‘জিতব যোগ্যতায়, প্রতারণা করে নয়’

স্পোর্টস ডেস্ক
স্পোর্টস ডেস্ক স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৪৬ পিএম, ২৭ মার্চ ২০১৮

একদিকে স্টিভ স্মিথ। ক্রিকেট মাঠে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত। অন্যদিকে ‘জেন্টলম্যান্‌স গেম’-এর পতাকাবাহী তিনি। বল হাতে নির্মম হয়েও কখনও ক্রিকেটের স্পিরিটের বাইরে যাননি। ভয়ঙ্কর হয়েও সুন্দর। পাকিস্তানে বিশ্বকাপের ম্যাচে নন-স্ট্রাইকার প্রান্ত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সেলিম জাফরকে আউট না করে ম্যাচ হেরে যান। সেই ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিনি কোর্টনি ওয়ালশ নিদাহাস ট্রফির পরে শ্রীলঙ্কাতেই ছুটি কাটাচ্ছেন। বল বিকৃতির নতুন বিতর্ক নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার তার।

প্রশ্ন: বল বিকৃতির ঘটনা জানার পরে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
কোর্টনি ওয়ালশ: আমি শোকাহত। যখন জানলাম এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছে, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। তার পরে ফুটেজটাও দেখলাম। বিস্ময়কর! দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, ক্রিকেটে এ রকম কিছু কখনও দেখতে হবে।

প্র: ক্রিকেটকে ‘জেন্টলম্যান্‌স গেম’ বলা হয়। আপনি বিধ্বংসী পেস বোলার হয়েও সবচেয়ে ভদ্র ক্রিকেটারদের একজন। মনে হচ্ছে কি ক্রিকেট স্পিরিটের জন্য খুব অন্ধকার দিন ছিল শনিবার?

ওয়ালশ: ক্রিকেট কেন, কোনো খেলাতেই এই ধরনের ঘটনার কোনো জায়গাই নেই। আমি সবসময় ‘স্পিরিট অব দ্য গেম’ বিশ্বাস করে এসেছি। অবশ্যই জিততে চাই। কিন্তু সঠিক মনোভাব, সঠিক পথে জিতব- এই ছিল আমার ক্রিকেটমন্ত্র। এই মন্ত্রেই আমাকে বড় করা হয়েছিল। কোনোদিন এর অন্যথা করার কথা ভাবিইনি। প্রতারণা করে জেতাটা আবার জেতা নাকি? তার চেয়ে মাথা উঁচু করে হার সহ্য করা অনেক সুখের। বল বিকৃতির ঘটনা কখনই মেনে নেয়া যায় না। আশা করব, এ জিনিস শেষবার দেখলাম। যেন আর কখনো না ঘটে।

প্র: রিভার্স সুইং করানোর জন্যই তো বল বিকৃতির আবির্ভাব। আপনি ক্রিকেটজীবনে কখনও সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন?

ওয়ালশ: রিভার্স সুইং করাতে বলের একটা দিক ভারী করে তুলতে হয়। সেটার জন্য থুতু বা আঠালো কিছু লাগানো প্রয়োজন। এই বিশেষ ধরনের সুইংয়ের জন্য বলটাকে তৈরি করতে হয়। কারও নাম করতে চাই না। তবে আমরা খেলার সময়েও শুনেছি যে, লোশন বা স্কিনক্রিম ব্যবহার করা হচ্ছে বলকে তৈরি করার জন্য। জানতাম, অনেকেই সানস্ক্রিন বা স্কিনক্রিম ব্যবহার করছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। মুখ থেকে ক্রিম বলেও লাগানো হচ্ছে, অনেকেই এমন কথা বলত। এখন তো দেখছি, বাইরে থেকে অন্য দ্রব্য নিয়েও মাঠে ঢুকছে ক্রিকেটারেরা বল বিকৃতি ঘটাবে বলে। সেটা দিয়ে বলের আকৃতি নষ্টও করে ফেলা হচ্ছে। কত রকম সব হাতিয়ারের কথাই তো শুনছি। এটা নিশ্চয়ই ক্রিকেট নয়।

প্র: বল বিকৃতি না ঘটিয়ে কি রিভার্স সুইং করানো সম্ভব?

ওয়ালশ: অবশ্যই সম্ভব। এটা একটা বিশেষ ধরনের স্কিল। আয়ত্তে আনতে পারলে দারুণ অস্ত্র। তার জন্য বল বিকৃতি ঘটাতেই হবে, কে বলল! সমস্যাটা হচ্ছে, বলটাকে তৈরি করতে গিয়ে অনেক সময় অন্যায় পথ ধরা হয়। শর্ট-কার্ট রাস্তা। ওদের বোধহয় পুরনো কথাটা মনে করিয়ে দেয়ার দরকার পড়েছে যে, সাফল্যের কোনো শর্ট-কার্ট হয় না। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। রিভার্স সুইংকে ক্রিকেটের দরকার, বল বিকৃতির অপরাধকে নয়।

প্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই যুগ ধরে টানা ক্রিকেটকে শাসন করেছে। বিশ্বসেরা সব ফাস্ট বোলার উপহার দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কখনও বল বিকৃতির অভিযোগ কেউ তোলেনি!

ওয়ালশ: আমরা জেতার জন্য খেলেছি, কিন্তু স্পিরিটকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। ছোটবেলা থেকে আমাকে শেখানো হয়েছে, প্রতারণা করাটা কোনো রাস্তা হতে পারে না। সততা নিয়ে জিততে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলাররা নির্মমতা দেখিয়েছে মাঠে ঠিকই। হয়তো অনেক ব্যাটসম্যান আহত হয়েছে আমাদের বোলিংয়ে। হাসপাতালগুলোকে আমরা ব্যস্ত রাখতাম। কিন্তু ক্রিকেটের আইন বা স্পিরিটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কখনও কিছু করিনি। হয়তো সেই কারণেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বের ভালোবাসাও পেয়েছি।

প্র: এসব দেখে বিশ্বকাপে সেলিম জাফরকে আউট না করার সেই দৃশ্য মনে পড়লে কি কোনো অনুশোচনা হয়? মনে হয় সততা দেখিয়ে কেন ম্যাচ হারলাম?

ওয়ালশ: একবারের জন্যও মনে হয় না, ভুল করেছিলাম। আজও ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, ঠিক কাজই করেছিলাম। আবারও যদি একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ি, সেলিম জাফরকে রান আউট করব না। আমার শিক্ষা বলে, কাউকে সতর্ক না করে এভাবে আউট করাটা স্পিরিট-বিরোধী। আমি তাই জাফরকে আউট করিনি। সেই দলের অন্যরাও সবসময় এই ঘটনা নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অধিনায়ক ছিল ভিভ রিচার্ডস। হেরে গেলেও ড্রেসিংরুমে ফিরে ভিভ বলেছিল, কোর্টনি, ঠিক কাজ করেছ।

প্র: প্রিয় ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ তছনছ হয়ে যেতে দেখাটা নিশ্চয়ই যন্ত্রণাদায়ক?

ওয়ালশ: উঠতি ক্রিকেটারদের দিকে কী বার্তা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। জুনিয়র বিশ্বকাপ (অনূর্ধ্ব-১৯) নিয়ে বেশ হইচই হয় এখন। সেখানেও কিন্তু স্পিরিট-বিরোধী ঘটনার কথা শুনছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই দু’টো ছেলে জুনিয়র বিশ্বকাপে ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানকে হাত ঘুরিয়ে রান আউট করে দিয়েছে। যেটা আমি পাকিস্তানে সেলিম জাফরকে করতে চাইনি। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়, তরুণদের মানসিক গঠনের দিকটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। দেখা দরকার, এ ধরনের ঘটনা যাতে তাদের উপর প্রভাব না ফেলে।

প্র: ক্রিকেটে অনেক দুর্নীতি বা প্রতারণাই আমরা দেখেছি। বল বিকৃতির ঘটনাও এটাই প্রথম নয়।
ওয়ালশ (থামিয়ে দিয়ে): কিন্তু তা বলে ব্যাপারটাকে হাল্কা ভাবে নেয়াও ঠিক নয়। খেলাটা দর্শকদের জন্য, তাদের কথা সবার আগে ভাবা দরকার। তারা নিশ্চয়ই প্রতারণা বা দুর্নীতি উপভোগ করবেন না। দর্শকরা মাঠে আসেন বা টিভির সামনে বসেন খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করতে। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্কিল-নির্ভর হবে বলে তারা আশা করেন। প্রতারণা বা দুর্নীতি-নির্ভর নয়।

প্র: স্মিথের আজীবন নির্বাসনের দাবি উঠেছে তার দেশেই। আপনিও কি চরম শাস্তির পক্ষে?

ওয়ালশ: আজীবন নির্বাসনটা বেশি কড়া হয়ে যাবে। সেটা চাইব না। তবে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক কিছু শাস্তি হওয়া দরকার। অধিনায়ক মানে তোমাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। এ রকম ঘটনায় তুমি কী করে অংশীদার হতে পারো?

প্র: এখন পর্যন্ত আইসিসি বিধি হচ্ছে, বল বিকৃতির ঘটনায় ধরা পড়লে একটি টেস্টে নির্বাসনের শাস্তি হয়, সঙ্গে ম্যাচ-ফির একশো শতাংশ জরিমানা হতে পারে। আপনার কি মনে হয়, আরও কড়া শাস্তি আনা উচিত আইসিসির?

ওয়ালশ: কোনো সন্দেহ নেই, আরও কড়া শাস্তি আনা উচিত।

প্র: নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে কী বলবেন?

ওয়ালশ: ছেলেদের কৃতিত্ব দিতে চাই যে, ফাইনাল খেলেছি। ফাইনালে ওঠাটা খুবই তৃপ্তিদায়ক ছিল। আবার ফাইনালটা জিততে না পেরে আমরা সকলে হতাশও হয়েছি। এমন একটা ফাইনাল হারলাম, যেটা আমাদের জেতা উচিত ছিল। তবু আমি খুশি যে, ছেলেরা তাদের একশো শতাংশের বেশি দিয়েছে।

প্র: শেষ বলে ছক্কায় হারের পর ছেলেদের কী বললেন?

ওয়ালশ: বলেছিলাম এটাই যে, তোমাদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছ। তারপরেও হয়নি কারণ প্রতিপক্ষের এক ক্রিকেটার অসম্ভবকে সম্ভব করে দিয়েছে। অনিয়মিত বোলার হলেও শেষ ওভারটা করেছিল সৌম্য সরকার। ওর লড়াকু মনোভাবের প্রশংসা করতেই হবে। ছেলেদের বলেছিলাম, এই হারে লজ্জার কোনো ব্যাপার নেই। ওরা সকলেই খুব হতাশ ছিল। কিন্তু হতাশার মধ্যেও লুকিয়ে আছে আশার আলো। সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। বাংলাদেশের হেড কোচ হিসেবে এটাই আমার প্রথম টুর্নামেন্ট ছিল (এর আগে ছিলেন বোলিং কোচ)। টুর্নামেন্ট না জিতলেও আমরা বিশ্বাসটা নিয়ে ফিরতে পেরেছি, যেকোনো দলকে আমরা হারাতে পারব। সেটা ছেলেদের আত্মবিশ্বাসকে অনেক বাড়িয়ে তুলবে।

আনন্দবাজার পত্রিকা অবলম্বনে।

বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।