‘বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকতাম, এখন থাকি বিল্ডিংয়ে’
‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই পঙ্ক্তি যেন সাগর বা নদীপাড়ের মানুষের জন্যও বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগর বা নদীপাড়ের মানুষগুলোকেও আর ঠাঁই দিতে চান না পাড়ে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের মাধ্যমে উদ্বাস্তু হতে চলেছে হাজারো মানুষ।
পঞ্চাশোর্ধ্ব জোছনা বেগম চার ছেলেমেয়ে নিয়ে কুতুবদিয়ায় থাকতেন বাঁশের বেড়ার ছোট্ট একটা কুটিরে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে যেখানে উঠতো পানি। বর্ষার দিনে ছিল না খাবার পানি পাওয়ার সহজ কোনো ব্যবস্থা। রান্না করার মতোও কোনো ব্যবস্থা থাকতো না। পরিবারের আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিজ ঘরেই যখন একটু শান্তির ঘুম দিতে পারতেন না, তখন মাথাগোঁজার ঠাঁই খোঁজাও হয়ে ওঠে তাদের জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার আরেক লড়াই। তবে সেই লড়াইয়ে ভেসে না গিয়ে অবশেষে ঠাঁই হলো জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য গড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
শুধু জোছনা বেগম নয়, এমন ৬০০টি পরিবার এখন পর্যন্ত এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাদের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। আগে যেখানে বাঁশের বেড়া, টিনের ঘরে থাকতো, বৃষ্টির দিনে ঘরে পানি উঠতো, জলোচ্ছ্বাস এলেই ভয়ে বুক কাঁপতো। আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও সংসারের সবই ভেসে যেতো। হালকা ঝড় হলেও ঘরের ক্ষতি হতো। রান্না করার মতোও কোনো পরিবেশ থাকতো না সেই অবস্থা এখন আর নেই। তারা এখন থাকেন পাকা ভবনে। ফ্যানের বাতাস আর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত থাকে তাদের ঘর। রান্নার জন্য এখন আর চিন্তা করতে হয় না। বৃষ্টি বা বর্ষার দিনে রান্না করা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা নেই। ঘরের মধ্যেই আছে রান্নার ব্যবস্থা। নেই পানির কোনো সমস্যাও।
আরও পড়ুন: সাগরপাড়ের মাতারবাড়িতে দিন বদলের হাওয়া
সরেজমিনে দেখা গেছে, পশ্চিম ও দক্ষিণে বাঁকখালী নদী, উত্তরে মহেশখালী চ্যানেল আর পূর্বে পিএমখালী ইউনিয়ন। এর মাঝে খুরুশকুল ইউনিয়ন। নদীবেষ্টিত এই ইউনিয়নেই গড়ে তোলা হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। প্রকল্পের রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। এক সারিতে গড়ে তোলা হয়েছে ভবনগুলো। ভবনের কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও ভেতরে অবকাঠামো ও প্রকল্পের ভেতরের রাস্তার কাজ কিছুটা বাকি রয়েছে। সেসব কাজ চলছে পুরোদমে। ভবনগুলোর সামনে গোলাকার সবুজ বনায়ন করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে বিভিন্ন গাছের চারা।
উত্তরপাশে রয়েছে বিশাল পাকা সড়ক। সে সড়ক ধরে কক্সবাজার শহরে, বাঁকখালীসহ অন্যান্য স্থানে সহজে যাতায়াত করছেন উপকারভোগীরা। প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে বাঁকখালী নদীর ওপর কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুলের ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের দক্ষিণাংশে কাজ শেষ হওয়া ১৯টি ভবনে বসবাস করছেন উপকারভোগীরা। সেখানে রয়েছে স্কুল, খেলার মাঠ। পশ্চিমপাশে নির্মাণ করা হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট নান্দনিক মসজিদ। বহুদূর থেকে দৃষ্টি কাড়ছে মসজিদের সুউচ্চ মিনার। এই অংশের ভবনগুলোর ইতোমধ্যেই রাখা হয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম।
সারি সারি পাঁচতলা ভবন। ভবনগুলোর নিচতলায় কোনো বাসা না থাকলেও রয়েছে গেস্ট হাউজ। সেখানে উপকারভোগীদের অতিথি এলে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। রয়েছে ফাঁকা জায়গা। সেখানে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান করা হয়। প্রতিটি ভবনের মানুষ যেন তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন তার জন্য ভবনের নিচে রয়েছে একটি দোকান করার জায়গা। কোথাও চায়ের দোকান, কোথাও মুদির দোকান, কোথাও কাঁচাবাজারের দোকান, কোথাও পার্লার, কোথাও গহনার দোকান, কোথাও আবার সেলুন, ফার্মেসি, ইলেকট্রনিক্সের দোকান। এমন সবকিছুই রয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভবনগুলোতে।
কয়েকটি ভবন নিয়ে মাঝে বিশাল জায়গাজুড়ে রাখা হয়েছে মাঠ। যেখানে বিকেল হলেই বাচ্চারা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। ১০টি ভবনের নিচতলায় এসকাস প্রকল্পের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল। সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয় প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী দূরে স্কুল হওয়ার কারণে যেতে চায় না এবং অভাব-অনটনের কারণে যারা পড়তে পাড়ে না তাদের শিক্ষাদান করা হয়।
আরও পড়ুন: খুলছে রেলের দখিনা দুয়ার, সমুদ্রের গর্জন শুনবে ট্রেনযাত্রীরাও
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঝিনুক ভবনের ৪০৩ নম্বর বাসায় ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মমতাজ বেগম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকতাম, এখন থাকি বিল্ডিংয়ে। অনেক ভালো আছি। বিদ্যুৎ, পানি, রান্নাঘর সবই আছে। ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করানোর জন্য স্কুল, কলেজও আছে।
এসময় তার পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে তাহমিনা সিদ্দিকা পুষ্পা জাগো নিউজকে বলে, আগে স্কুলে যেতাম কাদামাটির রাস্তা পাড় হয়ে এখন এখানে মনুপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাই। পাকা রাস্তা। বিকেলে খেলার জন্যও মাঠ আছে। বিল্ডিংয়ে অনেক বন্ধু আছে। সবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে খেলা করি। আগে যেখানে থাকতাম সেখানে খেলার এমন বড় মাঠ ছিল না।
ভবনগুলোতে থাকা মানুষগুলোর একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। শিশুরাও নিজের মতো করে খেলাধুলা করছে। কেউ আবার বিভিন্ন জায়গায় করেন চাকরিও। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম আশিক জাগো নিউজকে বলেন, আগে মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে টিনের ঘরে থাকতাম। এখন থাকি বিল্ডিংয়ে। এখন থাকার কোনো সমস্যা নেই। খাওয়া আর চলার জন্য শুধু টাকা হলেই হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে একটু দূরে একটি বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি করছি। তা দিয়ে এখন আমার সংসার চলছে।
খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প
কক্সবাজারের জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। ২০২০ সাল থেকে কক্সবাজারের সদরের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তু ও কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ফলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাসস্থান তৈরির কাজ শুরু করে সরকার। ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমির এই প্রকল্পটিতে এক হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনে রয়েছে ৩২টি করে ফ্ল্যাট, প্রত্যেক ফ্ল্যাটে থাকবে একটি করে পরিবার। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন (মোট ব্যবহারযোগ্য) ৪০৬ দশমিক ৭ বর্গফুট, প্রতিটি তলায় রয়েছে কমন সার্ভিস সুবিধা।
আরও পড়ুন>> বিদ্যুৎ না থাকায় কুতুবদিয়ায় হতো না সিজারও
মোট চারটি জোনের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। তবে ১৩৯টি ভবনের মধ্যে ইতোমধ্যে ২০টি ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ভবনে ৬০০টি পরিবার প্রায় তিন বছর ধরে বসবাস করে আসছে। কাজ চলমান থাকা বাকি ভবনগুলোরও কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে এসব ভবনে উপকারভোগীরা উঠতে পারবেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পটিতে পুনর্বাসন করা হবে চার হাজার ৪০৯টি পরিবারকে। প্রতিটি পরিবারের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, সুয়ারেজ লাইন, সোলার প্যানেল, প্রতিটি ভবনে রয়েছে গেস্ট হাউজ, রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন সবকিছু। এছাড়া অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার। উপকারভোগীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রয়েছে ১৪টি খেলার মাঠ, তিনটি পুকুর, একটি মসজি ও একটি মন্দির। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে।
এর ফলে প্রকল্পের বাসিন্দারা নগরের বাসিন্দাদের মতো সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু উদ্বাস্তু ও কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ফলে যেসব মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে তাদের আশ্রয়ের জন্য এই প্রকল্পটি করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ২০টি ভবন নির্মিত হয়েছে। ৬০০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, সুয়ারেজ লাইন, সোলার প্যানেল, প্রতিটি ভবনে রয়েছে গেস্ট হাউজ, রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন সবকিছু। এছাড়া অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার।
আরও পড়ুন: চলতি বছরই রেল যাবে কক্সবাজার, বদলে যাবে পর্যটন
তিনি বলেন, পুনর্বাসিত পরিবারের জীবিকার সুবিধার্থে আধুনিক শুঁটকিমহাল, জীবনমান উন্নয়নের জন্য ৯৫ একর জায়গার ওপর শেখ হাসিনা টাওয়ার স্থাপন ও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আরএসএম/বিএ