গর্ডনকে সংবর্ধনা : বিসিবির অন্যরকম দায়মুক্তি!

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৭:৩৮ পিএম, ১৫ মে ২০১৮

আগামী বছর জুনে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব করলে আর মাত্র ১৩ মাস। টেস্ট অবশ্যই ক্রিকেটের অভিজাত ক্ষেত্র। কুলিনদের ভুবন। তবে নির্জলা সত্য হলো, ওয়ানডে বিশ্বকাপই ক্রিকেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং জমজমাট আসর। বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড যাচাইয়ের সর্বোত্তম ক্ষেত্র।

তার আর এক বছর মাত্র বাকি। অথচ কোচশূন্য বাংলাদেশ দল। এটা সত্য আইপিএল, বিগ ব্যাশ আর নানা ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে অর্থের ঝনঝনানির কারণে নামী ও হাই প্রোফাইল কোচ পাওয়া দুষ্কর। এখন সবাই কম পরিশ্রম-অধিক আয়- ফর্মুলা খুঁজে পেয়ে টেস্ট খেলুড়ে দলকে কোচিং করানো বাদ দিয়ে আইপিএল, বিগ ব্যাশ, বিপিএল, সিপিএল আর পিএসএলে কোচিং করাতেই বেশি আগ্রহী। এ কারণে ভালোমানের বিদেশি কোচ জোগাড় করতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস উঠেছে বিসিবির।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, একজন হাই প্রোফাইল বিদেশি হেড কোচ যোগাড় করতে না পারা বিসিবি হঠাৎ ঘটা করে সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজের গলায় মালা পরালো কেন? সন্দেহ নেই, গর্ডন বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্তরণে একটা বড় সিঁড়ি। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটে যেখানে দাড়িয়ে, সেখানে গর্ডন গ্রিনিজের ভুমিকা, অবদান যথেষ্ঠ। তিনি দেশের ক্রিকেটের অন্যতম দ্রোনাচার্য্য। সফল নৈপথ্য রূপকারও বটে।

jagonews24

কারণ যাই হোক, তার আগমন আর বিদায় সমান উজ্জ্বল আর স্মরণীয় নয়। এসেছিলেন নায়কের বেশে। বিদায় হয়েছে নিন্দা গায়ে গেয়ে মেখে, নীরবে-নিভৃতে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি বিজয়ের অন্যতম স্বার্থক রূপকারের বিদায় ১৯৯৯‘র বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচের রাতে।

যাই হোক, সে দীর্ঘ ইতিহাস। কেন, তাকে সরানো হয়েছিল? কি কারণে গর্ডন গ্রিনিজ পদচ্যুত হয়েছিলেন- তা নিয়ে লিখতে গেলে হয়ত মহাকাব্য লিখতে হবে। তবে কঠিন সত্য হলো, গর্ডন গ্রিনিজের গায়ে এখন ‘সাবেক কোচের তকমা।’

কানে কিংবা চোখে লাগলেও নিদারুন সত্য- এ ক্যারিবিয় জীবন্ত কিংবদন্তি এখন শুধুই অতীত। তাই প্রশ্ন উঠেছে- যেখানে একজন নতুন বিদেশি কোচের দেখা নেই, সেখানে গর্ডন গ্রিনিজকে পাঁচ তারকা হোটেলে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হলো কেন? তার স্কুল ও লাইব্রেরির জন্য নগদ ৫ লাখ টাকা, স্যুট পিস, দেয়াল ঘড়ি, তার নিজের নামাঙ্কিত বাংলাদেশ দলের জার্সি ও ক্রেস্টসহ নানা পুরষ্কার প্রদানই বা কি কারণে?

তবে কি তাকে আবারো কোচ হিসেবে পেতে চায় বিসিবি? কোচের যেহেতু আকাল, তাই অগত্যা মধুসুদন হিসেবে গর্ডনকেই প্রধান কোচ করার চিন্তা ভাবনা চলছে। এমন গুঞ্জন এখন চারিদিকে। গত ২৪ ঘণ্টায় অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তা নিয়ে হৈ চৈ।

গর্ডন এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। বাংলাদেশ ও তার ক্রিকেট, ক্রিকেটার, কোচ, সংগঠক এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা মুখ ফুটে বললেও, ‘আমি আবারো বাংলাদেশের কোচ হতে চাই’- মার্কা কথা বের হয়নি তার মুখ থেকে। কাল রাতে হোটেল সোনারগাঁ প্যান প্যাসিফিকে সাত মিনিটের আবেগঘন বক্তৃতায় অনেক কথার ভীড়ে একবারের জন্যও বলেননি, আমি আবার বাংলাদেশের কোচ হতে চাই।

বলেছেন, ‘এ অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য এ মুহূর্তে ঠিক কাকে ধন্যবাদ দেব, বুঝতেছি না। সৈয়দ আশরাফুল হককে ধন্যবাদ না জানালেই নয়। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। গতবার লন্ডনে দেখা হয়েছিল। এ বছরও মালয়েশিয়ায় আবার দেখা হয়। বিশ্বের এ প্রান্তে যে তার সাথে আমার দেখা হবে তা কখনো ভাবিনি; কিন্তু হয়ে গেল। আমার মেয়ে দোহায় শিক্ষকতা করছে। তার সঙ্গে দেখা করতে মালয়েশিয়ায় এসে দেখা হয় আশরাফুল হকের সাথে। চিন্তা করলাম বাংলাদেশের এতো কাছে এসে বাংলাদেশে যাব না। তাই চলে এলাম।’

jagonews24

এরপর বলেন, ‘এখানে এসে এ ধরনের সম্মান পাবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বাংলাদেশে আমার অনেক বন্ধু আছে। তবে আমাদের যেভাবে যোগাযোগ করা উচিত, ঠিক সেভাবে যোগাযোগ হচ্ছে না। দু-একজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো, তাদের সঙ্গেও এখন কথা হয় না। লিপু (গাজী আশরাফ হোসেন) ও সাদ (তানজীব আহসান) আমরা আগে প্রায়ই যোগাযোগ করতাম; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে যোগাযোগ এখন বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এটা হতাশার। আশা করছি, তাদের সঙ্গে এখানে আমার দেখা হবে। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। যারা একসঙ্গে কাজ করেছি তাদের আবার পেলাম। খুব বেশি সময় কাজ না করলেও দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। একটা বন্ধন জন্মেছিল। সে বন্ধনের কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক বছর আগে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আশা করছি যতদিন বাংলাদেশে আছি এর মধ্যে আরেকবার তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। যদি দেখা না হয়, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমার শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা জানাবেন। আমার আসলে কী বলা উচিত তা বুঝতে পারছি না। আমি আজকের রাতের এ আয়োজনে খুবই উৎফুল্ল, আনন্দে আত্মহারা।’

এমন সব আবেগঘণ কথা-বার্তা শুনে মনে হতেই পারে ছিড়ে যাওয়া তার বুঝি আবার ঠিক করা হবে; কিন্তু শুধু গর্ডনই নয়। বিসিবিও তাকে আবার কোচ পেতে আগ্রহী- এমন কোন আভাস-ইঙ্গিত মেলেনি এখনো। তাহলে তাকে কেন এমন সংবর্ধনায় সিক্ত করা হলো তাকে?

কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটি তথ্য। তাহলো, কারণ যাই থাকুক না কেন, ১৯ বছর আগে বিশ্বকাপ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল গর্ডনকে। তার মত বিশ্বমানের ক্রিকেটার ও নন্দিত ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের জন্য যা ছিল বিরাট অসম্মান। যা বিসিবির জন্যও ছিল একটি গ্লানির বিষয়।

অনেকেই বলেছিলেন, কারণ যাই হোক, গর্ডনের বিদায়টা আরও অন্যরকম হওয়া উচিৎ ছিল। বিশ্বকাপ থেকে পত্রপাট বিদায় না করে দেশে এনে আরও সন্মানের সাথে তাকে বিদায় দেয়া যেত।

বোর্ড কর্তারা কেউ মুখ ফুটে স্বীকার না করলেও ভিতরের খবর, এবার সেই দায়মুক্তির তাগিদ থেকেই গর্ডন গ্রিনিজকে আবার দেশে এনে এমন ঘটা করে সংবর্ধনা জানানো হলো। যদিও অভিষেক টেস্টেও তাকে সন্মানা জানানো হয়েছে। তবে তখন উপলক্ষ্য ছিল। আর এবার কোন কারণ ছাড়া গ্রিনিজকে সংবর্ধনা দেয়া। ভাবটা এমন- ‘ভাই যা হবার হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ সময় আপনি এসেছিলেন। তবে আপনার বিদায়টা সুখকর হয়নি। একটা তিক্ততার মধ্যে আপনাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। যাতে করে দু-পক্ষের মাঝে একটা বৈরিতা আর দুরত্ব জন্মেছিল। তার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যেই আপনাকে সংবর্ধনা জানানো।’

jagonews24

আসল লক্ষ্য যে তাই, তার বড় প্রমাণ- সেই সময় মানে গর্ডন যখন বরখাস্ত হয়েছিলেন, সে সময়ের বোর্ড সাধারন সম্পাক সৈয়দ আশরাফুল হক আর ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম বিশ্বকাপ মিশনের ম্যানেজার খ্যাতিমান ক্রীড়া সংগঠক ও বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও তখনকার সিনিয়র সহ-সভাপতি তানভির মাজহার তান্নারও দেখা মিললো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।

গর্ডন যে টেবিলে বসে ডিনার সেরেছেন- সে একই টেবিলে বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সাথে সৈয়দ আশরাফুল হক আর তানভির মাজহার তান্নাও ছিলেন। তারা পাশাপাশি শুধু নৈশভোজই সারলেন না। ফিরে গেলেন অতীতে। গর্ডনের সাথে আশরাফুলের কথা-বার্তা আর শরীরি অভিব্যক্তি দেখে বোঝাই গেল, আগের তিক্ততা ও দুরত্ব কমেছে অনেকটাই। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান বোর্ডের কোনো বড় ধরনের অনুষ্ঠান-উপলক্ষ, বিপিএল কিংবা আর কোথাও আশরাফুল হক ও তানভির মাজহার তান্নার এমন সরব উপস্থিতি চোখে পড়েনি।

বিশ্ব দেখলো, জানলো, ‘কে বলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কোচদের সম্মানের সাথে বিদায় করতে জানে না? কারা বলে, বাংলাদেশের কোচদের বিদায়টা সুখকর হয় না! এইতো ফেলে দেয়া মালার মত গর্ডনকে আবার কাছে টেনে নিয়েছে বিসিবি। তিক্ততার কাঁটা সরিয়ে ভালবাসার মালায় আবদ্ধ গর্ডন ও বিসিবি।’এটাও কিন্তু একরকম ক্রিকেট ডিপ্লোমেসি। একটা বড় দায়মুক্তি।

এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।