জাগরণের অভাব হলে হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যায় না
গত এক যুগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়েছেন ৪ শিক্ষক। সম্প্রতি রাজশাহীর শালবাগানে নিজ বাসার গলিতে দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে খুন হয়েছেন রাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম। কেন এই খুন? যদিও টুইট বার্তায় দাবি করা হয়েছে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যা করেছে। কিন্তু এর পেছনে দেশীয় অপরাজনৈতিক চিন্তা ও বৈশ্বিক প্রভাব কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা মরণ কামড় হিসেবে এই পথ বেছে নিয়েছে। এ জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র কম দায়ী নয়। আর সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণ না থাকায় হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যাচ্ছে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর একেএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার পর জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন তিনি। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নানা বিষয়। দুই পর্বের সাক্ষাতকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ : স্যার কেমন আছেন?
মলয় ভৌমিক : ভাল আর থাকি কি করে! চারিদিকে যা হচ্ছে। এরপর তো আর ভালো থাকা যায় না।
জাগো নিউজ : আপনার কি মনে হয়? কারা প্রগতিশীল, ব্লগার, মুক্তমনা, লেখক-প্রকাশক ও শিক্ষকদের খুনের সাথে জড়িত?
মলয় ভৌমিক : বাংলাদেশে দুটো প্যাটার্নে হত্যাকাণ্ড ঘটছে। একটা হচ্ছে পারিবারিক, ছিনতাই, অবৈধ সম্পর্ক ও ডাকাতির ঘটনায় খুন। আরেকটি হচ্ছে নির্দিষ্ট প্যাটার্নে খুন। নির্দিষ্ট প্যাটার্নে যারা খুন করছে তারা পলিটিক্যাল মটিভেটেড। যাদের বাইরের আবরণ ধর্ম ভেতরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সেটি অশুভ রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী রাজনীতি।
জাগো নিউজ : রাবি শিক্ষক রেজাউল করিমসহ এইসব হত্যাকাণ্ডকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মলয় ভৌমিক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ যারা খুন হচ্ছেন এর সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কাজেই স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জায়গা থেকে দেখার কিছু নেই।
জাগো নিউজ : কোনো ক্লু নাকি মিলছে না? আসামিদের ধরতে নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে? আপনার কি মনে হয়?
মলয় ভৌমিক : ক্লু আছে কি নেই তা ব্যাপার নয়। আর ক্লু তো আছেই, খুনিরা মোটরসাইকেলে এসেছে। চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে। মানুষও ভয়ে পালিয়েছে। এটাই তো ক্লু। জঙ্গি কারা তৈরি করতে পারে? তাদের লোকাল ইন্টারেস্ট কি?
জাগো নিউজ : এসব হত্যায় কি বৈশ্বিক স্বার্থ নেই? দেশীয়দের ও যোগসাজশকারীদেরই বা কি স্বার্থ?
মলয় ভৌমিক : আমরা জানি এটা বৈশ্বিক ব্যাপার। কিন্তু এটা বৈশ্বিক ব্যাপার হলেও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য যুক্ত থাকে। এখন স্বাধীনতাবিরোধীরা কোণঠাসা। অনেকের বিচার হচ্ছে। তাদের ইন্টারেস্ট হলো তাদের লোকদের বের করে নিয়ে আসা। আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও আছে যে এই মার্কেটটা দখল করতে হবে। সিরিয়ায় নানামুখি ইন্টারেস্ট আছে। এখানে তাদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য থাকছেই।
আইএস থেকে শুরু করে লাদেন অনুসারীরা বিগ পাওয়ার। আর এসবই সৃষ্টি আমেরিকার। তাদের নিজেদের স্বার্থে তৈরি। সেখানে রাশিয়া যখন ঢোকে তখন তাদেরও একটা উদ্দেশ্য আছে। তেল সম্পদের জায়গা। এই রকম ইন্টারেস্ট এখানেও আছে। সেই দৃষ্টি থেকে কিন্তু এখানে দেখা দরকার। এখানে সম্পূর্ণ ধর্মের কথা বলা হচ্ছে। মানুষও তাই ধরে নিচ্ছে নেগেটিভ কিছু।
জাগো নিউজ : কিন্তু কেউ খুন হলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া কেন হচ্ছে? নাস্তিকতা কিংবা ব্লগার হিসেবে উঠে আসছে যা নেতিবাচকভাবে নেয়া হচ্ছে? কেন?
মলয় ভৌমিক : সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে, ‘ও নাস্তিক ছিল, সে কারণে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’ বিষয়টি আসলে নাস্তিকতার ব্যাপার নয়। ইদানিং যেখানে হৈ চৈ বেশি হবে সেখানে হত্যার টার্গেট করা হচ্ছে। এই পথটা ইদানিং বেশি বেছে নিয়েছে তারা। সেখানে নাস্তিকতা কিংবা ধর্ম ব্যাপার নয়। দেখুন রেজাউল করিম হত্যাকাণ্ড বিদেশি মিডিয়াগুলোতে কতো কাভারেজ পেয়েছে। এটাই তাদের ইন্টারেস্ট। নাস্তিকতা-ব্লগারের বাইরে তাদের অন্য উদ্দেশ্য।
তারা চার্চে হামলা করছে। তাহলে কি হবে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়ে চাপ দেবে। তারা বিদেশি নাগরিক, অর্থাৎ জাপান, ইতালি ইত্যাদির নাগিরক। যাতে বিদেশিরা ক্ষুব্ধ হয়। ইদানিং তারা হিন্দু পুরোহিতদের উপরও আঘাত করছে। মনে করা হচ্ছে এদেশে ইন্ডিয়ার একটা বড় প্রভাব আছে। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি ক্ষুব্ধ হবে। মোদি বলবে, আমি তোমাকে এতো হেল্প করছি। আর তোমরা মৌলবাদী, হিন্দু পুরোহিতদের রক্ষা করতে পারছো না। তারা যাতে অখুশি হয়। তাহলে এখানে ধর্ম ফ্যাক্টর না। নাস্তিকতা, ব্লগার ফ্যাক্টর না। এগুলো থেকে বোঝা যায়।
জাগো নিউজ : হত্যাকাণ্ডগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
মলয় ভৌমিক : আমরা অনেকেই খুব সহজে বলি, অতীতে যদি এসব ঘটনার বিচার হতো তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। না, আসলে এটা ঠেকানো যেতো না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এসব ঘটছে। যে পলিটিক্যাল মটিভেশনের জায়গা থেকে এই হত্যাকাণ্ড গুলো ঘটছে তা কিভাবে নির্মূল সম্ভব?
তারা বিচার আচারের তোয়াক্কা করে না। তারা মিশন নিয়ে কাজ করছে। তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। শত শত আইএসকে উড়িয়ে দিয়েও কি আইএস নির্মূল হচ্ছে?
আমরা যদি বলি রাবি শিক্ষক ড. ইউনুস, শফিকুল হত্যার সত্যি বিচার হতো তাহলে ড. রেজাউল হত্যার ঘটনা ঘটতো না? না আমার তা মনে হয় না। আমরা চাই বিচার হোক। কিন্তু এটা তো বিশাল নেটওয়ার্কের ব্যাপার। একজন দুজনের বিচার করে এসব কিচ্ছু হবে না।
জাগো নিউজ : তাহলে মুক্তির উপায় কি? এভাবেই কি হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে? এর কি তবে শেষ নেই?
মলয় ভৌমিক : বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়া দেখছি তাকে আমি বলি পোস্ট অ্যাকটিভ। ঘটনা ঘটার পর। কিন্তু আমাদের প্রি অ্যাকটিভ ম্যাজার নিতে হবে। ঘটনা ঘটার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি ও খুবই কঠিন কাজ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান, সামাজিক জাগরণ দরকার। রেজাউল করিম যখন মারা যায় তখন আশেপাশের মানুষ মুখ খুলছে না। মানুষ এখন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থবাদী হয়ে গেছে। বাজারমুখি হয়ে গেছে। ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে জাগরণ দরকার। কিন্তু আমরা তা দেখছি না।
জাগো নিউজ : জাগরণ কি সম্ভব? সরকার ও উগ্রবাদী চক্র কি জাগরণ চায়?
মলয় ভৌমিক : খেয়াল করুন, বড় কোনো আন্দোলন কিংবা মুভমেন্টে এই চক্রটি চুপসে থাকে। কারণ মানুষ তখন রাস্তায় থাকে। সামাজিক, কালচারাল জাগরণ ছিল। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, শাহবাগের আন্দোলনের প্রথম ১৫ দিনে দেশে এ জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটে নাই। এই জায়গাটা কিভাবে আবারো তৈরি করা যায় তা আমাদের ভাবতে হবে।
কিন্তু এখন কোথাও সংগঠিত হয়ে কোনো ইস্যুতে গেলে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। নানাভাবে অন্য কোনো দিকে প্রবাহিত হয় কিনা না সে ভয়ে। কিন্তু সরকার এটা বুঝলো না, এই চেষ্টা অপচেষ্টাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সরকারকে এটা বুঝতে হবে। জাগরণে সহযোগী হতে হবে।
এই যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ঘটনাগুলো। কারো দাবির মধ্যে এটা নেই যে, হলগুলোতে, বিশেষ করে মেয়েদের হলগুলোতে কি হচ্ছে? ছেলেদের হলগুলোতে কারা চাঁদা দিয়ে বসবাস করে? কারা ছাত্রলীগের মিছিল করে? আমরা কি তার খোঁজ নিচ্ছি? এসব দেখার কেউ নেই। বন্ধ করার কোনো সিস্টেম নেই।
আমরা শিক্ষকরা কতোটা দাযিত্ব পালন করি। কয়টা ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশি? আমাদের কিছু শিক্ষককে পাগল বলা হয়। কারণ আমরা কিছু শিক্ষক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশি, সময় দেই। অথচ এটা শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব।
জেইউ/এসএইচএস/এবিএস