ভাবলাম শর্টসার্কিট, দৌড়ে গিয়ে দেখি সামনে ১০টা লাশ পড়ে আছে
পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। বর্ষবরণের অন্যতম আকর্ষণ রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান। দীর্ঘ বছর ধরে এখানে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। কিন্তু সেই বটমূল রক্তাক্ত হয়েছিল ১৪০৮ সনের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলার মাধ্যমে। ২০০১ সালের ভয়ংকর সেই সকালে বোমার আঘাতে প্রাণ হারান ১০ জন। আহত হন আরও অনেকেই। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতিসহ বাঙালির অন্যতম এই উৎসব নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রাসেল মাহমুদ।
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলার পহেলা বৈশাখের স্মৃতি জানতে চাই।
সারওয়ার আলী: ১৯৫০ সাল থেকে ঢাকায় বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে বসবাস শুরু। ঢাকা মহানগরীতেও গ্রামের মতো মেলা হয়, নৌকা বাইচ হতো। তখন আমি স্কুলে পড়ি। শুরুতে এগুলো খেয়াল করিনি। বরং চৈত্রসংক্রান্তির দিনে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবটা পুরান ঢাকায় খুব চালু ছিল, উৎমুখর একটা পরিবেশ ছিল। এর বাইরে নববর্ষের আয়োজনে যেটি হয়েছে তা হলো ছোটখাটো দোকানদার বিশেষ করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা হালখাতা করতেন। তখন ওখানে কিছু কিনতে গেলে মিষ্টি পাওয়া যেত। এ ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল ছোটবেলায়।
জাগো নিউজ: এখনকার পহেলা বৈশাখ কেমন কাটে?
সারওয়ার আলী: নগর জীবনে যে পহেলা বৈশাখ, সেই অভিজ্ঞতা আমার পুরোটা ছায়ানটকে ঘিরে। ছায়ানট যখন আয়োজনটি শুরু করে তখন আমি এর একজন স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম। তখন আমি, আসাদুজ্জামান নূর, মতিউর রহমান, আজিজ আকরাম-এই চারজন তখন ছিলাম। ১৯৬৭ সালে ছায়ানটে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান প্রথম আয়োজন করা হয়। পাকিস্তান আমলে একটা ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। তারা আমাদের ধারাবাহিকভাবে আঘাত করেছিল। সেজন্য যারা বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে তাদের নিয়ে একটি মিলন মেলার আয়োজন এবং শুভেচ্ছা বিনিময়- সেই লক্ষ্য থেকেই প্রথম নববর্ষের আয়োজন করা হয়। ১৯৭১ সালের পর থেকে নিয়মিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। শুধু করোনার কারণে গত দুই বছর বন্ধ ছিল। পহেলা বৈশাখে এখন আমার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে, ভোরবেলা উঠেই রমনা বটমূলে যাওয়া।
জাগো নিউজ: বাঙালি সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশে পহেলা বৈশাখের ভূমিকা কেমন?
সারওয়ার আলী: প্রত্যেক মানুষেরই তো ধর্ম পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাস ও জাতিপরিচয় রয়েছে। পাকিস্তান আমলে চেষ্টা ছিল একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। সেখানে নববর্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে এবং স্বাধীকার যে আন্দোলন রয়েছে তা সমভাবে বিকশিত করেছে। সে কারণে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি এবং পহেলা বৈশাখ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সহায়ক হয়েছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ: ২০০১ সালে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হামলার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে যদি বলেন...
সারওয়ার আলী: অনুষ্ঠানে সাধারণত শিল্পীরা থাকেন সামনে, বাচ্চারা গান গায়। আমি, সনজীদা খাতুন, জামিল চৌধুরী, মফিজুল হক- আমরা চারজন সামনে যে জায়গাটা থাকে সেখানে বসেছিলাম। হঠাৎ ফ্ল্যাশ মারার মতো আলো জ্বলে উঠলো। আমরা ভেবেছিলাম মাইকের শর্টসার্কিট হয়েছে। কাজেই আমি আর মফিজুল দৌড়ে ওখানে গেলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম আমাদের সামনে ১০টি লাশ পড়ে আছে। তখনকার ডিএমপি কমিশনার মতিউর রহমানও সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন। তারা সম্ভবত আত্মঘাতি বোমা হামলাকারী ছিল। তাদের শরীরে প্রচণ্ড ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। তারা সম্ভবত বোমা ছুড়তে চেয়েছিল মঞ্চে, যেখানে শ’খানেক বাচ্চা ছিল।
জাগো নিউজ: কেন এই হামলা হলো এবং মূল উদ্দেশ্যটা আসলে কী ছিল বলে আপনার মনে হয়।
সারওয়ার আলী: অপব্যাখ্যা দিয়ে একটি শ্রেণী শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির একটা সাংঘর্ষিক অবস্থান সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করে এ ধরনের কাজ ধর্ম সম্মত নয়, কাজেই মানুষকে ভয় দেখিয়ে এই কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং সে কারণে তারা মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না, এটি খুব স্পষ্ট। এটি শুধু বাংলাদেশে ঘটছে তা নয়, সারা বিশ্বেই তা ঘটছে। ধর্মের চরমপন্থী লোক, তারা নানাভাবে ব্যাখ্যা দেয় মানুষকে। এতে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের একটা বিরূপ ধারণা হচ্ছে, ইসলামো ফোবিয়া তৈরি হয়েছে। তারা ইসলাম ধর্মটাকে যতটা ক্ষতি করেছে, সেটা অন্য কেউ করেনি।
জাগো নিউজ: এটা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর হামলা বলে মনে করেন?
সারওয়ার আলী: সংস্কৃতি যে কোনো জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। কাজেই আঘাত শুধু বাঙালি সংস্কৃতিতে নয়, বাঙালি মানসিকতায়। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ, শুধু সংস্কৃতিবিরোধী বিষয় নয় এটা।
জাগো নিউজ: এই ঘটনার পর পহেলা বৈশাখ আয়োজনে কী ধরনের প্রভাব পড়েছিল?
সারওয়ার আলী: একদমই কোনো প্রভাব পড়েনি। পরেরবারের অনুষ্ঠানের সময় অভিভাবকরা একটু চিন্তিত ছিলেন যে বাচ্চাদের তারা গান গাইতে দেবেন কি না, সেটা নিয়ে। কিন্তু শিশুরা একপায়ে দাঁড়ানো ছিল, তারা গান গাইবেই। এরপর যে ঘটনাটি ঘটেছে, ২০০১ থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় ছিল তারা নিরাপত্তার দিকটায় প্রচণ্ড জোর দিয়েছে। যার ফলে নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে আমাদের শিল্পীরা স্বস্তিবোধ করে। তারা ভয় দেখিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিল, তারা সেই কাজে সফল হয়নি।
জাগো নিউজ: ওই ঘটনার আগে ও পরে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে কী পার্থক্য দেখেছেন?
সারওয়ার আলী: নিরাপত্তার দিক ছাড়া আর কোনো পার্থক্য দেখি না। নিরাপত্তার দিকটা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাগো নিউজ: এই হত্যাকাণ্ডে ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। হত্যা মামলার বিচার হলেও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি এখনো শেষ হয়নি। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে কী বলবেন?
সারওয়ার আলী: এ বিষয়ে ছায়ানট কিছুই জানে না। রাষ্ট্র মামলা করেছে। আমাদের এক/দুজনকে শুধু সাক্ষীর জন্য ডেকেছিল। এছাড়া আমাদের তেমন কিছু জানা নেই। আমরা মনে করি সংস্কৃতিচর্চার মধ্যদিয়েই এই অপশক্তিকে রুখতে হবে। বিচার যদি বিলম্বিত হয় তবে বিচারহীনতার ব্যাপার হয়ে যায় এখানে। বহুক্ষেত্রে এমন ঘটেছে, এক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে এবং এ ধরনের একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার ঝুলে রয়েছে, এটা বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, সেখানে সহজে পরিত্রাণ আছে বলে মনে হয় না।
জাগো নিউজ: স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন।
সারওয়ার আলী: গত ৫০ বছরে একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে। প্রথমত বৈশ্বিকভাবে দেখলে মৌলবাদের যে বিস্তার ঘটেছে, বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়েছে। একটা ভালো-মন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোনো জাতির সংস্কৃতিকে সুরক্ষা দেওয়া বেশ কঠিন। আমরা মনে করি আকাশপানে নিশ্চয়ই তাকাতে হবে। কিন্তু আমাদের পদযুগল যেন বাংলার মাটিতে থাকে, বাংলার যে সংস্কৃতি সেটা সুরক্ষা করা দরকার। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের চাইতে রুচিহীনতা, সর্বগ্রাসী লোভ সমাজে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। এটি শুধু সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ব্যাপার নয়, একটা মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করেছে এবং একটা অবক্ষয়ে রূপ নিয়েছে। একটা ক্ষুদ্র কারণে চরমপন্থা যে কোনো কিছু গ্রহণ করতে পিছপা হয় না।
জাগো নিউজ: সমাজের চারপাশে এখন সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, এটি নিরসনের উপায় কী? পহেলা বৈশাখের চেতনা এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
সারওয়ার আলী: সাম্প্রতিক যে তিনটি ঘটনা, সেখানে ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে সাধারণ ছাত্রদের যুক্ত করে একটি গোষ্ঠী অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। যার মধ্যদিয়ে একটা ধর্মবিদ্বেষের প্রকাশ পাচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-সমাজ দুটোকেই শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। তা না হলে যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তা ম্লান হয়ে যাবে, সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাবে। নববর্ষ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একমাত্র উৎসব, এই বাণী যেন সবার কাছে পৌঁছায়।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সারওয়ার আলী: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
আরএসএম/ইএ/এএসএম