স্পেশালিস্ট পারফরমারের কাঁধেই নেতৃত্বের গুরু দায়িত্ব

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:১৬ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

সব সময় যে দলের সেরা ব্যাটসম্যান বা বোলার কিংবা ব্যাট ও বলে সেরা অলরাউন্ডার দলের অধিনায়ক হবেন- এমন কোন কথা নেই। অধিনায়ক মনোনয়নের এটা কোন মানদণ্ডও নয়। তাই যদি হতো, তাহলে সব দল তার সেরা পারফরমারকেই অধিনায়ক মনোনীত করতো; কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বে সে নজির নেই একটিও।

শুধু ভাল খেলোয়াড় আর সেরা ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার অধিনায়ক হবেন- এমন কোন নিয়ম নেই। নিয়ম থাকার প্রশ্নও আসে না। রীতিও নেই। বরং দল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভাল পারফরমারের চেয়ে নেতৃত্ব গুণ আর ক্রিকেট বুদ্ধিটাই প্রাধান্য পায়। যিনি ব্যাট ও বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার চেয়ে দল পরিচালনা এবং পরিবেশ- পরিস্থিতি ঠাউরে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বেশি রাখেন , তাকেই সাধারনতঃ অধিনায়ক করা হয়।

এটাই বিশ্ব জুড়ে অধিনায়ক মনোনয়নের পূর্বশর্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেরা ব্যাটসম্যান ও সেরা বোলারের চেয়ে যার নেতৃত্বগুণ বেশি, যিনি দল পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত এবং যিনি প্রতিপক্ষ শিবিরের শক্তি, সামর্থ্য আর পরিবেশ- পরিস্থিতি বিচার বিবেচনায় সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন- তিনিই অধিনায়ক হন।

তবে তাই বলে সেরা ব্যাটসম্যান কিংবা দলের সেরা পারফরমার কখনই অধিনায়ক হন না এমন নয়। হন। ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি সন্দেহাতীতভাবেই ভারতীয় স্কোয়াডের সেরা ব্যাটসম্যান। তার কাঁধেই ভারতের নেতৃত্ব। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম দুই সেরা ব্যাটসম্যান মাহেলা জয়াবর্ধনে আর কুমারা সাঙ্গাকারাও কয়েক বছর আগেও শ্রীলঙ্কার নেতৃত্বে ছিলেন।

বাংলাদেশে এই ধারার অনুসরণ কম। তবে এই প্রথম বাংলাদেশ তার সেরা পারফরমারের হাতে অধিনায়কের গুরু দায়িত্ব অর্পন করেছে। সেটা যে একদম পূর্ব নির্ধারিত তা নয়। সীমিত ওভারের ফরম্যাটের অধিনায়ক মাশরাফি গত এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচের আগে টস করতে গিয়ে হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করা হয়েছে সাকিব আল হাসানকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সাকিব টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। টেস্ট আর ওয়ানডে দুই ফরম্যাটে তামিম ইকবালের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী। টেস্টে সর্বাধিক উইকেট শিকারী। আর ওয়ানডেতে মাশরাফির পর দ্বিতীয় সর্বাধিক উইকেটও সাকিবের। টি-টোয়েন্টি হচ্ছে একমাত্র ফরম্যাট যাতে সাকিব ‘একাই একশো’। ব্যাট ও বল হাতে সাকিবই সেরা।

ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে সাকিব সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সফলতম ও সেরা পারফরমার। সবচেয়ে বেশি ১২০৮ রান তার। আর সর্বাধিক ৭০ উইকেটও তার ঝুলিতেই।

অন্য দুই ফরম্যাটে তাও তামিম, মুশফিক, মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির, মোস্তাফিজ, মিরাজ ও রুবেলের নাম চলে আসে; কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ বলতেই বোঝায় সাকিবকে। শুধু জাতীয় দলের হয়ে ভাল খেলার কারণেই নয়, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই সাকিব ‘চ্যাম্পিয়ন পারফরমার।’ এই ফরম্যাটে সাকিবের খ্যাতি ও নাম বিশ্বজোড়া।

বিশ্বের এমন কোন বড় টি-টোয়েন্টি আসর বা লিগ নেই, যাতে সাকিব অংশ নেননি। ভারতের বিশ্বখ্যাত আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ, ইংলিশ কাউন্টির টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি আসর, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিপিএল, শ্রীলঙ্কার এসএলপিএল আর পাকিস্তানের পিসিএল- ক্রিকেটের ছোট্ট পরিসরের যত ফ্র্যাঞ্চইজি আসর আছে, তার সবগুলোয় অংশ নেয়ার রেকর্ড আছে সাকিবের। ভারতের আইপিএলে তার একার নৈপুন্যে কলকাতা নাইট রাইডার্স চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

বিগ ব্যাশ আর বাংলাদেশের বিপিএলেও সাকিবের জয় জয়কার। বিপিএলে স্থানীয় ক্রিকেটারদের ছাড়িয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বিদেশী ক্রিকেটারের চেয়ে সাকিবের চাহিদা বেশি। দেশি-বিদেশি অনেক নামী ও দামী ক্রিকেটারকে পিছনে ফেলে বিপিএলের প্রথম দুই বারের আসর সেরা পারফরমার, এই সাকিব। এবারও তার ডিমান্ড প্রচুর। এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারকে পেতে ঢাকা ডায়নামাইটসকে গুণতে হয়েছে প্রায় কোটি টাকা।

সাকিবই সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র পারফরমার যার নামের আগে এখন ‘টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট‘ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়। অতিবড় বোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকও বিশ্বসেরা টি-টোয়েন্টি একাদশ গঠন করতে গিয়ে সাকিবকে বাদ দিতে হিমশিম খাবেন। কারণ তার ব্যাট ও বল সমান সচল। হাত খুলে খেলার সামর্থ অঅছে পুরোপুরি। রান নিয়ন্ত্রণে আনা আবার ভাইটাল ব্রেক-থ্রু দেবার ক্ষমতাও যথেষ্ঠ।

মাশরাফি সরে দাঁড়ানোয়ই হোন আর যেভাবেই হোন, এমন এক সেরা পারফরমার অবশেষে এক ফরম্যাটে বাংলাদেশের অধিনায়ক। দেশের ত্রিকেটে এক নতুনত্বের সংযোজন। টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট বাংলাদেশের নতুন টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।

এটুকু শুনে ভাবার কোনই কারণ নেই যে, সাকিব প্রথমবারের মত অধিনায়ক হয়েছেন। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, দেশ ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এর আগে টেস্ট, ওয়ানডে আ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে জাতীয় দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

২০০৯ থেকে ২০১০ সালে চার ম্যাচে তার নেতৃত্বেই খেলেছে বাংলাদেশ। সাত বছর পর আবার সেই পুরনো দায়িত্ব নতুন করে পাওয়া। এবারের সাথে আগেরবারের পার্থক্য আছে। তখন সাকিব অধিনায়ক হয়েছিলেন মাশরাফি আহত হওয়ার কারণে। আর এবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে নেতৃত্ব পেলেন মাশরাফি সরে দাঁড়ানোয়।

তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবার আর তার অধিনায়কত্ব সহজে হাতছাড়া হবে না। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই শুধু নয়, মাশরাফি অবসরে যাবার পর হয়ত ওয়ানডে ক্যাপ্টেনও হবেন সাকিব এবং অনিবার্য্যভাবেই বলে দেয়া যায়, সীমিত ওভারের ফরম্যাটে আগামী দিনের বাংলাদেশের কান্ডারিও সাকিব আল হাসান।

এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।