তরুণরা আর কত বড়দের কাঁধে ভর করে চলবেন?
আগেও বলা হতো, বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘পঞ্চ পান্ডব’ মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ নির্ভর। এই পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারই ‘নিউক্লিয়াস।’ সব শক্তির উৎস। তারাই নির্ভরতার প্রতীক, প্রকৃত ম্যাচ জয়ী, কারিগর- ইত্যাদি.. ইত্যাদি...।
তবে গত কয়েকদিন, বিশেষ করে এই গায়ানার প্রোভিডেন্স স্টেডিয়ামে ২২ জুলাই তামিম, সাকিব, মুশফিক আর মাশরাফির ম্যাচ জেতানো ভূমিকা দেখার পর সিনিয়রদের নিয়ে একটু বেশিই কথা হচ্ছে। আগে যারা সেভাবে খেয়াল করেননি, তারাও বিষয়টি মাথায় এনেছেন, কাজ যা করার সিনিয়র, প্রতিষ্ঠিত, পরিণত ও অভিজ্ঞরাই করে দিচ্ছেন।
এখন সবার উপলব্ধি এক ও অভিন্ন। আর মুখে একটাই কথা- সত্যিই তো। বাংলাদেশের আসল প্লেয়ার আর সত্যিকার পারফরমারতো মোটে পাঁচ জন; মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ। বাকি ছয়জন শুধু জায়গা পুরণের জন্য এসেছেন; কিন্তু দলের সাফল্যে সে অর্থে তাদের কোনই অবদান নেই। থাকলেও আনুপাতিক হারে খুব কম। যা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েত নগণ্য।
‘পঞ্চ পান্ডব’ তথা পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের উজ্জ্বল আর কার্যকর পারফরমেন্স এবং দলের সাফল্যে বিরাট অবদানটা আরও বেশি করে নজরে আসে তরুণদের চরম ব্যর্থতায়। প্রথম ম্যাচের চালচিত্র ও সবার ব্যক্তিগত পারফরমেন্স একদম পরিস্কার। বাংলাদেশের ২৭৯ রানের ২৬১’ই এসেছিল চার সিনিয়র তামিম (১৩০*), সাকিব (৯৭), মুশফিকের (৩০) আর রিয়াদের (৪*) ব্যাট থেকে। বাকি ১৮ রানের ১৫ (লেগবাই ৭, ওয়াইড ৮) আবার অতিরিক্ত।
দুই তরুণ ওপেনার এনামুল হক বিজয় (০) আর মুশফিকুর রহীমের আগে চার নম্বরে প্রমোশন পাওয়া সাব্বির রহমান রুম্মন (৩) দু’জনে মিলে করেছিলেন মাত্র ৩। একই চিত্র বোলিংয়েও। অধিনায়ক মাশরাফি একাই পতন ঘটিয়েছেন ৪ উইকেটের (৩৭ রানে)। সেখানে রুবেল, মোস্তাফিজ, মিরাজরা মিলে পান ৪ উইকেট।
এতেই পরিষ্কার হয়, বাংলাদেশ দলে সিনিয়রদের পারফরমেন্স দারুণ উজ্জ্বল আর তাদের অবদান অনেক বেশি। ওই ম্যাচের পর থেকে সিনিয়র নির্ভরতা, পরিণত ও পাঁচ তারকার বেশি ভাল খেলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। অতিবড় বাংলাদেশ বিরোধীর মুখেও তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাশরাফি ও মাহমুদউল্লাহর অকুণ্ঠ প্রশংসা। অন্যদিকে তরুণদের ভাল খেলতে না পারা নিয়ে তীর্যক কথা-বার্তা। সমালোচনার ঝড়। দ্বিতীয় ওয়ানডের পর সে সমালোচনার ঝড়ের প্রকোপ বাড়বে আরও।
এই ম্যাচেও ঘুরেফিরে একই অবস্থা। এ ম্যাচে বাংলাদেশের টার্গেট ছিল ২৭২ রানের। ৩ রানে হার মানা মাশরাফির দল করেছে ২৬৮। আজও রান যা করার সেই পঞ্চ পান্ডবের চারজনই (তামিম ৮৫ বলে ৫৪, সাকিব ৭২ বলে ৫৬, মুশফিকুর রহীম ৬৭ বলে ৬৮ আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৫১ বলে ৩৯) মিলে করেছেন ২১৭।
বাকি ৫১ রান এসেছে অতিরিক্ত এবং ওপেনার এনামুল হক বিজয় (৯ বলে ২৩), মিডল অর্ডার সাব্বির রহমান রুম্মন (১১ বলে ১২), মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (৪ বলে ৩) ও মাশরাফির (এক বলে ১) ব্যাট থেকে। এর মধ্যে ‘মিস্টার এক্সট্রার’ অবদান ১২ (বাই ১, লেগবাই ৪, ওয়াইড ৭)। মাশরাফির ১ রান বাদ দিলে বিজয়, সাব্বির ও মোসাদ্দেক- এই তিন তরুণ মিলে করেছেন ৩৮। ওপরে চার সিনিয়র মিলে করলেন ২১৭। আর তার নিচে তিন তরুণের অবদান মোটে ৩৮। ভাবা যায়! এ যে পাঁচ ভাগের এক ভাগও পুরো নয়।
এটা কি হয়? একটা দলে চার সিনিয়র মিলে কি প্রতিদিন ব্যাট হাতে দলকে জেতাতে পারেন? আর পারলেও তারাই কি সব দিন দলকে সাফল্যের পথে এগিয়ে দিয়ে একদম লক্ষ্যেও পৌঁছে দেবেন? বাকিরা মানে, তরুণরা কি কিছুই করবেন না?
আগে ও পরে ভুল ত্রুটি হয়েছে বেশ। আগে বেশ কবার ‘ডেড ওভারে’ বেদম মার খেয়ে ম্যাচ হারানো রুবেল আজ আবার ৪৯ নম্বর ওভারে ২২ রান দিয়ে ক্যারিবীয় স্কোরবোর্ডকে একটু বেশি মোটা তাজা করে দিয়েছেন। সাকিবের মত চৌকস ক্রিকেটারের হাতে ক্যাচ মিস হয়ে ছক্কা হয়ে গেছে। এরপর ব্যাটিংয়েও ভুলের ছড়াছড়ি। প্রথম তিন ব্যাটসম্যানই অকাতরে উইকেট উপহার দিয়েছেন ক্যারিবীয় বোলার ও ফিল্ডারদের হাতে।
প্রথম ভুল পথের যাত্রী এনামুল হক বিজয়। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর আজ তেড়েফুঁড়ে অনেক কিছুই করতে চেয়েছেন। শুরুটা ছিল উল্কার বেগে। ক্যারিবীয় অধিনায়ক ও পেসার জেসন হোল্ডারের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে দুই ছক্কা, এক বাউন্ডারি ও এক ডাবলসে ১৮ রান তোলার পর কোথায় ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তা না ঠিক উইন্ডিজ ফাস্ট বোলার জোসেফকে উইকেট ছেড়ে বলগাহীন শট খেলতে গিয়ে বোল্ড।
তারপর তামিমও ভুল করলেন। আগের ম্যাচে ধৈর্য্যের প্রতীক। ম্যাচ জেতানো শতরান করে দল জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরা তামিম আজ অর্ধেক পথেই ধৈর্য্য হারালেন। পঞ্চাশ পূরনের পর লেগস্পিনার দেবেন্দ্র বিশুর প্রথম ওভারেই উইকেট ছেড়ে মারতে গিয়ে স্ট্যাম্পড। একই বোলারের বলে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে খানিকটা আলগা হাতে কাট খেলার খেসরাত দিলেন ওয়েল সেট সাকিবও।
এরপর মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দুই ভায়রা অনেকটা সময় দেবেন্দ্র বিশু ও অ্যাশলে নার্সের টার্নের বিপক্ষে কঠিন লড়াই করলেন সাহসী মাঝির মত। গভীর সমুদ্র আর উত্তাল নদীবক্ষে সাহসী নাকিব আর মাঝি যেমন অবিচল আস্থায় ঠান্ডা মাথায় পাহাড় সমান ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে তীরে ভেড়ান তরী- ঠিক একইভাবে লেগি দেবেন্দ্র বিশু আর অফ স্পিনার অ্যাশলে নার্সের বিষাক্ত স্পিন যখন সাপের মত এঁকে বেঁকে যাচ্ছিল, ঠিক তখন প্রাণপন লড়াই করে পরিস্থিতি প্রায় সামলে নিয়েছিলেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝিতে রিয়াদ রান আউট।
এর সাথে যোগ হয়েছে শেষ সাত বলে আট রান দরকার থাকা অবস্থায় দুই প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমান ও মুশফিকুর রহীমের পরপর দুই বলে ফুলটসে আউট হওয়া। মোটকথা, অনেকগুলো ঘটনার সমাহার এই ৩ রানের দুঃখজনক হার।
তারপরও কথা থেকে যায়। প্রশ্নও উঠেছে- সবই যদি বড়রা করবেন, তারাই গড়বেন, তারাই সাজাবেন তাহলে তরুণরা কি করেন? তারা কেন আছেন? এই ম্যাচেই দুই তরুণ সাব্বির আর মোসাদ্দেক কি করেছেন? তারা কি নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিকমত পালন করতে পেরেছেন? পারেননি। একটু খুঁটিয়ে দেখেন। অনেক ভুল হবার পরও শেষদিকে সাব্বির আর মোসাদ্দেক হাত খুলে খেলতে পারলেই হয়ে যেত।
সাব্বির ১১ (১২ রান) আর মোসাদ্দেক চার বল (তিন রান) করে খেলেছেন। তাদের দু’জনার সংগ্রহ মোটে ১৫। সাব্বিরের স্ট্রাইকরেট ১০৯.০৯ আর মোসাদ্দেকের ৭৫.০০। হাতে আরও উইকেট ছিল। এই দু’জনার যে কোনো একজন আরেকটি বাউন্ডারি হাঁকাতে পারলেই তো পরাজয় এড়ানো যেত।
জেসন হোল্ডারের শেষ ওভারের প্রথম বলে মুশফিক আউট হওয়ার পর মোসাদ্দেক স্ট্রাইক পেয়ে পরপর দুই বলে রান করতে পারেননি। ঐ দুই ডট বলেই ঘুরে গেছে ম্যাচ। বাংলাদেশের হাত থেকে ঝুঁকে গেছে ক্যারিবীয়দের দিকে। সাত বলে আট রান দরকার থাকা অবস্থায় একদম সহজ ফুলটস ডেলিভারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পেয়েও সাব্বির তার ফায়দা নিতে পারেননি।
চার-ছক্কা হাঁকানো বহুদুরে। উল্টো সীমানার ধারে ক্যাচ দিয়ে ফিরে এসেছেন। তারপর মোসাদ্দেক এসে শিক্ষানবিশের মত ব্যাট করলেন। তখনো পাঁচ বলে আট রান প্রয়োজন। অসম্ভব কিছু নয়। দুটি বাউন্ডারি বা একটি চার ও একটি ডাবলস হলেই হয়ে যায়। এমন সমীকরণ সামনে। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান হয়েও প্রথম দুই বল ডট। ভাবা যায়!
ওই সময় ননস্ট্রাইক এন্ডে ছিলেন মাশরাফি। মোসাদ্দেক দুই বল নষ্ট না করে প্রথম বলে সিঙ্গেলস নিলেও সম্ভাবনা থাকতো। তখন মাশরাফি তথা দলের প্রয়োজন দাড়াতো চার বলে সাত রানের। মাশরাফি ওই চার বলের শেষ বলের আগের তিন বলে একটি বাউন্ডারি হাঁকাতে পারলেই চালচিত্র যেত পাল্টে। হারের বদলে জিততেও পারতো বাংলাদেশ; কিন্তু মোসাদ্দেক দুটি ডট দেয়ার পরের দুই বলে তিন রান না করে একটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে মাশরাফিকে দুই বল আগে স্ট্রাইক দিলেও সম্ভাবনা থাকতো। এমন এক সময় অধিনায়ককে স্ট্রাইক দিয়েছেন যখন ছক্কা হাঁকানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
তার মানে বড়দের সাজানো গোছানো মঞ্চে ওঠার জন্য যে ন্যুনতম দৃঢ়তা ও প্রত্যয় দরকার- বর্তমান জাতীয় দলের তরুণদের তাও নেই। কিংবা থাকলেও তারা জায়গামত কিছুই করতে পারেন না। দল জিতিয়ে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার পাওয়া বহুদুরে, এতটুকু সহায়ক ভূমিকাও নিতে ব্যর্থ বিজয়, সাব্বির ও মোসাদ্দেকরা। তাহলে শুধু কি করে হবে?
সব দিন কি তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহরা জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবেন। কোনো কোনো দিন হয়ত অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে ছোটদের বলবেন- ‘নাও এবার অল্প যে পথটুকু আছে, তা তোমরাই হেঁটে চলে যাও।’ সেই অল্প কয়েক পা হেঁটে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে যারা পারেন না, তাদের কপালে ‘দুয়ো’ ধ্বনি ছাড়া আর কিই বা জোটার আছে?
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি