তামাক চাষ : বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত বিষ


প্রকাশিত: ০৩:০৮ এএম, ২০ এপ্রিল ২০১৬

স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে চলছে তামাক চাষ। বিড়ি কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহায়তা পেয়ে  অধিক লাভের আশায় জেলার চরাঞ্চলের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়েছে তামাক চাষের প্রতি। এতে করে তামাক পাতার বিষ ক্রিয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

অন্যসব ফসলের চেয়ে লাভজনক হওয়ায় গেল কয়েক বছর যাবত জামালপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তামাক চাষের বিস্তৃতি ঘটছে ক্রমাগত। আর এই তামাক চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলছে বিড়ি কোম্পানিগুলো। গত কয়েক বছর যাবত বিড়ি কোম্পানিগুলো তামাক চাষের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি চড়া মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি তামাক কিনে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো।

তাছাড়া কৃষকদের দাবি, চরের এসব জমিতে অন্য ফসল তেমন একটা হয় না। তাই অভাবের সময়টায় বাড়তি দু`পয়সা ঘরে তোলার আশায় তারা তামাক চাষ করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ধান, পাট করলে যেখানে প্রতি বছর লোকসান গুণতে হয় সেই প্রতি বিঘা জমিতে তামাক চাষে ৮/১০ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রায় ১০/১৫ হাজার টাকা লাভ হয় তাদের।

জানা গেছে, এ বছর জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর, তুলশীর চর ইউনিয়ন ও মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি গ্রামে প্রায় ৫ হাজার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গত বছর চাষ হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ।

Jamalpur

কিন্তু জামালপুর কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছর জেলায় ৪৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। আর এ বছর কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় ৬১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।

লক্ষ্মীরচর গ্রামের তামাক চাষী রফিকুল ইসলাম জানায়, জমিতে অন্য ফসল তেমন একটা হয় না, যে কারণে প্রতি বছর লোকসান দিতে হয়। কিন্তু এই জমিতে তামাকের চাষ খুব ভালো হয় আর জর্দ্দা-বিড়ির কোম্পনিরাই টাকা দেয় আবার শুকনা পাতা তারাই কিনে নিয়ে যায়। তাই লোকসান হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও থাকে না।

রফিকুলের কথায় সমর্থন দিয়ে জুলহাস উদ্দিন আর রফিক মিয়া বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে তামাক চাষে প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয় আর বিক্রি শেষে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাভ হয়। অথচ এই জমিতে ধান, পাট চাষ করলে লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা লোকসান দিতে হয় প্রতি বছর। তাছাড়া অন্য ফসল করলে সেগুলো বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে হয় অথচ বিভিন্ন বিড়ি কোম্পানি বাড়ি থেকেই তামাক পাতা কিনে নিয়ে যায়।

Jamalpur

অপরদিকে, আর্থিক অস্বচ্ছলতা আর তামাক চাষে ব্যয় কমাতে কৃষকের পাশাপাশি তামাক ক্ষেতে কাজ করছে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। এতে করে তামাক পাতার বিষ ক্রিয়ায় কৃষক পরিবারের সদস্যরা ক্ষুধা মন্দা, শ্বাসকষ্ট, চর্ম রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়াও তামাক চাষীদের পাতা মজুদ রাখার জন্য আলাদা কোনো গোডাউন বা ঘর না থাকায় বেশির ভাগ চাষীই তাদের বসত ঘরে তামাক পাতা মজুদ করে রাখছে। এতে পুরো পরিবারের সদস্যরাই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নিজ ঘরে বসবাস করছে। যে কারণে প্রতি বছর তামাক চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যরা।

তামাক ক্ষেত্রে স্বামীর পাশাপাশি কাজ করতে আসা হাজেরা খাতুন জানান, কামলা (ক্ষেত মজুর) রাখার সামর্থ্য নেই, যে কারণে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে আমিও তামাক ক্ষেতে কাজ করি। এতে কইর্যা কাজও আগায় আবার টাকা খরচ হয় কম। কিন্তু তামাক ক্ষেতে কাজ কইর্যা শরীর জ্বালা-পোড়া করে, খিদার জোর কইমা যায়। তারপরও কাজ করি নইলে পেট চলবো কেমনে।

Jamalpur

মালেকা বেগম আর সাগর আলীও হাজেরার মতো দরিদ্রতার কথা তুলে ধরে জানালেন, তামাক ক্ষেতে কাজ কইর্যা আমাদের মাঝে মধ্যেই অসুখ-বিসুখে পড়তে হয়। কিন্তু তারপরও কাজ করি দুইডা পয়সার আশায়। তামাক পাতার তুরে (ঝাজ) মাথা ঘুরায়, বমি আসে, পেটে গ্যাসও হয়। খালি ক্ষেতেই না, জায়গা না থাকনে থাহার ঘরেই পাতা রাহি সেইখানেও একই অবস্থা হয়।

এ ব্যাপারে জামালপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আবু হানিফ বিড়ি কোম্পানিগুলোর সহায়তায় তামাক চাষ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে জানান, তামাক চাষের বদলে অন্য ফসল করতে মাঠ কর্মীরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তবে তামাক পাতার নির্যাস থেকে বিভিন্ন কিটনাশক তৈরি করা হচ্ছে বলে তামাক চাষ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না।

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।