যানজটের নগরীতে স্বস্তি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৮ এএম, ০৫ মে ২০২২
ছবি: মাহবুব আলম

যানজটের নগরী ঢাকা। ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যেখানে দুরূহ ব্যাপার। এ শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় যানজটে। বিষয়টি নগরবাসীর জন্য পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের রুটিনে। তবে আছে ব্যতিক্রমও। এর মধ্যে একটি হাতিরঝিল। এখানে চক্রাকার বাসে সহজেই আশপাশের গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। নেই যানজটের ধকল। একই সঙ্গে ভ্রমণের সময় প্রকৃতির ছোঁয়া পান যাত্রীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা বিনোদনপ্রেমীরা জানান, এক সময় বাড্ডা বা রামপুরা থেকে মগবাজার-কারওয়ান বাজার যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগতো। এখন হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসে এই দূরত্বে যেতে সময় লাগছে মাত্র ১০-১৫ মিনিট। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ফলে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাতিরঝিলের ‘চক্রাকার বাস সার্ভিস’।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানায়, হাতিরঝিলের চারপাশে ১৬ কিলোমিটার একমুখী সড়ক। ২০১৬ সালে এই সড়কে যাত্রী পরিবহনে চালু হয় ১০টি মিনিবাস। এখন এই রুটে ২০টি বাস চলছে। এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এইচআর ট্রান্সপোর্ট। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রাজউক। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিরতিহীনভাবে রাত ১১টা পর্যন্ত এই বাস চালু থাকে।

সম্প্রতি সকালে অফিসের সময়ে এবং বিকেলে কয়েকটি স্থানে যানজট তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এইচআর ট্রান্সপোর্ট। বিষয়টি সমাধানে ট্রাফিক বিভাগ ও রাজউককে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজউক বলছে, হাতিরঝিল প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করা। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর প্রায় তিন বছর হাতিরঝিলের ১৬ কিলোমিটার চক্রাকার সড়কে কোনো বাস অথবা মিনিবাস চলার অনুমতি ছিল না। এতে এই এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, বনশ্রী, রামপুরা, নিকেতন, মধুবাগ, মহানগর প্রজেক্ট, উলন এবং মগবাজারের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ ছিল নিত্যদিনের। এখন এসব এলাকার মানুষ হাতিরঝিলের সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহন করছে চক্রাকার বাস সার্ভিস। ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী বাড্ডা-রামপুরা থেকে মহানগর, মধুবাগ, বউবাজার, হ্যাপি হোমস, শুটিং ক্লাবের ভাড়া ১৫ টাকা। ২০ টাকা ভাড়া এফডিসি মোড় পর্যন্ত।

যানজটের নগরীতে স্বস্তি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস

কারওয়ান বাজারের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আরিফ হোসেন। পরিবার নিয়ে থাকেন দক্ষিণ বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায়। প্রতিদিন সকালে তিনি হাতিরঝিল দিয়ে চক্রাকার বাসে কারওয়ান বাজারে অফিসে যান। হাতিরঝিলে পুলিশ প্লাজার সামনে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আগে বাড্ডা থেকে সরাসরি কারওয়ান বাজার যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। অনেক দূর ঘুরে যেতে হতো অফিসে। যানজটে সময়মতো অফিসে যাওয়া সম্ভব হতো না। হাতিরঝিল চক্রাকার বাস চালু হওয়ার পর সেই কষ্ট কমেছে।

গুলশান-১ এ এসেছিলেন মগবাজারের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। ফেরার পথে পুলিশ প্লাজার সামনে থেকে চক্রাকার বাসে ওঠেন। নামেন এফডিসি মোড়ে।

চক্রাকার বাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, গুলশানে তার বড় ছেলের ব্যবসা রয়েছে। মাঝে মধ্যে সেখানে যান। যাওয়া-আসায় তেমন কষ্ট হয় না। আগে মগবাজার থেকে গুলশান যেতে তেজগাঁও সাতরাস্তা, নাবিস্কো, মহাখালী হয়ে যেতে হতো। এখন কষ্ট হয় না তেমন। চক্রাকার বাসে উঠলে সহজেই গন্তব্যে যাওয়া যায়। তবে অনেক সময় দেরিতে আসে বাস। বাসের সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত।

যানজটের নগরীতে স্বস্তি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসসেবা নগরবাসীর জন্য আশীর্বাদ। এ বাস দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছেন যাত্রীরা। পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়েও তেমন কোনো অভিযোগ নেই। তবে সম্প্রতি বাসভাড়া বাড়িয়েছে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষ। এতে নাখোশ যাত্রীরা।

রামপুরা থেকে এফডিসি মোড়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, হাতিরঝিলে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য ১০টি কাউন্টার রয়েছে। এর মধ্যে রামপুরা, মধুবাগ, এফডিসি মোড়, বৌবাজার, শুটিং ক্লাব ও মেরুল বাড্ডার ছয়টি কাউন্টারে পাঁচ টাকা করে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।

ছয় বছর ধরে হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসের ঠিকাদারি করছে এইচআর ট্রান্সপোর্ট। তারা জানায়, এখন হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহন করে ২০টি বাস। সেগুলো এফডিসি-শুটিং ক্লাব-রামপুরা-মধুবাগে চক্রাকারে ঘোরে। দিনে প্রায় পাঁচ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন এসব বাসে।

রামপুরায় চক্রাকার বাস কাউন্টারে ছয় মাস ধরে টিকিট বিক্রি করেন কামাল হোসেন। তিনি জানান, এই রুটে নিয়মিত যাত্রীর সঙ্গে পর্যটক রয়েছে। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার পর্যটক থাকে বেশি। আর অন্যান্য দিন কর্মজীবী যাত্রীর সংখ্যাই বেশি।

যানজটের নগরীতে স্বস্তি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস

এইচআর ট্রান্সপোর্টের স্বত্বাধিকারী আব্দুল হালিম জাগো নিউজকে বলেন, যাত্রী পরিবহনে অনন্য ভূমিকা পালন করছে হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস। তবে রামপুরা, পুলিশ প্লাজা, এফডিসি এলাকায় সকাল-বিকেল ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বাড়ে। তখন কিছুটা যানজট হয়। অন্যথায় হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহনে আর কোনো সমস্যা নেই।

ভাড়া বেড়েছে চক্রাকার বাসে
গত বছরের ৭ নভেম্বর বাসভাড়া বাড়ায় সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহানগরে বাসের আগের ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা, সেটা বর্তমানে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৪৫ পয়সা। মহানগরে মিনিবাসের আগের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা। সেটি বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কিছুদিন পর হাতিরঝিলে চক্রাকার বাসের ভাড়া বাড়ায় রাজউক। তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যাত্রীরা। এখনো বাসভাড়া নিয়ে আপত্তি রয়েছে তাদের।

যানজটের নগরীতে স্বস্তি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস

তবে চক্রাকার বাস সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি কিলোমিটার বা মিটার মেপে ভাড়া আদায় করা সম্ভব নয়। তাদের টিকিট কাউন্টারগুলোও মিটার মেপে বসানো হয়নি। ফলে আগের নির্ধারিত ভাড়া থেকে প্রতি কাউন্টারে গড়ে পাঁচ টাকা করে ভাড়া বাড়ানো হয়। এর মধ্যে অল্প দূরত্বের ভাড়া বাড়ানো হয়নি।

এইচআর ট্রান্সপোর্টের পরিদর্শক জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার গণপরিবহন ভাড়া বাড়ানোর কিছুদিন পর চক্রাকার বাসের ভাড়া বাড়িয়েছে রাজউক। বিশেষ করে এফডিসি মোড় থেকে রামপুরা আসা-যাওয়ার ভাড়া পাঁচ টাকা করে বাড়ানো হয়। অন্যান্য গন্তব্যে নেওয়া হচ্ছে আগের ভাড়াই।

জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ নূরী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত হারেই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এর বেশি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই।

এমএমএ/জেডএইচ/এএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।