নাব্যতা হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদ
বছরের পর বছর পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ। এর ফলে হ্রদটি হারিয়ে ফেলছে নাব্যতা। গভীরতা কমায় বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে মাছ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চলতি মৌসুমে দ্রুত কমে যাচ্ছে হ্রদের পানি। হ্রদে মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মৎস্য গবেষক ও কর্মকর্তারা।
গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, কাপ্তাই হ্রদে ক্রমে দেশি প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে আরও বহু প্রজাতির মাছ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো. আবদুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু সংরক্ষণের অভাবে কাপ্তাই হ্রদের পরিবেশ এখন ধ্বংসের মুখে। বিষাক্ত দ্রব্য, বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপসহ নানা কারণে কাপ্তাই লেকের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দুষণের শিকার হচ্ছে।
অন্যদিকে, পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হ্রদের তলদেশ। হ্রদটি ব্যবহার করা হচ্ছে যত্রতত্রভাবে। ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্র ও আবাসস্থল। উদ্বেগজনক হারে হ্রদে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সেজন্য পার্বত্য অঞ্চলে কাপ্তাই লেকের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন বাড়াতে সরকার মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন চলছে। প্রকল্পে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন কাজ চলছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) রাঙামাটির ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মাইনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৫৬ বছরে একবারও ড্রেজিং না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন কাপ্তাই হ্রদকে বলা হতো মৎস্য উৎপাদন ভাণ্ডার। কিন্তু হ্রদের গভীরতা কমায় এবং পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তিনি জানান, ১৯৬৫-৬৬ সালে হ্রদে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউস, মহাশোলসহ বড় প্রজাতির মাছ ছিল ৮১ দশমিক ৩৫ ভাগ। আর চাপিলা, কাচকি, মলা মাছের মতো ছোট প্রজাতির মাছ ছিল তিন ভাগ। বর্তমানে হ্রদে রুই বা কার্প জাতীয় বড় মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করা না হলে হ্রদে মাছ উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে।
বিএফডিসি রাঙামাটির ব্যবস্থাপক বলেন, হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে হ্রদ জুড়ে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। পানি শুকিয়ে যায় তলানিতে। ফলে হ্রদে মৎস্য প্রজনন ও উৎপাদনে সঙ্কট দেখা দেয়।
মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো. আবদুর রহমান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে কাপ্তাই লেকের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন বাড়াতে সরকার মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন কাজ চলছে। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (২০০৫-০৭) এবং ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায় (২০০৮-১২) শেষে বর্তমানে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৃতীয় পর্যায় (২০১২-১৭) বাস্তবায়নাধীন। তিন পার্বত্য জেলার মোট ২৫ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
তিনি জানান, পার্বত্য জেলাগুলোতে মৎস্য চাষ কার্যক্রম ও উৎপাদন বাড়িয়ে স্থানীয় জনগণের আয় ও পুষ্টির জোগান দেয়াই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এর মূল কাজ হলো পাহাড়ি ছড়ায় ক্রীক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলাশয় সৃষ্টি ও উন্নয়ন করে সেখানে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, শাক-সবজি চাষ, কৃষি, সেচ সুবিধা ও গৃহস্থলি কাজে ব্যবহার, মাছের পোনা উৎপাদন ও লালন-পালনের জন্য মৎস্য হ্যাচারি ও নার্সারি স্থাপন এবং স্থানীয় মৎস্য চাষীদের চাষ, প্রযুক্তি ব্যবহার ও সম্প্রসারণের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রকল্পে এ পর্যন্ত ছয় হাজার চাষীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। হ্যাচারির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে দুই দশমিক ৫০ হেক্টর। মিনি মৎস্য হ্যাচারি নির্মিত হয়েছে একটি। মোট ৯০৩ হেক্টর জমিতে ক্রীক উন্নয়ন করা হয়েছে ৮০৪ এবং নার্সারী উন্নয়ন হয়েছে ২৫ একর জায়গায়। বর্তমানে কার্প জাতীয় মাছের রেনু উৎপাদন হয় বছরে ১২০ কেজি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজী বেলাল উদ্দিন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, কাপ্তাই হ্রদে মোট ৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। সেগুলোর মধ্যে দেশি প্রজাতির ৬৭ এবং বিদেশি প্রজাতির সংখ্যা ৮। এছাড়া ২ প্রজাতির চিংড়ি, ২ প্রজাতির কচ্ছপ ও ২ প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যেত। বর্তমানে ছোট প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া গেলেও গলদা চিংড়ি এবং কচ্ছপ ও ডলফিন প্রজাতির মাছ হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া আরও ৬ প্রজাতির মাছ কাপ্তাই হ্রদ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রজাতিগুলো হলো- সীলন, দেশি সরপুটি, ঘাউরা, বাঘাইর, মোহিনী বাটা ও দেশি পাঙ্গাস। এছাড়া বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশি মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলশা ও সাদা ঘনিয়া। ক্রমেই কমে যাচ্ছে রুই, কাতলা, মৃগেল, বাঁচা, পাটি পাবদা ও বড় চিতল প্রজাতির মাছ। বর্তমানে হ্রদে প্রাধান্য বিস্তার করছে কাচকি, চাপিলা, কাটা মইল্যা, তেলাপিয়া, কালিবাউস, আইড়, বাটা, ফলি ও মলা। দুর্ঘটনাক্রমে হ্রদে সংযোজিত মাছের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে গ্রাসকার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুটি, তেলে নাইলোটিকা, তেলে মোজান্বিকা, থাই মহাশোল, আফ্রিকান মাগুর ও থাই পাঙ্গাস।
তিনি বলেন, গনেষণা মতে কাপ্তাই হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হলো মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া, প্রজনন মৌসুমে পোনা ও ডিমওয়ালা মা মাছ নিধন, জাঁক দিয়ে মাছ চাষ, হ্রদের গভীরতা কমে যাওয়া, দূষণের শিকারসহ হ্রদ যত্রতত্র ব্যবহার। কাপ্তাই হ্রদকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কাপ্তাই হ্রদ মাছ শূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় ৬৮ হাজার হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট কাপ্তাই হ্রদ দেশের প্রধান মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্র। কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে হ্রদে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
এসএস/এমএস