‘যে পর্যন্ত বেঁচে আছি স্ত্রীর খেদমত করে যাবো’


প্রকাশিত: ০২:৫২ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। মুগল সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ‘তাজমহল’ নির্মাণ করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রিয়ার ভালোবাসার জন্য রাজসিংহাসন ত্যাগ করার ঘটনাও রয়েছে। শেরপুরের বাবুল চন্দ পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী অসুস্থ স্ত্রীর সেবাযত্ন করে ভালোবাসার এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

শহরের নয়ানি বাজারের বাসিন্দা বাবুল চন্দ (৬০)। তার স্ত্রী করুণা চন্দ (৫৪) প্রায় ছয় বছর ধরে শয্যাশায়ী। মাইল্ড স্ট্রোক থেকে ব্রেইন স্ট্রোক করে শরীরের বামপাশ অবশ হয়ে গেছে। পক্ষাঘাতগ্রস্থ স্ত্রীকে অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। দেশের নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসক ও হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। শয্যাশায়ী করুণা চন্দকে ধরে ধরে বিছানা থেকে ওঠাতে হয়। বিছানায়ই তিনি মলমুত্র ত্যাগ করেন। মুখ বাঁকা হয়ে গেছে, কথা বলতে পারেন না, আটকে যায়। চোখে তার কেবলই কান্না। স্ত্রীকে বিছানা থেকে তোলা, ধোয়া-মোছা, স্নান করানো, খাবার খাওয়ানো, কাপড়-চোপড় কাচা, রান্না-বান্না, সবকিছু করতে হয়। গত ছয় বছর ধরে প্রতিটি দিন এভাবেই অসুস্থ স্ত্রীর সেবাযত্ন করে কাটিয়ে চলেছেন বাবুল চন্দ। মায়ের এমন অসুস্থতায় ছেলে তার বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। বাড়ির অন্যান্য লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনরা অসুস্থ এই মহিলাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। তাদের অনেকেই চান, মহিলা মরে গেলে নিজেও বাঁচেন, অন্যদেরকেও বাঁচিয়ে দেবেন। এনিয়ে ক্ষোভ থাকলেও এতটুকু কষ্ট নেই বাবুল চন্দের। তিনি নিরবেই অসুস্থ স্ত্রীর সেবায় নিজেকে সমর্পিত করেছেন।   

টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুরের বুরুলিয়া গ্রামে করুণা চন্দের বাবার বাড়ি। তার বাবা-মা, ভাইবোন কেউই এখন আর বেঁচে নেই। ১৯৭৬ সালে বিয়ে হয়ে বাবুল চন্দের ঘরে আসেন। তাদের ঘর আলোকিত করে আসে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহে। আরেকজন প্রতিবন্ধী হলেও শেরপুরেই বিয়ে হয়ে জামাইয়ের ঘর সংসার করছে। একমাত্র ছেলে বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে শহরের অন্যত্র বাসাভাড়া করে থাকছে।
 
১৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে শহরের নয়ানি বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিনফুটের একটি ছোট্ট দোকান। ক্রোকারিজ সামগ্রী বিক্রি করা হয় সেখানে। দোকানে তেমন মালপত্রও নেই। কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে দোকানেও ঠিকমতো বসতে পারেননা। এজন্য কামাই রোজগারও কমে গেছে। দোকানের পেছনেই একটি সরু গলি দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদুর অগ্রসর হতেই বাসার ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, ছোট্ট একটি কামরায় খাটের ওপর বসে কেবলই কেঁদে চলেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ করুণা চন্দ। এসময় মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট শিশুর মতো স্ত্রীকে আদর দিতে চেষ্টা করেন বাবুল চন্দ।    

বাবু চন্দ জানান, বাম সাইডে তার অবশ। ৬ বছর আগে এমন হয়েছে। মগবাজারে ডা. দীন মোহাম্মদকে দেখাইছি, ল্যাব এইডে চিকিৎসা করিয়েছি ডা. মল্লিকের কাছে। খালি কয় ওষুধ খাইয়ে যান। অনেক জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছি, ভালো হচ্ছেনা। তিনি বলেন, সেতো (স্ত্রী) বিছানা থেকে ওঠতে পারেনা, চলাফেরা করতে পারেনা। নিজেই খুব কষ্ট করে তুলে নিয়ে যেতে হয়। রান্না-বান্না, ধোয়া মোছা, স্নান করানো, কাপড়-চোপড় কাচা সবকিছু করতে হয়। সকালে দই চিড়া খাইয়েছি।

তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, আমার সবকিছু থেকেও নেই। স্ত্রী অসুস্থ রেখে ছেলে তার বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। স্ত্রীর সেবাযত্ন করবে এজন্য ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলাম। কিন্তু দুই মাস পর সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শহরের অন্য এক স্থানে বাসা নিয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রীকে তারা দেখতেও আসেনা। বড় মেয়ে ময়মনসিংহে বিয়ে দিয়েছি। সেই যা একটু সহায়তা করে। মাঝে মাঝে এসে আমাদের খোঁজখবর নিয়ে যায়। আরেক মেয়ে প্রতিবন্ধী। তাকে শেরপুরেই বিয়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে সেও রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। কেউ দেখেনা। আমরা চারভাই। ভাই-ভাইয়ে বউরা কেউনা। এলাকার লোকজনতো জিজ্ঞেস করে কেমন আছো, বাড়ির লোকজন তাও করেনা। বরং চিল্লাচিল্লি করে। যখন বিছানায় পায়খানা-প্রস্রাব করে দেয়, দুর্গন্ধ হয়, সেকারণে তারা চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাথায় তোলে। রাইতের মধ্যে ৫/৭ বার করে উঠতে হয়।

Sherpur-Pic
তিনি বলেন, যে পর্যন্ত আমি বেঁচে আছি, খেদমত করে যাবো। আমারো এমন হতে পারতো। আমার এমন হলে সেওতো করতো। আমি খালি একটা চিন্তাই করি, হঠাৎ করে যদি আমি মারা যাই, তাইলে তাকে কে দেখবে। ওতো পচে-গলে মরবে। তারতো কেউ নাই। একথা বলার সময় তার দু’চোখের কোনায় পানি জমে ওঠে।

তিনি বলেন, ভগবানের কাছে আমার কেবল একটাই চাওয়া, আমি বেঁচে থাকতে থাকতে যেন তার মরণ হয়। তিনি বলেন, আমি সবসময় বউকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি। গোসল করিয়ে পরিষ্কার জামাকাপড় পড়িয়ে গায়ে তেল মেখে কপালে সিদুঁর পরিয়ে দেই। যাতে কেউ আমার অসুস্থ স্ত্রীকে দেখে কোনো রকম খারাপ মন্তব্য করতে না পারে।
 
বাবুল চন্দের ছোট ভাই রতন চন্দ বলেন, বৌদির জন্য দাদা যা করছেন, তার কোনো তুলনা নাই। কতো কতো চিকিৎসা করলেন, কতো টাকা-পয়সা খরচ করলেন। বৌদিতো ভালো হওয়ার মতো নাই। দাদা নিজেই পায়খানা-প্রস্রাব থেকে শুরু করে সব কাজ করছেন। ধরে ধরে বিছানা থেকে ওঠাচ্ছেন, শোয়াচ্ছেন। বৌদির প্রতি তার সেবাযত্নের কোনো শেষ নেই। বৌদির জন্য দাদা এত করছেন, তারপরও দাদার কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো খেদ নেই। তিনি চান সবসময় বৌদিকে আগলে রাখতে।
 
প্রতিবেশী গৃহবধূ মিত্রা চন্দ বলেন, বাবুল দা তার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য যা করেন, এ সমাজে এমন কেউ করেনা। মহিলার জন্য খুব কষ্ট লাগে। কিন্তু আগের জন্মে ওই মহিলার কোনো ভালো কাম আছিলো, সেজন্য তিনি স্বামীর এমন সেবাযত্ন পেলেন।
 
আরেক প্রতিবেশী সঞ্জিব চন্দ বিল্টু বলেন, শাহজাহান হয়তো প্রেমেরে নিদর্শন স্বরূপ মমতাজের জন্য তাজমহল বানিয়েছেন। সেই সামর্থতো নেই। কিন্তু বাবুল চন্দ তার স্ত্রীর জন্য যা করছেন তা সমাজে বিরল। অসুস্থ স্ত্রীর জন্য কোনো পুরুষ এভাবে করতে পারে, কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেনা। ছেলে-ছেলের বউ অসুস্থ মাকে ফেলে চলে গেছে। বাড়ির অন্য লোকজনও খুব একটা ভালোচোখে দেখেনা। তাদের অনেক আত্মীয়স্বজনকে এমনও বলতে শুনেছি, মহিলা মরে গেলেই ভালো হতো। বেঁচে যেতাম। কিন্তু বাবুল চন্দকে কখনও শয্যাসায়ী স্ত্রীর প্রতি এতটুকু রাগ করতে, খেদোক্তি করতে দেখেনি। স্বামীর সেবাযত্নেই ওই মহিলা এখনও বেঁচে আছেন।

হাকিম বাবুল/এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।