তারা তিনজন এখন প্রতিপক্ষ
বাংলাদেশ ক্রিকেটে একসঙ্গে আগমণ ঘটেছিল তাদের দু’জনের। একজন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশের কোচ হওয়ার আগে এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের খুব কমই চিনতেন তাকে। অন্যদিকে একই সময়ে বোলিং কোচ হিসেবে যোগ দেয়া জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক এবং পেসার হিথ স্ট্রিককে সে তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশ ভালোভাবেই চিনতেন।
হাথুরু অধ্যায় যখন শুরু হয়েছিল তখন বাংলাদেশের খুবই খারাপ অবস্থা। ভারতের তৃতীয় সারির দলের কাছেও ঘরের মাঠে হারতে হচ্ছিল। এমনকি ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের মত দল বাংলাদেশকে বলে-কয়ে পরাজিত করে যাচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে তো রীতিমত নাকানি-চুবানি খেয়ে এসেছে। সেটা যদিও হাথুরুর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। কিন্তু এই কোচকে এদেশের মানুষ চেনা শুরু করলো নেতিবাচক ঘটনা দিয়ে।
শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণের জন্য ৬ মাস নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, দায়িত্ব নেয়ার পরই ক্রিকেটারদের ওপর খড়গহস্ত হাথুরুসিংহে। যদিও ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব থেকে মুশফিককে সরিয়ে মাশরাফিকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল তার।
এরপর তো শুধু সাফল্যগাঁথাই রচনা করেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করা দিয়ে শুরু। এরপর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে ধবল ধোলাই, ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় দিয়ে বাংলাদেশ শুধু এগিয়েই গিয়েছে। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়েকে আবারও পরাজিত করার পাশাপাশি এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে খেলেছিল ফাইনাল। এরপর ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
চোখের পলকে যেন কেটে গেলো দুটি বছর। হাথুরুর সাফল্যের সঙ্গী তখন হিথ স্ট্রিক। পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশ এক সময় ছিল খুবই দুর্বল। স্পিন নির্ভর আক্রমণই ছিল মূল ভরসা। কিন্তু হিথ স্ট্রিকের আমলে পেস বোলিংয়ের দারুণ উন্মেষ ঘটে বাংলাদেশে। মাশরাফির সঙ্গে তাসকিন, রুবেল এবং শেষে যোগ হন মোস্তাফিজ। বিশেষ করে মোস্তাফিজের আবিস্কার রাতারাতি হিরো বানিয়ে দেয় হিথ স্ট্রিককে। যদিও দ্য ফিজকে আবিস্কারের পেছনে অবদান সবচেয়ে বেশি মাশরাফি এবং হাথুরুর। কিন্তু তাকে গড়ে দেয়ার কাজ তো ছিল হিথ স্ট্রিকের হাতে।
এই দু’জনের সঙ্গে ছিলেন আরও একজন। তিনি ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা খালেদ মাহমুদ সুজন। দলের লজিস্টিক এবং অপারেশনাল কাজগুলো খুব সুন্দরকরেই না গুছিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিটি সাফল্যের সঙ্গী। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখার কাজটিও তাকে দেখা-শোনা করতে হতো। শুধু বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারির দায়িত্ব পালন করাই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচ হিসেবেও ধীরে ধীরে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন তিনি।
২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরিই ভাঙ্গে এই ত্রয়ীর অসাধারণ জুটি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর আর বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করবেন না বলে জানিয়ে দেন হিথ স্ট্রিক। নতুন করে বিসিবি তার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে চাইলেও হিথ স্ট্রিক ভারতীয় একাডেমি দলের বোলিং কোচের চাকরি নিয়ে চলে যান। পথের পরিক্রমায় এখন তিনি জিম্বাবুয়ের হেড কোচ।
হিথ স্ট্রিক চলে গেলেও চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ছিলেন আরও দুই বছর। চুক্তি ছিল তার সঙ্গে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত; কিন্তু হাথুরু নানা কারণে বাংলাদেশের কোচিংয়ের দায়িত্ব ছাড়লেন। গত নভেম্বরে আসে তার বাংলাদেশ ছাড়ার ঘোষণা। নানা নাটকের পর বিষয়টা স্বীকার করে নেয় বিসিবি। অথ্যাৎ, হাথুরুর সঙ্গেও মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। দায়িত্ব নেন শ্রীরঙ্কার।
মাশরাফি-সাকিবদের সঙ্গে একা থেকে গেলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে মূল কোচের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। তাকে যে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ঘোষণা করা হয়েছে! অথ্যাৎ একসময় একসঙ্গে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পালন করা তিনজন এখন তিন দলের কোচ। জিম্বাবুয়ের কোচ হিথ স্ট্রিক। শ্রীলঙ্কার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। আর বাংলাদেশের কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন।
ঢাকা ছাড়ার প্রায় দুই বছর পর আবারও বাংলাদেশে আসলেন হিথ স্ট্রিক, গত শুক্রবার। শনিবার মুখোমুখি হলেন মিডিয়ার। সেখানেই তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এটা কি আপনাদের কাছে পূণর্মিলনী সিরিজ। বিশেষ করে আপনার নিজের জন্য?
জবাবে হিথ স্ট্রিক বলেন, ‘বর্তমান সময়ে অনেক কোচ আছে যারা একসময় এক দলে ছিল, এখন প্রতিপক্ষ। তবে চন্ডিকা এবং খালেদ মাহমুদের (সুজন, ট্যাকনিক্যাল ডিরেক্টর- এর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। এ কারণে আমি মনে করি, এই সিরিজটা আমাদের সবার জন্যই খুব বড় চ্যালেঞ্জিং। আমরা সবাই কন্ডিশন এবং খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানি। চন্ডিকার ক্ষেত্রেও তাই। এমনকি শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার সম্প্রতি বিপিএলও খেলে গিয়েছে। একারণে এখন আর কারো কাছে কিছু লুকানোর নেই। এখন শুধু ভালো কিছু প্ল্যান এবং টেকনিক্যাল পরামর্শই থাকবে হয়তো দলের জন্য। এবং সবার লক্ষ্য থাকবে নিজেদের স্কিল ভালোভাবে বাস্তবায়ন করার।’
চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পদত্যাগ সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয় হিথ স্ট্রিককে। জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা বলতে পারি, দিন শেষে চন্ডিকা একজন শ্রীলঙ্কান। আপনার নিজের দেশের কোচিং করানোর সুযোগ যখন চলে আসবে, তখন এটা অনেক বড় কিছু। আমি নিশ্চিত, এখানে যদি কোনো বাংলাদেশি কোচ থাকতো, যে বিদেশে কোনো দেশের কোচিং করায় এবং একটা সময় এসে নিজের দেশে কোচিং করানোর সুযোগ আসে- তখন খুব কম লোকেরই সম্ভব হয় নিজ দেশের প্রস্তাব ফিরিযে দেয়া।’
তবে বাংলাদেশের হয়ে দারুণ সাফল্য রয়েছে হাথুরুর। এ কারণে এ দেশের জনগণ তার সাফল্য ভুলে যাবে না বলে মনে করেন হিথ স্ট্রিক। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের কোচ হিসেবে চন্ডিকা অনেক ভালো করেছে। এখানকার জনগন অবশ্যই তার সাফল্য ভুলে যাবে না। যদিও তিনি তিন বছরের নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। আমি মনে করি, এটা আপনার জন্য খুবই কঠিন যে, আপনি পরিবারের বাইরে রয়েছেন। তিনি থাকেন অস্ট্রেলিয়া। তার পরিবারও সেখানে। নিজের পরিবারের থেকে দুরে থেকে কোচিং করানো খুবই কঠিন। এ কারণে নিজ দেশে কোচিং করানো অবশ্যই সম্মানের একটা বিষয়। সবাই আকাঙ্খা করে, নিজ দেশের কোচ হতে।’
আইএইচএস/আরআইপি