অবসরভাতার যাতাকলে পিষ্ট এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীনে ভূমিকা রাখেন নরসিংদীর সিরাজুল ইসলাম। স্বাধীনতাত্তোর শিক্ষিত জাতি গঠনে তিনি যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। নরসিংদী পৌর এলাকার মীর ইমদাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দীর্ঘ দিন কর্মরত থাকার পর ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর অবসরে যান তিনি।
অবসরভাতার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে আবেদন করেন। কিন্তু অনেক দিন দেন দরবারের পরও তার ভাগ্যে জোটেনি সে টাকা। অনেকটা অর্থ সংকটে বিনা চিকিৎসায় এই মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলেও আজও তার পরিবার টাকা পায়নি।
একই জেলার চৈতণ্য উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী মো. কাজল মিয়া চাকরিরত অবস্থায় মারা গেলে তার স্ত্রী আখিনুর স্বামীর অবসর ভাতা তোলার জন্য আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবেদন করলেও আজও তার স্বামীর প্রাপ্য টাকা তুলতে পারেননি। অথচ দীর্ঘ চাকরি জীবনে তারা যে এমপিও পেয়েছেন, সেখান থেকে এই তহবিলের জন্য প্রতি মাসে ৪ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এই দু’জনই নয়। প্রতিষ্ঠানটির অর্থ সংকটের কারণে এভাবে অসংখ্য এমপিওভুক্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর ভাতা ভোগ না করেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। অনেকে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করলেও অবসর ভাত তুলতে পারছেন না। অবসরভাতা তোলার জন্য বর্তমানে প্রায় ৪৭ হাজার শিক্ষক দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে ৪ শতাংশ হারে অর্থ আদায় করা হয়। এই অর্থ দিয়ে অবসর ভাতা দেয়া হয়। বর্তমানে শিক্ষকদের কাছ থেকে মাসে আদায় হয় ১৭ কোটি টাকা। মাসিক গড়ে আবেদন জমা পড়ে ৮৪৯টি। এই হিসেবে মাসিক অর্থ দরকার ৩৬ কোটি টাকা। প্রতিমাসে ঘাটতি থাকে ১৯ কোটি টাকা। এক বছরে ঘাটতি থাকে ২২৮ কোটি টাকা। এ ঘাটতির জন্য বর্তমানে প্রায় ৪৭ হাজার আবেদন জমা আছে। এই আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দরকার।
কিন্তু সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠানটির না থাকায় ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে যারা আবেদন করেছেন বর্তমানে তাদের অর্থ ছাড় দেয়া হচ্ছে। অর্থ সংকটের কারণে টাকা ছাড় দেয়ায় চার বছরের বেশি সময় পিছিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে আবেদন। গুরুতর অসুস্থ্য, মুক্তিযোদ্ধা ও হজেগমনেচ্ছুক শিক্ষক-কর্মচারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবেদন নিস্পত্তি করে চেক প্রদানের কথা থাকলেও তাও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। পে স্কেল বাস্তবায়নের পর এ সঙ্কট রূপ নেবে মহাসঙ্কটে।
রাজধানীর পলাশী এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটিতে গত এক সপ্তাহ সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভোগান্তির শিকার শত শত শিক্ষকের ভিড়। তাদের কেউ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা। কেউ বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। শেষ বয়সে উপার্জন বন্ধ হওয়ায় এসব শিক্ষকের অনেকে অনাহার-অর্ধাহারেও দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু অবসর ফান্ডের জন্য নিজের বেতন থেকে কেটে রাখা টাকা তুলতে পারছেন না।
প্রতিষ্ঠানটির অর্থ সংকটের কারণে এমপি মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়েও টাকা তুলতেও ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকে। ফলে মানবেতর দিন কাটছে তাদের। তবে তদবির থেমে নেই। ৮ মাস পর গত ১২ জানুয়ারি নতুন সচিব নিয়োগ দেয়ার পর প্রতিদিনই সরকারির দলের প্রভাবশালী নেতা, সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের নেতারা ভিড় করছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। অন্যদিকে সংকটেকে পূঁজি করে প্রতিষ্ঠানটিতে একশ্রেণির দালালও গড়ে উঠেছে।
প্রতিষ্ঠানটির সামনে কথা হয় সাতক্ষীরা জেলার বল্লী মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আলী হুসাইনের ছেলে মো. আব্দুল্লাহ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা অবসর গ্রহণের পর অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। আমার মা অসুস্থ্য ও ভাই মানসিক রোগী। বাবার অবসর ভাতা তোলার জন্য ২০১২ সালের ২৯ মে মাসে আবেদন করেও আজ পর্যন্ত টাকা তুলতে পারিনি। অর্থের অভাবে চিকিৎসা তা দূরের কথা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এলাকার এমপি (সংরক্ষিত মহিলা আসন-১২) রিফাত আমিনের ডিও লেটার জমা দেয়ার পরেও কাজ না হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। কি করবেন তিনি কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু আলী হুসাইনই নয়। একই হতাশার কথা জানালেন চাঁদপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা উষাবন্ধন মজুমদারসহ আরও অনেকে।
গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটিতে কথা হয় সাবেক এমপি (সংরক্ষিত মহিলা আসন-৯) ও পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফরিদা আখতার হীরার সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার এলাকার অনেক অবসরপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও অসুস্থ শিক্ষক আবেদন করেও অবসর ভাতা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। সরকারিভাবে এখানে কোন বরাদ্দ দেয়া হয় না জেনে হতাশ হলাম। সরকারের কাছে দাবি থাকবে বাজেটে এ তহবিলের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখার।
অবসর বোর্ডের সাবেক সদস্য ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি রঞ্জিত কুমার জাগো নিউজকে বলেন, অবসর সুবিধা তহবিলে সরকারের কোন অর্থ বরাদ্দ নেই। শিক্ষকদের এমপিও থেকে চার শতাংশ টাকা কেটে নেয়া হয়। কিন্তু কষ্টের কথা হচ্ছে- আমাদের টাকাই আমরা পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও জটিল রোগীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থ দেয়ার কথা বলা হলেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষকদের প্রাপ্য মেটাতে নতুন পে-স্কেল কার্যকরের পরে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ লাগবে। তখন অর্থ সংকটে ২০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর ভাতা ভোগ না করেই মারা যেতে হবে। শিক্ষকদের মহাসংকট থেকে রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ টাকা করে আদায় এবং বাজেটে বরাদ্দ রাখার দাবি জানান তিনি।
বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব শরীফ আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পরে এখন পর্যন্ত বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সভা করে প্রতিষ্ঠানটির দুঃসহ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করবো। থোক বরাদ্দসহ জাতীয় বাজেটে অবসর তহবিলে যাতে বরাদ্দ দেয়া হয় তার জন্য চেষ্টা করবো।
তিনি আরো বলেন, অবসর ভাতার জন্য প্রতি বছর সরকার যদি ৫০-৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় তাহলে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবো। পে-স্কেলে বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় অবসর ভাতাও দ্বিগুণ হবে। সেজন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে কেটে রাখা অর্থের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা চলছে বলেও জানান তিনি।
এনএম/এসকেডি/এআরএস/এমএস