রফতানির প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য শুভ


প্রকাশিত: ০১:১৬ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতির চলমান বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। তুলে ধরেছেন অর্থনীতির নানা সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিশ্চয়তার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও শফিকুল ইসলাম।

জাগো নিউজ: কেমন আছেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : ভালো আছি। আপনারা?

জাগো নিউজ : আমরাও ভালো আছি। অর্থনীতির চলমান ধারায় অনেক সম্ভাবনার সূচক বিদ্যমান বলে কেউ কেউ মত দিচ্ছেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অর্থনীতির বর্তমান চিত্র কিছুটা মিশ্র বলে আমার কাছে মনে হয়। ভালো দিকও আছে, উদ্বেগের বিষয়ও আছে। রফতানি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা যেতেই পারে, যদিও টার্গেট পূরণ হয়নি। গত অর্থবছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এ বছর অর্থাৎ ১৫ জুলাই থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। রফতানির প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য শুভ সূচক।

মূল্যস্ফীতি সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। নভেম্বরেও একই চিত্র ছিল। মূল্যস্ফীতির এই মাত্রা খুব একটা উদ্বেগের নয়, যদিও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আরো কম রয়েছে। বছর শেষে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এমন আশঙ্কাও নেই।

Mirza-Ajijul-Islam

জাগো নিউজ : মাত্র বছরের শুরু, ‘বছর শেষে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না’-এমন ধারণার ভিত্তি কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। বিশ্ববাজার থেকে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, চলতি বছরে সেগুলোর দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম। এ কারণেই বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে টার্গেট ছিল, তা থাকতে পারে।

অর্থনীতির আরেকটি শুভ সংবাদ হচ্ছে- কৃষি ঋণের অগ্রগতি। ২০১৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। এবার তা ছিল ৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। এটি অর্থনীতির চলমান ধারাকে আরো শক্তিশালী করবে।

জাগো নিউজ : উদ্বেগের কথা বলছিলেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত অর্থবছরে এর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল দশমিক ০৬ (.০৬) শতাংশ। এর আগের বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।

জাগো নিউজ : রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে এই চিত্রকে ভয়াবহ বলা যায়?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : না, এটিকে ভয়াবহ চিত্র বলবো না। তবে প্রবৃদ্ধির এই নিম্নগতি তো নিশ্চয় উদ্বেগের বিষয়। দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের প্রবৃদ্ধি, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে ২৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ২৪ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। সুতরাং প্রবৃদ্ধি খুবই সামান্য।

আবার বড় বিনিয়োগের জন্য যে ‘ঋণ’ সেখানেও প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। গত অর্থবছরে ছিল ১২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে লেনদেন হয়েছে ১২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা।

জাগো নিউজ : রেভিনিউ নিয়েও তো আশার কথা নেই?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : হ্যাঁ, রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধিও টার্গেটের অনেক কম। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত অর্থবছরে ছিল ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট ছিল, তা উচ্চাভিলাষী।

জাগো নিউজ : লক্ষ্য পূরণে সরকার কী করতে পারে?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়িয়ে দেবে। জুলাই-নভেম্বর অর্থবছরে ১১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা বিক্রি করেছে। বাজেটে পুরো অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করার কথা ছিল।

Mirza-Ajijul-Islam

জাগো নিউজ : এতে কী সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সরকারের আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে সবচেয়ে ব্যয়বহুল মাধ্যম। এখানে সুদের হার অনেক বেশি। সরকার ঋণ নিয়ে যে সুদ বহন করে তার ৯০ শতাংশই যায় ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্রের খাতে। এ কারণে অন্যান্য খাতে সমস্যা হয়, বিশেষ করে সেবা খাত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। উৎপাদন খাতে ব্যয় কমাতে হয়। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে গত অর্থবছরের চেয়ে এ বছর প্রবৃদ্ধি খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।
 
জাগো নিউজ : সরকার গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্কও আছে। প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রবৃদ্ধি নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। না হলে আরো বাড়তো।’ অথচ এর আগের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

এছাড়া সহিংসতার মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কী করে হলো, এটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছিল বিশ্বব্যাংকও। আমার মনে হয় চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে।

জাগো নিউজ : চলমান পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধির এই হারকে স্ট্যান্ডার্ড বলা যেতে পারে কি না?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : ৬-এর ঘরে থাকছি, তা স্ট্যান্ডার্ড হতেই পারে। প্রবৃদ্ধির এই হার খুব নিম্ন পর্যায়ের, তা আমি মনে করি না। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির কারণে অনেক দেশেরই প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তবে প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাজেটে ৭ শতাংশের যে টার্গেট ছিল, তা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

জাগো নিউজ :  দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, এর মূল কারণ কী হতে পারে?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের প্রবৃদ্ধির মধ্যে আটকে আছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা। এখন হয়তো অস্থিরতা নেই, কিন্তু মানুষের মনে অনিশ্চয়তা আছে।

Mirza-Ajijul-Islam

কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এছাড়া পরিবহন, বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যা এখনও বড় হয়ে আছে। এই পুরনো সমস্যার কারণে মানুষ বিনিয়োগে আসতে চাইছে না।

অন্যদিকে বিশ্ব সংস্থাগুলো যে রিপোর্ট দিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক দিকটিই তুলে ধরা হচ্ছে।
বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪তম। এর আগের প্রতিবেদনে ছিল ১৭২তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগ বাড়ছে না এবং দেশের বড় একটি অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানানো হয়েছে...

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য না থাকার ঘটনা দুঃখজনক। কারণ এ ব্যাপারে একটি মনিটরিং সেল-ই আছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রেটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বড় অংকের টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে।

বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে বিশেষ সুবিধা নিয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির নামে কোটি কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মনিটরিং না থাকার কারণেই এমন হচ্ছে।

জাগো নিউজ : তেলের দাম বিশ্ববাজারে সর্বনিম্নে। বাংলাদেশ সরকার এখনও সমন্বয় করেনি। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : তেলের দাম কমানো সময়ের দাবি। আমরা যখন তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম ছিল সর্বোচ্চ। প্রতি ব্যারেল ১৫৬ ডলার হয়েছিল। এরপরেও আমি খাদ্য, সার এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করিনি।

আমরা তেলের দাম বাড়ানোর সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রতি তিন মাস পর পর রিভিউ করা হবে। কিন্তু এখন তা আর করা হচ্ছে না।

জাগো নিউজ : বলছিলেন-এখনও সমন্বয় করছে না সরকার। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবারো বেড়ে গেলে আমাদের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : তেলের দাম আপাতত বাড়ছে না, তা বলা যেতেই পারে। কারণ হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বে এখনও মন্দার ছোঁয়া রয়েই গেছে। জাপানেও মন্দা রয়েছে। আমেরিকা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও চীনের অর্থনীতি নিম্নমুখী। এ কারণে তেলের চাহিদা আপাতত বাড়ছে না। অন্যদিকে ওপেক তেলের সরবরাহও কমাচ্ছে না।

একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য তেলের দাম কমিয়ে আবার তা বাড়ানো মুশকিল। এ কারণেই হয়তো সরকার বাড়াচ্ছেও না, কমাচ্ছেও না। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে তখন সরকার বর্তমান সুযোগটা নিতে পারে। তবে অর্থনীতির স্বার্থে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করি এবং তার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

এএসএস/এসআই/আরএস/একে/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।