সন্তান হত্যায় মায়ের স্বীকারোক্তিতেও বিশ্বাস নেই এলাকাবাসীর


প্রকাশিত: ০৩:৩০ পিএম, ১৬ মার্চ ২০১৬

মায়ের হাতে দুই সন্তান খুনের খবর চাউর হওয়ার পর থেকে অজানা আতঙ্ক কাজ করছে রাজধানীর রামপুরার অভিভাবকদের মধ্যে। মা সন্তানদের ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করেন। অনেক কষ্টে লালন পালন করেন। নারীছেঁড়া কষ্টের ধনকে মা নিজ হাতে ওড়না পেঁচিয়ে খুন করতে পারেন- এমন কথায় বিশ্বাস নেই এলাকাবাসীর; যদিও র‌্যাব ও পুলিশের দাবি, দুই শিশু খুন হয়েছে মায়ের হাতেই। মা নিজেও বলছেন সে কথাই।   

২৯ ফেব্রুয়ারি বাসার ভিতর দুই ভাই-বোন খুন হওয়ার পর ১৪ দিন কেটে গেলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি রামপুরার বনশ্রী এলাকাবাসীর। সন্তানদের মুহূর্তের জন্যও আলাদা হতে দিচ্ছেন না অভিভাবকরা। সবসময়ই তাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে- না জানি কোন অঘটন কিংবা অশুভ কিছু ভর করে বসে!

তবে বনশ্রীর কেউই মায়ের হাতে সন্তান খুনের ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাদের মতে, সুস্থ মা সন্তান খুন করতে পারেন না। তিনি অসুস্থ ছিলেন, নয়তো অন্য কোনো কারণ রয়েছে। সোমবার দুপুরে রামপুরার বনশ্রী বি ব্লক এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।


দুপুর আড়াইটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, রামপুরা থানাধীন বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কে সুনসান নীরবতা। কোনো কোলাহল নেই। যেখানে ১০ দিন আগেও শিশুরা গলিতে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলতো। মাঝে মধ্যে কেবল ২/১টি রিকশা চলতে দেখা যায়।

৭ তলা বিশিষ্ট ৯ নম্বর বাড়িটির দারোয়ান পিন্টু মিয়া গেট লাগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিলেন। ডাক দিতেই দৌড়ে এসে তিনি বললেন, ‘কিতা কন, কিতা কইবার চান?’

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে উপরে যেতে চাইলে তিনি বললেন, ‘উপরে কেউ আর থাহেন না। আমান মিয়া হের মাও (মা) রে লইয়া দ্যাশে (গ্রামের বাড়ি) চইল্লা গেছে গা।’

পিন্টু মিয়া জাগো নিউজকে জানান, আড়াই বছর ধরে এই বাসায় কাজ করছেন তিনি। কখনো ৫ তলায় বসবাস করা আমানুল্লাহ পরিবারে ঝুটঝামেলা শোনেননি।


তার ভাষায়, ‘হপ্তাহের পেত্যেক দিনেই তো দুইডা মাইয়া আইয়া পড়াইতো। সকালে মাইয়াডারে লইয়া স্কুলেও যাইতে দেহিছি বউডারে। কিন্তু কেমনে কমু বাপু মায়ে এই আকাম করছে! বিশ্বাস করতে পারি না।’

পাশের বাসায় যাওয়ার পর নিচতলায়ই দেখা মিললো আমেনা বেগমের। বনশ্রীর ওই বাসায় মাস ছয়েক আগে আসা মাহফুজা ও আমানুল্লার পরিবারে ছয়মাস ধরেই ধোয়া-মোছা ও রান্নায় সহযোগিতা করে আসছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘স্যার জানেন নি! এহনো গা কাঁটা দিয়ে উডে, মায়ে এইডা কি ফারে (পারে) নি (না কি)? বিশ্বাস অয় না।’

তিনি বলেন, ‘এই মহল্লায় আহনের পর ছয় মাস ধইরাই বাসায় আন্দনের (রান্না) সাথে কাম করছি, যেদিন ঘটনা সেদিনও সকালে ধোয়া-মোছা কইরা সাড়ে ৯টায় বাইরা গেছি। সেদিন রাত সাড়ে ৯টায় শুনি অনেক ফুলিশ (পুলিশ) আইছে, বাচ্চা দুইডা মইরা গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমে শুনি খাবার খাইয়া পরে শুনি মায়ে ওড়না দিয়া পেঁচায়া মাইরা ফালাইছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নাই। কিন্তু এহন শুনি মা নাকি স্বীকার করছে। তয় এহনো বিশ্বাস করতে পারি না।’


তিনি জানান, কখনো কাজে যেতে দেরি হলেও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি নিহত দুই শিশুর মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। স্বামী বা সন্তানদের কখনো বকাঝকা করতেও শোনেননি তিনি। আমেনা বেগমে কাছে মাহফুজাকে কখনো অসুস্থও মনে হয়নি। তার প্রশ্ন, ‘এই মানুষ কেমনে খুন করে?’

একই কথা বলেন ওই পাশের বাসার দারোয়ান মোজাফফরও।

উম্মে সালমা নামে বনশ্রী সি ব্লকের এক অভিভাবকের সঙ্গে বি ব্লকের ৯ নং সড়কের মাথায় দেখা সোমবার বিকেল ৩টায়। ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আনামকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।

আচ্ছা আপনিও তো মা, নিজের ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছেন, টেক কেয়ার করেন নিশ্চয়! কিন্তু আপনি তো জেনেছেন আপনার এলাকাতেই মায়ের হাতে দুই সন্তান খুন হওয়ার খবর। আপনার কী মনে হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমারে এইসব বইলা লাভ নাই। চিন্তাও করতে পারি না ভাই। মাথাটা খারাপ হইয়া যায়। মা! ওহ না, এসব সম্ভব না!’


সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল আরেক এক অভিভাবক শেফালী আক্তার আইডিয়াল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে পুঁথির হাত ধরে ফিরছেন। পরিচয় দিয়ে একই বিষয়ে জানতে চাইতেই, চোখ ঘুরিয়ে ইশারায় বোঝালেন, সঙ্গে মেয়ে রয়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলা যাবে না এখন। পরে মেয়েকে পাশে রেখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘মা কখনো নারীছেঁড়া ধনকে খুন করতে পারে বিশ্বাস করি না। এর পেছনে নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ রয়েছে। কী কারণ থাকতে পারে তা বের করার দায়িত্ব পুলিশেরই।’

জুনায়েদ লাইব্রেরির সামনে গলির মুখে মোটরসাইকেল থেকে নেমে চায়ের দোকানে ঢুকতেই শোনা গেল একজন বলছেন, ‘মায়ের আকাম আছিল, নইলে কি আর এমনে ২ ছাওয়াল রে খুন করে নি?’

পাশে আরেকজন বলছেন, ‘ফাগল নি আফনে! মায়ে কি আর খুন করতে পারে নি? মাথায় সিট (সমস্যা) আছিল। তাই পারছে।’

নানা জনের নানা কথায় গরম হয়ে ওঠে চায়ের স্টল। আলোচনায় এও স্পষ্ট যে, অধিকাংশের মতে সুস্থ মা খুনি নন। হয় তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, নয় অন্য কেউ খুন করছেন।

জেইউ/এসএইচএস/এনএফ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।