রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশীয় সূত্রও খুঁজছে সিআইডি


প্রকাশিত: ০৩:১৭ এএম, ২০ এপ্রিল ২০১৬

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় চার দেশের মোট ২০ নাগরিককে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ফিলিপাইন, চীন, জাপান ও শ্রীলংকার এ প্রধান সন্দেহভাজন ২০ ব্যক্তির পরিচয় ও ছবিও সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর তদন্ত সংস্থা ও সরকারকে এসব তথ্য সরবরাহ করে তদন্তে সহায়তার অনুরোধও করেছে সিআইডি।

সিআইডির সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি তদন্তে ফিলিপাইনে সিআইডি’র সদস্যরা ৯ দিন অবস্থান করেন। তারা ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এনবিআই), অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করেন। তদন্তে অভিযুক্তদের ছবি সংবলিত নামের তালিকা ফিলিপাইন সরকারকেও সরবরাহ করেছে সিআইডি।

সূত্র আরো জানায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশীয় কিছু ব্যক্তি, সংস্থা ও এজেন্সি পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেননি। তাদের খামখেয়ালিপনা কিংবা যোগসাজশ থাকতে পারে। তাদের সংশ্লিষ্টতাও খোঁজা হচ্ছে। অর্থ চুরির ঘটনায় বিদেশি চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কারো যোগাযোগ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সিআইডি’র নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় ৪ দেশের ২০ নাগরিকের মধ্যে জাপানি রয়েছেন দু`জন। তারা হলেন সাসাকিম তাকাশি ও জয়দেবা।

Rizal Commercial Banking Corporation (RCBC) জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো (Maya Deguito) ও চেয়ারপারসন হেলেন ওয়াই ডির নামও উঠে এসেছে সিআইডি’র তদন্তে। মায়া জুপিটার শাখায় যোগ দেওয়ার পরই অর্থ হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনায় যুক্ত হন।

এছাড়া চার অ্যাকাউন্টধারীকেও এতে সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন, মাইকেল ফ্রান্সিসকো ত্রুক্রজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগোরাস, আলফ্রেড ভারগারা ও এনরিকো তায়েদ্রো ভাসকুয়েজ।

উঠে এসেছে চীনের নাগরিক ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইসার কোম্পানির মালিক কিম ওং এর নামও। তিনি দীর্ঘ এক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ে তৎপর ছিলেন।

সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট স্লুইড বাতিস্তা, ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো সো।

সিআইডির অপর একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। তাদের তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে শ্রীলংকার এনজিও শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালকসহ আটজনকে শনাক্ত করেছেন। তারা হলেন- গামাজ শালিকা পেরেরা, সানজেবা টিসা বান্দরা, শিরানি ধাম্মিকা ফার্নান্দো, ডন প্রসাদ রোহিতা, নিশান্থা নালাকা ও ওয়ালাকুরুয়ারাচ্চি।

সিআইডি সূত্র জানায়, তদন্তে এই প্রথম সন্দেহভাজন হিসেবে সাসাকিম তাকাশি ও জয়দেবা নামে ওই দুই জাপানি নাগরিকের নাম উঠে আসে। চুরি হওয়া অর্থ শ্রীলংকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে এ দুই জাপানি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। শালিকা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তাদেরও যোগাযোগ ছিল।

ফিলিপাইনের ‘ডেইলি ইনকোয়ারার’ পত্রিকার (inquirer.net) মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির খবর প্রথমে চাউর হয়। এরপর বিশ্ব গণমাধ্যমসহ দেশীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাড়াও ওই দেশের একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ২ মাস পর গত সপ্তাহে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে ফিলিপাইন পুলিশ।

বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল, বিশ্বব্যাংক ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চাপে এ মামলা করতে বাধ্য হয় ফিলিপাইন।

এব্যাপারে সিআইডি’র জোর অভিযোগ, মামলা হওয়ার আগেই সাইবার অপরাধীদের আলামত মুছে ফেলা হয়েছে। ফিলিপাইনের অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলেও সিনেট কমিটির শুনানির কথা বলে সিআইডিকে সহযোগিতা করা হয়নি।

সিআইডির দায়িত্বশীল বলছে, সিনেট কমিটির শুনানির কথা বলে ফিলিপাইন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তৎপরতা দেখাতে চেয়েছে। আসলে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনতে এ কমিটি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। মাত্র সুপারিশ করতে পারে।

সিআইডি’র সূত্রগুলো জানায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশীয় কিছু ব্যক্তি, সংস্থা ও এজেন্সি পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেননি। তাদের খামখেয়ালিপনা কিংবা যোগসাজশ থাকতে পারে। তাদের সংশ্লিষ্টতাও খোঁজা হচ্ছে। অর্থ চুরির ঘটনায় বিদেশি চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কারো যোগাযোগ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এব্যাপারে সিআইডি’র অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, অর্থ চুরির মামলার তদন্তে সিআইডিকে সহায়তা করতে চায় বিশ্বব্যাংক। ঢাকায় সিআইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের বৈঠকও হয়েছে।

তিনি বলেন, সিআইডি দেশে-বিদেশে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযুক্ত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে।

শাহ আলম জানান, ২০১৫ সালের ১৫ মে মাত্র ৫০০ ডলারে আরসিবিসির ৪টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। দীর্ঘদিন তাদের সে একাউন্টে লেনদেন হয়নি। ওই চার একাউন্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮১ মিলিয়ন অর্থ আসে।

অথচ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত বড় অঙ্কের অর্থ প্রবেশ করলেও আরসিবিসি কোনো ধরনের সন্দেহ কিংবা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের চরম গাফিলতি ছিল। এক মিলিয়ন অর্থ সন্ত্রাসী নাকি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর তা খতিয়ে দেখা ছিল দায়িত্ব। কিন্তু ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী তা অনুসরণ করা হয়নি।

সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, শনাক্তকৃত ২০ বিদেশি নাগরিককে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই বিচার করা সম্ভব। বাংলাদেশের আদালত মানি লন্ডারিং আইনে আরসিবিসিকে চুরি যাওয়া অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা করা সম্ভব। ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং আইন দুর্বল হলে একই বিধান রয়েছে।

তিনি বলেন, দুই উপায়ে টাকা ফেরত আনা সম্ভব। যাদের হাতে টাকা পৌঁছেছে তাদের আইনের আওতায় এনে অর্থ ফেরত আনা।
আরেকটি উপায় হতে পারে, যে প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে অর্থ পাচার হয়েছে, তাদের কাছ থেকে জরিমানাসহ দ্বিগুণ অর্থ আদায় করা। মামলা করে আরসিবিসির কাছ থেকে পুরো অর্থ আদায় করা সম্ভব।

জেইউ/একে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।