বিএসএমএমইউ উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য-দুর্নীতির অভিযোগ
দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। করোনার সময় দেশের ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা ও সম্প্রতি দেশের প্রথম সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করে গড়েছে নজির। দেশের স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। কিন্তু মেয়াদের শেষ পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্যের অনিয়ম নিয়ে গত ২১ মে দুদকে এ অভিযোগপত্র জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুদকে জমা পড়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি অদক্ষ জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করছেন তার এমন হাসপাতাল পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার মাধ্যমে ৩০ জনের বেশি মেডিকেল অফিসার ও শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ায় আধুনিক হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন>> বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম বন্ধে বিচারিক ক্ষমতা চায় ইউজিসি
১৩ মার্চ ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত বিএসএমএমইউর চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয়েছে অভিযোগপত্রে। এতে বলা হয়েছে, একজন সহযোগী অধ্যাপককে মিডিয়া সেলের প্রধান বানিয়ে প্রকাশনার মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়েছেন। তার তত্ত্বাবধানে সমাবর্তনে ভুলে ভরা ম্যাগাজিন ও ব্যাগ ছাপিয়ে (যেখানে বঙ্গবন্ধু বানান ভুল লেখা হয়েছে) এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে কোটি টাকা হাতিয়েছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শারফুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে কনভোকেশনের নামে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে, যেখানে কোনো ধরনের টেন্ডার প্রক্রিয়ার নিয়ম মানা হয়নি।
চিকিৎসক ডা. ফারুক মুন্সির মাধ্যমে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া, আউট সোর্সিং টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানান অভিযোগকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের সিপিআর অনুসরণ না করে নিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্য ইউটিলিটি বিলসহ নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করছে না।
আরও পড়ুন>> নিয়োগ জালিয়াতি, অধ্যক্ষসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা
দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বিএসএমএমইউতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটেছে নজিরবিহীন অনিয়ম। যে সংখ্যায় নিয়োগ হয়েছে তার খুব সামান্যই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। বাকি সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া কী পদ্ধতিতে হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। যেহেতু সঠিক প্রক্রিয়া ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ফলে যাচাই-বাছাই ছাড়া এ নিয়োগে মানহীন-অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি অচিরেই মানহীন একটি প্রতিষ্ঠেন পরিণত হতে চলেছে। এই বিপুল সংখ্যক জনবলের বেতন বাবদ প্রায় ৩০ কোটি টাকা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, উপাচার্য তার ছেলে ও ছেলের স্ত্রীসহ ১০ জনকে চাকরি দিয়েছেন। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তার ছেলে ডা. তানভীর আহমেদকে হেডনেড বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরি দেন। তার ছেলের স্ত্রী ডা. ফারহানা খানম ফারহাকে মেডিকেল অফিসার, ভাগ্নে এসএম বাহালু পিয়াস তৃতীয় শ্রেণি, ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী শারমিন আক্তার দ্বিতীয় শ্রেণি, ভাগ্নে লিয়াকত হোসেন ফকির, শ্যালিকার পুত্র এবং পিএস ভাতিজাকে চাকরি দেন। এছাড়া ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. হাসনাত সাইদুল ইসলাম ও ডা. নওরীন আনোয়াকে মেডিকেল অফিসার পদে চাকরি দেন। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ডা. সুমাইয়া ফাজরিন এবং ২ অক্টোবর ডা. সানজানা কামালকে মেডিকেল অফিসার পদে চাকরি দেন।
আরও পড়ুন>> এফআরসিএস সনদ পেলেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যোগ্যতা থাকলে আমার ছেলে-ছেলের বউ বা আত্মীয় কেন এখানে চাকরি পাবে না? অবশ্যই পাবে।
ডা. শারফুদ্দিনের নিয়োগ বাণিজ্য বিষয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, উপাচার্য তার পিএস ডা. মো. রাসেলের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ১০১ কোটি টাকা (তিন শতাধিক কর্মচারী ও দুই শতাধিক নার্স নিয়োগ) আদায় করেছেন।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, উড়ো চিঠির সংস্কৃতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। সাধারণত প্রতিপক্ষরাই এ ধরনের কাজ করেন। ইউজিসিতে থাকাকালীন প্রায় দিনই এ ধরনের অভিযোগ শুনতাম। চেয়ারে একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার আগে তার জীবনের অতীত, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে খোঁজ নেয় সরকারের তদন্ত সংস্থা। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ মারাত্মক। এটা বরদাস্ত করার মতো নয়। বিএসএমএমইউ তো সরকারের স্পর্শকাতর একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে এ ধরনের অভিযোগ এলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই শ্রেয়।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ডিজিটালইজেশনের এ যুগে অপপ্রচার, কুৎসা, বিভ্রান্তিকর তথ্য, অপবাদ, হেনস্তা করে কারও সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করা সম্ভব নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আরও উন্নত ও দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বিএসএমএমইউকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আমি খুব বিব্রত! তবে, প্রত্যেকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং দিন শেষে তার ওপরই মূল্যায়ন হয়।
আরও পড়ুন>> নিয়োগে অনিয়ম, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএসএমএমইউ সার্বিক পরিস্থিতি ও অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আমার মেয়াদের শেষ দিকে এসব কথা বলে সরকারবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নামের বানান ভুল হওয়াটা সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। সমাবর্তনের স্যুভেনিয়রের কাজ পুনরায় চলছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সেক্রেটারি জেনারেল ডা এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমত যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সব সত্য কি না আমি জানি না। আর যদি এসব অভিযোগের সত্যতা থাকে তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ওনারও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন যারা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন, সিন্ডিকেট আছে। তাহলে এসব বিষয়ে তাদের ভূমিকা কী? এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে চলে আসে। এসব বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব সিন্ডিকেটের। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যান্ট কমিশন তাদেরও একটা সংযুক্তি আছে এসব বিষয় নিয়ে। তারা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখুক।
তিনি বলেন, যেহেতু অভিযোগ এসেছে খতিয়ে দেখা উচিত। তারপর সত্য-মিথ্যার বিষয়ে তারা ভালো করেই বলতে পারবেন। আর সত্যি হয়ে থাকলে করণীয় কী তা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেই আছে। যারাই আমরা কর্মস্থলে কাজ করে যাচ্ছি, তারা যদি জবাবদিহির আওতায় আসে তাহলে এ ঝামেলা কমে আসে। এই বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসকদের জন্য একটি স্পর্শকাতর জায়গা। অনেক আন্দোলনের ফসল এটি। সেই জায়গায় যদি এ ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটে তাহলে বিষয়টি দুঃখজনক ও বিব্রতকর।
এএএম/এএসএ