ঈদের সেই আনন্দ আর নেই
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে গত দুই বছরের ঈদে আনন্দ, খুশি কোনোটাই তেমন ছিল না। অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে মানুষ ঈদের সময় কাটিয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফলে আবার জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই।
এই ঈদের আনন্দ-খুশি ভাগাভাগি করতে এক একজনের রয়েছে এক এক রকম পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা সাজবে প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তা-চেতনায়। আনন্দের মুহূর্তগুলো আরও আনন্দময় করতে কতো পরিকল্পনাই না করি আমরা। বয়সভেদে রয়েছে সেই পরিকল্পনায় ভিন্নতা। শৈশবের উদযাপন একরকম, কর্মজীবনের আরেক রকম।
জাগো নিউজ জানার চেষ্টা করেছে বিমা পেশার কিছু সফল ব্যক্তির ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা। এবারের ঈদুল ফিতর নিয়ে কী পরিকল্পনা করেছেন তারা? কেমন ছিল তাদের শৈশবের ঈদ? তা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
বিএম ইউসুফ আলী
পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিইও এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিএম ইউসুফ আলী। ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর মানুষ ঈদ সেভাবে উদযাপন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর নানামুখী চেষ্টায় করোনা পরিস্থিতি এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এবার মানুষ ঈদ ভালোভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারবে ইনশাল্লাহ।
তিনি বলেন, ঢাকায় পরিবারের সদস্য, কলিগ এবং বন্ধুদের সঙ্গে এবারের ঈদ উদযাপন করবো। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেব। ঈদের দিন আমার অফিসের লোকজন এসে দেখা করে। এতে ওরা যেমন খুশি হয়, আমিও খুব খুশি হই।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর মানুষ অনেক কষ্ট করেছে। এখনও অনেকে কষ্টে আছেন। দোয়া করি সবাই যেন ভালো থাকেন এবং সুন্দরভাবে এবারের ঈদ উদযাপন করতে পারেন।
এই বিমা নির্বাহী বলেন, ছোটবেলায় ঈদ অনেক আনন্দের ছিল। নতুন পোশাক পরে সবাই দল বেঁধে ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যেতাম। মুরব্বিদের সালাম করতাম। সালামি বাবদ পঞ্চাশ পয়সা, এক টাকা পেতাম। সালাম করলেই টাকা পেতাম। এতে যে খুশি হতাম তা বলে বোঝানো যাবে না। শৈশবের সেই স্মৃতি খুব মিস করি। এখন আর সেই পরিবেশ নেই। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা কমে গেছে।
তিনি বলেন, আমার ধারণা আগে মানুষের মধ্যে যে হৃদ্যতা ছিল এখন তার ৯০ শতাংশ নেই। আগে সবাই সবার বাড়ি যেত। এখন সেই পরিবেশ নেই। গ্রামের পরিবেশও এখন অনেকটা শহরের মতো হয়ে গেছে। আমরা আশা করবো সেই পরিবেশ আবার ফিরে আসুক। মানুষ মানুষের জন্য।
‘দেখেন ৫০০ টাকার কোনো মূল্য নেই। অন্তর থেকে ৫ টাকা দেওয়ার মূল্য অনেক বেশি। আগে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করত কি খেয়েছ? তোমার বাসায় কি আছে? দেখা গেলো কিছু নেই, তখন ঘর থেকে এক কেজি চাল দিতো। এটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। এখন লোক দেখানোর জন্য আমরা ঘটা করে শাড়ি, লুঙ্গি বিলি করি। কিন্তু আগের সেই পরিবেশ নেই। আগে মানুষ মানুষের জন্য কাজ করতো’বলেন বিএম ইউসুফ আলী।
তিনি বলেন, আমাদের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন এখনও আছে। আমরা আশা করবো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আবার সবাই সবার বাড়িতে যাক। সবাই মিলেমিশে আমাদের দেশটা এগিয়ে নেই। আমার কাছে মনে হয় করোনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। এবারের ঈদ অনেকটা আন্তরিকতা পূর্ণ হবে বলে আমি আশাবাদী।
জালালুল আজিম
প্রগতি লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জালালুল আজিম। ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই, তাই এবারের ঈদে ঢাকায়েই থাকবো। মূলত ঈদের সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাবো। এছাড়া যেসব পরিচালক ঢাকায় থাকবেন তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবো। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের কুশল বিনিময় করবো। গত দুই বছরের ঈদে বাইরে চলাচলের সুযোগ ছিল না। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। তাই এবারের ঈদ ভালো কাটবে বলে আশাবাদী।
তিনি বলেন, ছোটবেলায় ঈদ ছিল অন্যরকম। বাবার হাত ধরে ঈদের মাঠে যেতাম। বন্ধু-বান্ধব মিলে অনেক আনন্দ করতাম। সেসব স্মৃতি প্রায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মা মারা যাওয়ার পর আর গ্রামের বাড়িতে ঈদ করা হয়নি। প্রায় ২০ বছর ঢাকায় ঈদ করছি। এখন ঈদে সেই আনন্দ নেই। ঈদের দিন ঈদের নামাজ পড়ি, কয়েকজনের সঙ্গে কোলাকুলি করে চলে আসি। গ্রামে মানুষের মধ্যে যে হৃদ্যতা, ঢাকায় সেটা অনুপস্থিত।
জামিরুল ইসলাম
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স’র মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জামিরুল ইসলাম। ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, বাবা-মা নেই। বরাবরের মতো এবারও ঢাকায় ঈদ করবো। শৈশবে বাবা-মার সঙ্গে ঈদ করতাম। সেই ঈদে অনেক আনন্দ হতো। এখন বাবা-মাকে ছেড়ে ঈদ করতে কষ্ট হয়। শৈশবে অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। অনেকের সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। সেই সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল অনেক। এখন সেই পরিবেশটা খুব একটা পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমরা মুরব্বিদের সালাম করতাম এবং সালামি পেতাম। অনেক আনন্দ হতো। এখন সালাম ও সালামির পরিবেশ অনেকটা অনুপস্থিত। ছোটবেলায় সেই পরিবেশ এখন আর পাই না। এটা খুব মিস করি।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছরে মানুষ ঈদ করতে পারেনি। অনেকের আয় কমে গেছে। অনেকে কষ্টে আছেন। এসব মানুষের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন সবাইকে ভালো রাখেন।
আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী
বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সিইও আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী। তিনি এবারের ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে বলেন, আমি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি ঈদ করি। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর গ্রামের বাড়িতে ঈদ করা হয়নি। এবার আবার গ্রামের বাড়িতে ঈদ করবো।
তিনি বলেন, ঢাকার ঈদ এবং গ্রামের ঈদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। গ্রামে ঈদ করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, ঢাকায় তা নেই। ঢাকার ঈদ মূলত ঘরবন্দি জীবন কাটানোর মতো।
তিনি বলেন, শৈশবের ঈদ অনেক মজার ছিল। অনেক আনন্দ করতাম, মজা করতাম। বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। ২০০০ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর, ২২ বছর বাবাকে ছাড়াই ঈদ করছি। ঈদের দিন বাবাকে খুব মিস করি। শৈশবের ঈদ স্মৃতিগুলোও খুব মিস করি। এখন ঈদ অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে।
জাহিদ আনোয়ার খান
সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. জাহিদ আনোয়ার খান। এবারের ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সব সময় ঢাকায়ই ঈদ করি। এবারও ঈদের সময় ঢাকায়ই থাকবো। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো। সেই সঙ্গে ঢাকায় যেসব আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাদের সঙ্গে দেখা করবো, যাদের সঙ্গে বছরে খুব একটা দেখা হয় না।
এ সময় শৈশবের ঈদের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ছোটবেলায় শীতের সময় গোসল করে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। কম্বলের ভেতর থেকে বেরিয়ে শীতের মধ্যে গোসল করা খুব কষ্টের ছিল। তারপরও সেই সময়ের ঈদ ছিল অনেক আনন্দের। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বাড়িতে যেতাম। সবার প্রতি সবার খুব টান ছিল। যান্ত্রিকতার কারণে ঈদের আনন্দ অনেক কমে গেছে। নতুন প্রজন্ম অনেকটা ফার্মের মুরগির মতো। আত্মীয়-স্বজনের প্রতি তাদের খুব একটা টান নেই। আমাদের সময় আত্মীয়-স্বজন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেত।
এস এম নুরুজ্জামান
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও এস এম নুরুজ্জামান। এবারের ঈদ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছরের ঈদ মানুষ উদযাপন করতে পারেনি। এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। আমাদের কর্মীরা যাতে ভালোভাবে ঈদ উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য আমরা ৫ মে ছুটি দেয়ার চেষ্টা করছি। এদিন ছুটি দিলে কর্মীরা লম্বা ছুটি পাবেন এবং ঈদ ভালোভাবে উদযাপন করতে পারবেন। আমি ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এবারের ঈদ উদযাপন করবো।
শৈশবের ঈদের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এখন বাবা নেই। মা আছেন। বাবাকে খুব মিস করি। শৈশবের ঈদের পরিবেশ এখন আর পাওয়া যায় না। বন্ধুরা দল বেঁধে ঘোরাঘুরি, ছুটাছুটি কতো কিছু করতাম। এখন আর সেগুলো নেই।
তিনি আরও বলেন, গ্রামের ঈদ এবং ঢাকার ঈদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। গ্রামের বাড়িতে একজন আরেকজনের বাড়িতে সেমাই, মিষ্টি খায় এবং আনন্দ করে। শহরে এটা নেই। কেউ কারও বাড়িতে যায় না। অনেকটা একঘেয়েমি ঈদ।
এমএএস/এসএইচএস/জেআইএম