‘রেলের টিকিট লাগলে এখানে আসবেন’
রেলস্টেশন চত্বরে ঢুকতেই ৪ জনের ছোট্ট জটলা। দাঁড়াতেই চোখ পড়লো একজনের হাতে টিকিট, অপর একজনের হাতে টাকা। টাকা নেয়া ও টিকিট দেয়ার কাজ ১০ সেকেন্ডেই শেষ। এবার যে যার মতো। পরে টিকিট ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল- তারা সবাই ময়মনসিংহে যাবেন। তাদের মধ্যে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বীরু নামে এক শিক্ষার্থী জানালেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের ‘আন্তঃনগর অগ্নিবীণা’র ১১০ টাকা মূল্যের টিকেট ১৬০ টাকায় কিনেছেন।
কমলাপুর রেলস্টেশনে এ দৃশ্যটি গত মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমলাপুরে নিত্য দিনের দৃশ্য এমনই। কাউন্টারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্খিত টিকেট পায় না যাত্রীরা। কিন্তু স্টেশন চত্বরেই বাড়তি টাকায় টিকিট মেলে দালারদের কাছ থেকে।
কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে মোট ৬৪টি আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ক্যান্টনম্যান্ট থেকে মৈত্রী ও নীল সাগর নামে ২টি মেইল সার্ভিস চলাচল করে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রেলে দালালদের দৌরাত্মের বাইরেও টিকিট বিক্রয়কারী (বুকিং মাস্টার), ট্রেন টিকিট একজামিনার (টিটি), নিরাপত্তা কর্মী, ট্রেনের পরিচালক, অ্যাটেন্ডেন্টরাও দুর্নীতিতে জড়িত।
সরেজমিনে দেখে যায়, ট্রেনের টিকিটকে ঘিরে কমলাপুর স্টেশনে গড়ে উঠেছে দালালচক্র। সাদা ও নীল রঙের পোশাক পরে বিনা টিকিটধারী যাত্রীদের কাছ থেকে রসিদ ছাড়াই টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া টিকিট দিয়ে যাত্রীদের প্রতারিত করা হচ্ছ। এ কাজে সহায়তা করেছেন রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলস্টেশনের কর্মকর্তা, বুকিং মাস্টারদের যোগসাজশে দালালদের কাছে চলে যাচ্ছে এসব টিকিট। এ জন্য রেলস্টেশনের ঊর্ধ্বোতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বুকিং মাস্টার পর্যন্ত পেয়ে থাকেন মোটা অঙ্কের টাকা।
পুনরায় স্টেশন চত্বরে খুঁজতে গিয়ে দেখা মিললো সেই দালাল স্বপনের সঙ্গে। যিনি ময়মনসিংহ রুটের ওই চার যাত্রীর কাছে বাড়তি টাকায় টিকিট দিয়েছিলেন। টিকিট পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘কয়টা লাগবে’। রাজশাহী যাবো রাতে, ৪টি টিকিট লাগবে।
স্বপনের উত্তর, “দাঁড়ান এখানে। আপনি চাইলেও টিকিট পাবেন না। চার দিন আগেই বুক হয়ে গেছে সব।” কাউন্টারে গিয়ে কথা বলে ফিরে এসে জানান, ৪টা টিকেটের দাম পড়বে ২ হাজার টাকা। নিজে থেকেই বললেন ‘আসল মূল্য কিন্তু ৩১৫ টাকা’। এরপর ঝটপট বলেন, আমার আরো কাজ আছে।
কিছুক্ষণ পরে জানাচ্ছি বলতেই বলেন, ‘এই আমার বইয়ের দোকান, টিকিট লাগলে এখানে আসবেন, স্বপন বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে আমায়।’
এবার কাউন্টারের সামনে যেতেই টানাটানি। কোথায় যাবেন। কয়টা লাগবে। আমাকে বলেন, আপনি কাউন্টারে পাবেন না। সেখানেই একই কায়দায় গলাকাটার মতো বাড়তি টাকায় টিকেট নিয়ে দিচ্ছে তারা।
কথা বলে জানা যায়, তার নাম শাহ আলম। সাংবাদিক পরিচয় জানতেই যেন উড়ে হাওয়া হয়ে যাওয়ার দশা তার। অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে স্থান পরিবর্তন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, “যাত্রীরা সময় মতো আসতেও পারে না, টিকিটও পায় না। কাউন্টারে দাঁড়িয়েও পায় না। আমরা আগে থেকে কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে থাকি। কিছু অর্ডারও বলতে পারেন। মানুষও ভোগান্তি ছাড়া টিকিট পায় আর আমরাও পাই বকশিস।”
তিনি আরো বলেন, “রেলস্টেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কাউন্টার মাস্টার আমাদের ভালো চেনে। তারাও এই টিকিট বাবদ বাড়তি টাকার ভাগ নেন। নইলে কী আর এখানে দাঁড়াতে পারি।”
শুধু শাহ আলম কিংবা স্বপন নয়, রশিদ, মটকা নিজাম কিংবা গোফরানদের মতো অর্ধশত দালাল রয়েছে কমলাপুরে রেলস্টেশনে। সবারই একই ব্যবসা। স্টেশনের ১৩, ১৪ ১৫, ১৬ ১৯ ও ২০ নং কাউন্টারসহ বেশ কয়েকটি কাউন্টারে দালালদের দৌরাত্ম বেশি লক্ষ্য করা যায়। ২০ নং বিশেষ কাউন্টারে পুলিশ সদস্যকেও টিকিট ম্যানেজ করে দিতে দেখা যায়।
শরফত ও পারভেজ নামে দুই পুলিশ কনস্টেবল জানান, আমরা স্টেশনের বাইরের দায়িত্ব পালন করি। টিকিট বিক্রি কিভাবে হবে বা না হবে তা দেখার দায়িত্ব আামদের না।
এ ব্যাপারে কথা বলে গিয়ে দেখা যায়, কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী বিকেল সাড়ে তিনটায় নিজের কক্ষে নেই।
কাউন্টারে টিকিট পাওয়া না গেলেও দালালদের হাতে কেন মিলছে টিকিট জানতে চাইতেই স্টেশন মাস্টার-২ নৃপেন্দ্র চন্দ্র শাহা বলেন, “কী বলেন, এখানে দালাল আসবে কই থেকে। কোন কাউন্টারে টিকিট নেই। সবখানেই আছে। আর এখন তো ঈদ না। আপনি টিকিট না পাইলে বলেন ম্যানেজ করে দিচ্ছি।”
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে জানান, “এখানে (কমলাপুর রেলস্টেশন) কিছু অসাদু লোক টিকিট বাইরে বিক্রি করছে। বাড়তি টাকায়। মাঝে মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযানও চালানো হয়। আগের থেকে তাদের দৌরাত্ম অনেক কমেছে।"
কমলাপুর রেলওয়ের ওসি আবদুল মজিদ বলেন, ঈদের সময়ই মূলতঃ দালালদের দৌরাত্ম বেশি থাকে। তবে বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে আবারো অভিযান চালাবেন বলে জানান।
জেইউ/এআর/আরএস/পিআর