিক। এটা তার প্রিয় শটগুলোর অন্যতম। এ শটে রানও পান প্রচুর। কিন্তু তিনিও ভুলে গেলেন, এখন স্লগ সুইপ শট খেলার সময় না। একটু দেখে উইকেটে পড়ে থাকা এবং আলগা বলগুলোকে শায়েস্তা করাই একমাত্র কাজ। তার বাইরে কোন কিছু করতে যাবার অর্থ যেচে মরণ ডেকে আনা।
জিম্বাবুয়ান লেগস্পিনার ব্রেন্ডন মাভুতার বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে সেই আত্মঘাতী কাজটিই করলেন মুশফিক। মিড উইকেটে শরীর সামনে ফেলে তা ধরে ফেললেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। এরই সঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল টাইগারদের জয়ের স্বপ্ন।
আবার প্রমাণ হলো, প্রতিপক্ষর বোলিং শক্তি যেমনই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিংয়ের মান দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সীমিত ওভারের ফরম্যাটে এদিক ওদিক চালিয়ে সফল হলেও ব্যাকরণ মেনে পরিশুদ্ধ টেস্ট ব্যাটিংটা কমই পারেন টাইগাররা।
টেস্ট ব্যাটিংয়ের ছক, কৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ফরম্যাটে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির মত শটস খেলাই শেষ কথা নয়। চটকদার মার, দর্শক-ভক্তদের আনন্দ দেয়া, আক্রমণাত্মক ও চার ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে মাঠ গরমের চেয়ে প্রথাগত ব্যাটিং শৈলির প্রদর্শনী খুব জরুরী।
টেস্টে সব বল খেলার দরকার নেই। কিছু বল ছাড়তে হবে। ভাল বলকে সমীহ দেখানো জরুরী। আর কেবলমাত্র হাফ ভলি, ওভার পিচ এবং অফস্ট্যাম্পের বাইরে জায়গা পাওয়া ডেলেভারির বিপক্ষে শট খেলাই শেষ কথা। এই বোধ উপলব্ধি গেছে কমে। সেটাই বাড়াতে হবে। অন্যথায় ঘুরে ফিরে এমনই চলতে থাকবে।
তার প্রমাণ দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর এবার জিম্বাবুয়ের কমজোরি বোলিংয়ের বিপক্ষেও একই অবস্থা। ঘুরে ফিরে সেই করুণ পরিণতি। ১১০, ১২৩, ৪৩, ১৪৪, ১৪৯, ১৬৮ ও ১৪৩-এর পর ১৬৯।
এআরবি/এমএমআর/এমএস