দারিদ্র্যতা এবং প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি সোহেলকে

মুনওয়ার আলম নির্ঝর
মুনওয়ার আলম নির্ঝর মুনওয়ার আলম নির্ঝর , স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

১৯৮৮ সালে বরিশালে জন্ম হয়েছিল তার; কিন্তু জন্ম থেকেই পোলিওতে আক্রান্ত। দুই পায়েই রয়েছে সমস্যা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ঠিকমত চিকিৎসা করানোর সুযোগও হয়নি বাবা-মায়ের। পরিবারের একটাই আফসোস, বড় হয়ে কি করবে এই ছেলে? একই চিন্তা ছেলেটির মাথায়ও।

কিন্তু হুট করেই জীবন তার বদলে গেল। এর পেছনে রয়েছে তার নিজের পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিবন্ধী ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। নাম তার গোলাম কবির সোহেল। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তিনি।

জাগো নিউজের কাছে গোলাম কবির সোহেল তুলে ধরলেন দারিদ্র্যতা এবং তার প্রতিবন্ধীত্বকে জয় করে উঠে আসার গল্প। একই সঙ্গে মনে ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথাও।

জাগো নিউজের সাথে কথা বলার সময় অকপটে সোহেল বলতে থাকেন, দরিদ্র ঘরের সন্তান হওয়ার কারণে পোলিওর চিকিৎসা করানোর সুযোগই হয়নি। তিনি বলেন, ‘আসলে প্রতিবন্ধী হিসেবেই ছোটবেলায় জন্ম আমার। ছোট বেলায় পোলিও হয়েছিল। জন্ম থেকেই সমস্যা আমার। যখন ছোট ছিলাম, হাঁটা-চলা করতে পারতাম না। বাবা-মার অনেক চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে। আমি হাঁটা-চলা করতে পারি না। অনেক দরিদ্র ঘরের ছেলে ছিলাম। আমার চিকিৎসাও করাতে পারেনি বাবা-মা।’

golam

এমন প্রতিবন্ধী ছেলেকে কে ক্রিকেট খেলায় নেবে? এ কারণে ক্রিকেট খেলতে গেলে কেউই তাকে নিতে চাইত না। সে প্রসঙ্গ তুলে সোহেল বলেন, ‘এরপর একটা সময়ে শহরে আসি। তখন আমার ৮-৯ বছর বয়স। তো, খেলায় একটু বেশি আগ্রহ ছিল। পাড়ায় যখন খেলতে চাইতাম, কেউ নিতে চাইত না। সবাই বলতো, তুই হাঁটতে পারিস না। দৌড়াতে পারিস না। খেলবি কী! দুর্ঘটনা হতে পারে। এসব শুনে অনেক কষ্ট পেতাম। এত কষ্টের মধ্যে ক্রিকেট খেলা সম্ভব ছিল না। নিজে নিজে অনেক চেষ্টা করেছি।’

জীবনে এই অবস্থায় আসতে এক কোচের অবদান রয়েছে বলে জানান গোলাম কবির সোহেল। সেই কোচের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললেন না তিনি। বলেন, ‘যখন আমি ১৬-১৭ বয়সে খেলা শুরু করি তখন এক কোচ ছিল শাওন স্যার। উনি আমাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন। তুমি এভাবে কিভাবে খেলবা? স্যারকে বললাম, আপনি একটু সাহায্য করলেই পারব। স্যার বলেছিলেন, চেষ্টা করো আমি আছি। ওখান থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে।’

মূলতঃ দরিদ্র পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন করতেই ২০১৫ সালে প্রতিবন্ধী ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নেন সোহেল। সে কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপর নিজে নিজেই ক্রিকেট খেলা শুরু করি। ২০১৫ সালে আইসিসি একটা প্রতিবন্ধী ট্যালেন্ট হান্ট করল। ওখানে আসলাম। ২৫০ জনের একটা ট্রায়াল নিলো। তাতে টিকলাম। এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করলাম। যেহেতু দারিদ্র পরিবার।। দেখি কোন সুযোগ হয় কি না। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম সেই ট্রায়ালে যে, দেখি কি হয়!’

বরিশালে থাকার সময় জেলা ভিত্তিক দলগুলোর সাথে খেলতেন, তবে সুস্থ্য না থাকায় খেলার সুযোগ পেতেন না বলেও জানান এই ‘স্পেশাল’ অধিনায়ক। তিনি তার কষ্টের কথা এভাবে বলেন, ‘আমি বরিশাল অনুর্ধ্ব-১৭ দলে খেলেছিলাম। তখন ম্যাচ খেলতে পারতাম না। তবে টিমে থাকতাম। খুব কম ম্যাচ খেলাইতো। টিমে খুব কম নিতো। খেলার সুযোগ তেমন পেতাম না। আসলে ওদের (স্বাভাবিক ক্রিকেটার) সাথে প্রতিযোগিতা করে আমি পারতাম না। এটা স্বাভাবিক।’

আরও সুযোগ-সুবিধা পেলে ভাল কিছু করার স্বপ্ন দেখেন এই ‘বিশেষ’ ক্রিকেটার। তিনি বলেন, ‘তো আমাদের যে ট্রেনিং বা পরিশ্রম করার কথা তা সুযোগের অভাবে করতে পারিনি। অনেকে ছিল যে, আগে ক্রিকেট খেলেনি। তবে ওখানে যে কোচ ছিল, তারা আমাদের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে। আমাদের এই দুই বছরে সফলতা আরো বেশি হত, যদি আমরা সুযোগ পেতাম।’

প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েচে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। এ কারণে তারা সবাই বিসিবির তাকিয়ে রয়েছে বিসিবির দিকেই। গোলাম কবির সোহেল বলেন, ‘আসলে আগে তো নিয়মিত খেলতে পারতাম না। এখন তো সুযোগ পাই। এখন সবার সাথেই খেলতে পারি কম-বেশি। আশা রাখি, জানি না কত দূর যেতে পারব। হয়ত বিসিবি আমাদের নিয়ে সামনে কাজ করবে। সেই আশায় আছি।’

সবকিছুর পরও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করাটাকেই বড় পাওয়া হিসেবে দেখেন সোহেল। তার মতে, ‘আসলে হতাশ ছিলাম। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ ছিল না। তারপরও যে সফলতা পেয়েছি তাতে অনেক খুশি আমরা। আর আমার মত একটা ছেলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, সেটাও তো আমার কাছে অনেক বড় পাওয়ার।’

সোহেল প্রতিবন্ধীদের ‘প্রতিবন্ধী’ না ভেবে কিছু করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসলে প্রতিটা মানুষেরই বাংলাদেশ এর প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা থাকে। আমরা গর্বিত যে, আমাদের সামনে এ সুযোগটা তৈরি হয়েছে। আমরা দেশে এবং বিদেশের মাটিতে খেলছি। আমরা যারা প্রতিবন্ধী আছি তাদেরকে প্রতিবন্ধী না ভেবে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ যেন দেওয়া হয়।’

সোহেল যখন নিজের গল্প শোনাচ্ছিলেন, বারবার কেঁপে উঠছিল তার গলা। ভিজেও উঠছিল দু’চোখের কোণ। তবুও দেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলার সময় কেমন যেন তার অসুস্থ পা দুটির উপরই শক্ত হয়ে মেরুদন্ড সোজা করেই দাঁড়াতে চাচ্ছিলেন। যেন বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, আমিও দেশকে সবার মতই সমান ভালবাসি। সমানভাবেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই সারা পৃথিবীর বুকে!

এমএএন/আইএইচএস/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।